ইফতেখার জাহান বৃষ্টি
‘বাবা’ পৃথিবীতে সবচেয়ে পরিচিত, সবচেয়ে সহজ এবং সবচেয়ে কাছের আবেগঘন একটি শব্দ। কিন্তু আমার কাছে ‘বাবা’ শব্দটি সবচেয়ে অপরিচিত, সবচেয়ে দূরূহ আর বহু দূরের একটি শব্দ।
সবার কাছে বাবা মানে- যখন হস্যজ্জল চিরসুখী-রঙিন একটি মুখ, তখন আমার কাছে- বাবা মানে ফ্রেমে বাঁধানো মলিন কিছু ছবি। যখন বাবা রূপকথার রাজা কিংবা নিজের জীবনের প্রথম সুপারম্যান, তখন আমার কাছে- বাবা মানে সাদা ক্যানভাসে আঁকা কালো কালির চির নির্জিব একটি প্রতিচ্ছবি।
যখন বাবা মানে- তার আঙ্গুল ধরে অচেনা পৃথিবীকে দেখা আর হাজারও রকমের বায়না ধরা, তখন আমার কাছে- বাবা মানে শুধুই শূন্যতা। যখন বাবা মানে- হাজারও স্মৃতি আর বন্ধুদের সাথে তাঁকে নিয়ে বুকভরা গল্প, তখন আমার কাছে- বাবা মানে মা’র কাছে শোনা অল্প কিছু কথা। যখন বাবা মানে- সব মেয়ের আকুতি ‘বাবা সারাজীবন থেকো আমার পাশে’ তখন, আমার পাশে চেয়ে দেখি কেউ নেই। আমাকে ফাঁকি দিয়ে বহু বছর আগেই না ফেরার দেশে চলে গেছে। যখন ‘মৃত্যু’ বা মানুষ মরে যাওয়ার মানে কী আমি বুঝতামই না।
নিজেকে খুব শক্ত মনের প্রমানিত করার জন্য আমার এই হাহাকারগুলো আমার রুমের কিছু জড়বস্তুর জিনিসগুলোর মতো কখনও কাউকে বুঝতে দেইনি। হৃদয়ের বাঁধভাঙ্গা চিৎকারকে কখনও কারও কান অবধি পৌঁছাতে দেইনি। তবুও সেই একটি শব্দ বার বার আমাকে আঘাত করে বলে যে, ‘তোর বাবা নেই, তোর আবদার জানানোর কেউ নেই, কারণে অকারণে করা অভিমান ভাঙানোর কেউ নেই।’
এই নি:সঙ্গতা, হাহাকার আর না পাওয়ার কষ্টটা সৃষ্টিকর্তা পর্যন্ত ঠিক পৌঁছাতে পেরেছিল। তাইতো বাবা মারা যাওয়ার ১৫ বছর পর আবারও আমি আমার বাবাকে ফিরে পেয়েছি। পার্থক্য শুধু এই টুকুই-তাঁর রক্ত আমার ধমণী-শিরায় বইছে না, তার জিন আমার ‘ডিএনএ’তে নেই। হয়তো তাকে কখনও বাবা বলেও ডাকা হবে না। কিন্তু আমাদের সম্পর্কটা হাজারটা বাবা মেয়ের সম্পর্কের চেয়েও বেশি গভীর।
আমার জন্মদাতা বাবা ডাক্তার হওয়ার স্বপ্নের বীজ বুনে ছিলেন আমার মাঝে। আর আমার এই বাবা সেই অঙ্কুরিত বীজের গোড়ায় পানি ঢেলে ডালপালা মেলতে সাহায্য করেছেন। এখন আর নিজেকে নি:সঙ্গ লাগে না। জীবনের পথে চলতে চলতে যখন থমকে দাড়াই তখন দেখি পাশে দাড়িয়ে আছেন তিনি। আমার না পাওয়ার মেঘে ঢাকা কালো আকাশে লাল সূর্য হয়ে দেখা দিয়েছেন তিনি। আর আমি জানি, সেই আলোই সারাজীবন আলোকিত রাখবেন আমায়।
এখন নিজেকে সবচেয়ে ভাগ্যবান বলে মনে হয় আমাকে। কারণ আমি দু’জন বাবার মেয়ে। একজন যে জন্ম দিয়েছিলেন, আর অন্যজন যে বন্ধুর মত পাশে আছেন। আল্লাহ তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
ইফতেখার জাহান বৃষ্টি
প্রথম বর্ষ, জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ, বগুড়া।