রফিক মজিদ
পৃথিবীর সব বাবাই তার সন্তানদের কাছে পাহাড় সমান বড় মন এবং বটবৃক্ষের মতো আমৃত্যু ছায়া দিয়ে থাকেন। বাবা মানেই শাসন, বাবা মানেই সোহাগ। আবার কখনও কখনও বাবা মানেই শত বিপদে একমাত্র ভরসার স্থল।
জীবন যুদ্ধে ক্লান্ত হলে অথবা পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে সন্তানরা যখন হতাশায় ভুগে তখন বাবারাই সন্তানদের পিঠ চাপড়ে বলে, ‘চিন্তা করিস নানা বাবা, আল্লাহর উপর ভরসা কর, সব ঠিক হয়ে যাবে।’ পৃথিবীর সব বাবাই নিজেদের বেলায় খুব কৃপণ থাকে, কিন্তু সন্তানদের বেলায় মন থাকে রাজা-বাদশার মতো। পকেটে টাকা থাক আর না থাক ঋণ করে হলেও সন্তানের মনের আশা পূরণ করবে।
আমার বাবা চলতি বছরের ১৫ এপ্রিল আমাদের ছেড়ে না ফেরার দেশে চলে গেছে। বাবা বেঁচে ছিলেন প্রায় ৮৬ বছর। আমিও এখন বাবা। তিন সন্তানের জনক আমি।
ছোটবেলা থেকেই দেখেছি আমার বাবা হাড় ভাঙা পরিশ্রম ও তিল তিল করে শেরপুর শহরের প্রাণ কেন্দ্রে আমাদের জন্য গড়ে তুলেছেন দু’টি বাসা। এতে মার্কেট ও নিজস্ব থাকার বাড়ি রয়েছে। যার উপর ভর করে আমরা ৩ ভাই বেঁচে আছি বেশ সাচ্ছন্দেই। কিন্তু এসব গড়তে তার সময় লেগেছে প্রায় ৫০ বছর। বলতে গেলে শূণ্য থেকেই তার যাত্রা। তার যৌবনকাল থেকে শুরু করে মধ্য বয়স পর্যন্ত পুরেটাই কেটেছে আমাদের জন্য সুখের আবাস গড়ে তুলতে।
সব বাবার কাছেই সন্তানরা বাবার আদর-ভালোবাসা দেওয়া ছাড়াও অনেক কিছুতেই ঋনী হয়ে থাকে। আমিও তেমনি ঋণী হয়ে আছি বাবার কছে আমার সুখের বসতি গড়ে তুলে দেয়ার জন্য। তবে মনের মাঝে সামান্যতম তৃপ্তি রয়েছে যে বাবার মৃত্যুকালীন সময় প্রায় ৩/৪ মাস সয্যাশয়ী থাকা অবস্থায় সন্তান হিসেবে আমিসহ আমার অন্য দুই ভাই এবং ভাইদের স্ত্রী-পুত্র কিছু সেবাযত্ন করতে পেরেছি।
তার মনের কিছু কিছু তৃপ্তবাসনাগুলো মেটানোর চেষ্টা করেছি। সমাজের অনেক সন্তানদের মতো বাবাকে দূরে না রেখে নিজের সংসারে নিজের কাছে রাখতে পেয়ে নিজেক সৌভাগ্যবান মনে করেছি।
আমার বাবা শিক্ষিত তা থাকলেও আমাদের ৫ ভাই-বোনকে শিক্ষিত করতে কোন কৃপণতা ছিলো না তার। ছোট বেলায় যখন বাসায় পড়তাম তখন শীতকালে প্রায় প্রতিদিন সকালে এবং সন্ধ্যায় একটি করে সেদ্ধ ডিম এবং গরমকালে বিস্কুট খাওয়াতো পড়া শেষে। যেন আমারা পড়ায় মনোযোগি হই এবং আমাদের মেধা শক্তি বৃদ্ধি পায়।
আমি ভাইদের মধ্যে বড় হওয়ায় আমাকে আলাদা ভাবে একটু বেশী আদর করতো বাবা। তাই প্রায়ই বাবা রাতের বেলা দুধ-কলা-আম দিয়ে ভাত খাওয়ার সময় আমাকে নিয়ে তার সাথে একই প্লেটে ভাত খেতো। আমিও অপক্ষায় থাকতাম যেদিন বাবা বাসায় বড় বড় সাগর কলা বা ফজলী আম নিয়ে আসতো সেদিন নিশ্চিত হোতাম বাবা আমাকে রাতে তার প্লেটে একসাথে দুধ ভাত খেতে বলবে।
বাবা আমাদের সবাইকে পড়াশোনার জন্য খুব শাসনে রাখতেন। তাই খুব ভয়ও পেতাম তাকে। একবার ক্লাস সেভেনে পড়া অবস্থায় স্কুল পালিয়ে বন্ধুদের নিয়ে সিনেমা দেখার কারণে বাবা খুব মেরেছিলো আমাকে। শহরের মুন্সিবাজার মহল্লার কাকলী সিনেমা হলে তৎকালে শিশুতোষ ছবি ‘শাহাজাদা’ নামে একটি সিনেমা চলছিলো। প্রচন্ড ভীর থাকায় ছবিটি প্রতিদিন ৫ শো করে চলছিলো। আমরা ৪ বন্ধু মিলে স্কুল পালিয়ে একদিন মর্নিং শো অর্থাৎ সকাল সাড়ে ১০ টার শো দেখতে যাই। এদিকে বাবা বিষয়টি কার কাছ থেকে যেনো খবর পেয়ে বেলা সাড়ে ১২ টায় সিনেমা শো শেষ হওয়ার সময় হলের সামনে গিয়ে দাড়িয়ে থাকে। সেখান থেকে আমাকে হাতেনাতে ধরে বাসায় নিয়ে ভিষন মারে।
মার খেয়ে আমার জ্যাঠার বাসায় রাত পর্যন্ত অভিমান করে কিছু না খেয়ে পালিয়ে ছিলাম। আমার জ্যাঠি অনেক চেষ্টা করেও আমাকে খাওয়াতে পারেনি। পরে রাতে মাকে খবর দিলে মা আমাকে নিতে আসে। মার অনেক পিড়াপিড়িতে এক সময় বাসায় যাই। গিয়ে শুনি বাবাও সরাদিন এবং রাত পর্যন্ত কিছু না খেয়ে আমার জন্য বসে আছে দুধ ভাত নিয়ে। তখন আমার যত কষ্ট, মান-অভিমান সব ভুলে হাত ধূয়ে বাবার সাথে দুধ-কলা দিয়ে ভাত খেতে বসি।
বাবার সাথে অসংখ্যা স্মৃতির মধ্যে এ স্মৃতিটা আমায় আজো কাঁদায়। বাবা যতই শাসন করুক না কেন তার সেই শাসনের আড়ালে মধুর ভালোবাসা লুকিয়ে থাকতো। আমার বাবার সে মধুর ভালোবাসার কথা মনে হলে মনটা ঢুকড়ে উঠে আজও।
তাই বাবার সে মধুময় ভালোবাসার পরশ নিতে বাবার রেখে যাওয়া সেই স্মৃতিময় কাঁসার প্লেটটিতে আজও আমি ভাত খাই। যখন ভাত খাই, বিশেষ করে দুধ-কলা বা দুধ-আম দিয়ে ভাত খাই তখন অনুভবে বাবাকে পাশে পাই। মনে হয় এইতো বাবার সাথে ভাত খাচ্ছি।