করোনার ভয়াবহতা বদলে দিয়েছে পুরো পৃথিবীর দৃশ্যপট। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছুটে চলা মানুষগুলো এখন ঘরবন্দি। এ অবস্থায় নিরাপদে থাকতে স্কুল-কলেজসহ সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। সেই সঙ্গে বন্ধ বাইরের খেলাধূলাও। আর ওই লম্বা ছুটিতে বাঙালির ঐতিহ্য রঙ্গিন ঘুড়ি নিয়ে মেতেছে শেরপুরের তরুণ প্রজন্ম।
বাহারি রঙের ঘুড়িতে ছেয়ে গেছে শেরপুরের আকাশ। দিনে তো বটেই, রাতেও আকাশে উড়ছে লাল, নীল, সবুজ, হলুদ, বেগুনি নানা রঙের ঘুড়ি। দেখে মনে হচ্ছে, রঙের মেলা বসেছে আকাশজুড়ে। এই করোনাকালীন সময়ে বিনোদনের খোঁজে আবার যেন বাঙালি সংস্কৃতিতে ফিরে এসেছে হারিয়ে যাওয়া লোকায়িত সংস্কৃতি ঘুড়ি উৎসব। বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায় এখন কেবলই শুধু রঙ বেরঙের ঘুড়ি নীল আকাশে। শিশু-তরুণ-যুবক এমনকি মাঝ বয়সীরাও বাদ যায়নি ঘুড়ি উড়ানো থেকে। দিন-রাত আকাশে শোভা পাচ্ছে নানা রঙের ঘুড়ি। বিশেষ করে রাতের আকাশে লাইটিং ঘুড়ির ঝলমলে আলো দেখে মুগ্ধ হচ্ছেন এলাকার মানুষ।
করোনা আতঙ্কের প্রতিটা বিকেল একটু হলেও আনন্দে পার করছেন গ্রামীণ ঐতিহ্য ঘুড়িপ্রেমীরা। ফলে ঘুড়ি বানানোর ধুম পড়েছে। আকাশে চোখ মেললেই ঘুড়ির উড়ানোর দৃশ্য! জেলার বিভিন্ন এলাকায় দিন-রাত ছোট-বড় নানা বয়সী ঘুড়িপ্রেমী মেতেছেন এই ঘুড়ি উৎসবে। সকাল-বিকেল নদীর পারে, বাড়ির ছাদে, খোলা মাঠে, খালি জায়গায় ঘুড়ি উড়াতে দেখা যায়। আকাশে উড়ার সময় দেখতে অনেকটা উড়ন্ত চিলের মতো লাগে বলে একে অনেকসময় চিল ঘুড়ি বলা হয়। মাছ বা প্রজাপতির আকারেও ঘুড়ি বানানো হয়। বড় আকৃতির অন্য একটি ঘুড়ির নাম উড়োজাহাজ ঘুড়ি। এটি আকাশের অনেক উপরে ওড়ে। এ ছাড়াও আছে ঘর ঘুড়ি, সাপ ঘুড়ি, মানুষ ঘুড়ি, চারকোনা আকৃতির বাংলা ঘুড়ি, বক্স, মাছরাঙা, ঈগল, ডলফিন,সাপ, কামরাঙা, চিলা ঘুড়ি, ঢোল ঘুড়ি ইত্যাদি।
শুধু দিনেই নয়, এখন শেরপুরে রাতের আকাশেও ঘুড়ি উড়ে। রাতে ঘুড়ি উড়ানোর জন্য ঘুড়িতে যুক্ত করা হচ্ছে ব্যাটারিচালিত বাতি, যা রাতে উড়ানো ঘুড়িতে জ্বলছে। বড়দের কেউ কেউ ঘুড়ি বানাতে পারলেও শিশু-কিশোররা বেশির ভাগই ঘুড়ি কিনে উড়িয়ে থাকে। আবার যাদের ঘুড়ি ওড়ানোর সুযোগ নেই তারা দূর থেকে অন্যের ঘুড়ি ওড়ানো দেখে আনন্দ উপভোগ করছেন। ঘুড়ি উড়ানোকে কেন্দ্র করে বিক্রি হচ্ছে ঘুড়ি তৈরি করার উপকরণও। সেই সাথে কদর বেড়েছে ঘুড়ি তৈরির কারিগরদের।
স্কুল শিক্ষার্থী হিমেল ও জিহাদ জানায়, দীর্ঘদিন ধরে স্কুল বন্ধ। আগে বিকেলে মাঠে খেলাধুলা করতাম। এখন তো আর সেটা সম্ভব নয়। সবসময় রুমেই থাকা হয়। একঘেয়েমি কাটাতে বিকেলে এখন সবাই মিলে ঘুড়ি ওড়াই আমরা। ভালোই লাগে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া শিক্ষার্থী সাব্বির আহমেদ জানান, করোনার প্রাদুর্ভাবে দীর্ঘদিন ধরে ঘরবন্দী। এর ফলে মানুষের মনে যে ক্লান্তি ও অবসাদ জমেছে, এ ঘুড়ি ওড়ানোর সময় তা কেটে যায়। মনটা চাঙ্গা হয়ে ওঠে।
শিক্ষক আকাব্বর আলী জানান, তার দুই ছেলে ৩ মাস ঘরবন্দী থেকে হাঁপিয়ে উঠেছে। তাদের সঙ্গে বাহিরে ঘুরতে যাওয়ার উপায় নেই। তাই ওদের ঘুড়ি উড়ানো দেখে পেছনে ফেলে আসা সোনালি অতীতের স্মৃতি মন্থন করি। উপজেলা শহর থেকে ঘুড়ি উড়ানো দেখতে আসা শিক্ষক মোশারফ হোসেন জানায়, করোনা পরিস্থিতির উন্নতি কবে হবে তা বলা যাচ্ছে না। আবার বাসায় দীর্ঘদিন অবস্থান করার ফলে অনেকের মধ্যেই ক্লান্তি ও অবসাদ ভর করছে। অনেকেই ঘুড়ি উড়িয়ে সেই ক্লান্তি ও অবসাদ ঝেড়ে ফেলতে চাইছেন। মুক্ত আকাশে ঘুড়ি উড়িয়ে বদ্ধ হয়ে থাকা এক মানসিক যন্ত্রণা থেকে কিছুটা হলেও মুক্তি মেলছে।
এদিকে ঘুড়ি বানানোর কারিগর নকলা উপজেলার চন্দ্রকোনার বাসিন্দা ফুরকান আলী জানান, এর আগে কখনো এতো ঘুড়ির উড়াতে দেখা যায়নি। আগে সাধারণত শীতকাল থেকে বসন্তকাল পর্যন্ত ঘুড়ি ওড়াতে দেখা যেত। কিন্তু এবার গরমের মধ্যেও ঘুড়ি উড়াতে দেখা যাচ্ছে। লকডাউনে ঘরবন্দী তরুণরা ঘুড়ি বেশিই উড়াচ্ছে। প্রতিদিন ঘুড়ি তৈরি করি। অনেক ছেলেরা আসে ঘুড়ি তৈরি করার জন্য। আমি তাদের পছন্দ অনুযায়ী নানান ধরণের ঘুড়ি তৈরি করে দিই।
লেখক : মো: সুখন মিয়া , বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী।