:ডা. মো. শহীদুল্লাহ সিকদার:
আনন্দঘন ধর্মীয় অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এক মাসের সিয়াম সাধনার সমাপনী উদযাপনই ঈদুল ফিতর। ইসলাম শান্তির ধর্ম। সত্য, সুন্দর, ত্যাগ, ন্যায় ও কল্যাণের অলঙ্কার। দীর্ঘ এক মাস দিনের বেলায় পানাহার থেকে বিরত থেকে সংযম ও ত্যাগের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে মানুষ ঈদের দিনে আনন্দ উদযাপনে মিলিত হয় নির্মোহ এক সমর্পিত হৃদয়ে। এ আনন্দানুষ্ঠানে ধনী-গরিব সবাই সমান। ঈদের মাঠ সবার জন্য অবারিত। কিন্তু সবার অংশগ্রহণের শক্তির বিবেচনায় অনেক অসঙ্গতি পরিলক্ষিত হয়। ইসলাম মানেই শান্তি। আর এ শান্তির ধর্মের যে অনুষ্ঠান, সেটিও শান্তিময় হবে এটিই স্বাভাবিক। কিন্তু শান্তি সবার জন্য একইভাবে দৃশ্যমান হয় না। বৈষম্যমূলক সমাজে যারা সুবিধাজনক রাষ্ট্রীয় বা সামাজিক অবস্থানগত কারণে সহজেই বিনোদনের উপকরণ লাভ করেন, তারাই সহজে শান্তির বার্তা পান। অন্যদিকে আর্থসামাজিক বৈষম্যের শিকার সব মানুষ ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী অবারিত শান্তির দ্বারটিও অনায়াসে খুলতে সক্ষম হয় না।
মানুষ সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকে এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে ও নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াইয়ে সদা ব্যাপৃত। কারণ পৃথিবীতে বসবাসকারী প্রাণীকুলের মধ্যে নিরীহ ও শান্তিপ্রিয় জাতি হলো মানুষ। অনেক ভয়াবহ ও হিংস্র প্রাণী পৃথিবীতে বসবাস করে যারা শারীরিক শক্তির বিবেচনায় মানুষের চেয়ে ওপরের সারিতে অবস্থান করে। অন্য প্রাণীকুলের জীবন পার হয় বেঁচে থাকার জন্য খাদ্য সংগ্রহ, ভক্ষণ ও বিশ্রামের মাধ্যমে। সৃষ্টিগতভাবে মানুষ ছাড়া অন্য কোনো প্রাণী বিবেক, বিবেচনা, বুদ্ধি, জ্ঞান, চিন্তা, চেতনা, দক্ষতা দ্বারা তাড়িত নয়। এই গুণাবলি শুধু আশরাফুল মাখলুকাত মানুষের মধ্যেই বিদ্যমান। মানুষের এই উত্তম বৈশিষ্ট্যের কারণে মানুষ জাতিগতভাবে আজ পুরো পৃথিবীতে তার পদচারণা নিশ্চিত করেছে। মানুষ তার স্বকীয় সত্তাকে কাজে লাগিয়ে আজ উত্তরোত্তর উন্নতি করে যাচ্ছে। মানবসভ্যতার এই বিকাশের ক্ষেত্রে মানুষের নিরলস প্রচেষ্টা ও সময় দিতে হয়েছে অনেক। মানুষ পৃথিবীকে বসবাসের উপযোগী করতে নিজের সময়ের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করে যাচ্ছে। ফলে মানুষের অবকাশযাপনের সময় খুবই স্বল্প।
মানুষকে মানুষের এই উত্তম গুণাবলির চর্চা সঠিকভাবে সম্পন্নকরণের লক্ষ্যে ধর্মীয় অনুশাসনের ব্যবস্থা রয়েছে। ধর্মের নিয়ম-নীতি, অনুশাসন মানুষকে মানুষ হিসেবে গড়ে তোলে। ধর্মের কৃষ্টি-কালচার, আচার-আচরণ, ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলো মানুষকে নিয়মের মধ্যে থেকে আনন্দ উদযাপনের পথ করে দেয়Ñ যার মাধ্যমে মানুষ কর্মব্যস্ত জীবনের মধ্যেও ধর্মীয় অনুশাসনের মধ্য দিয়ে জীবনের কিছু আনন্দঘন সুন্দর মুহূর্ত কাটাতে পারে। কর্মব্যস্ত জীবনের গতানুগতিকতায় একটু বিরতি ও জীবনের একঘেয়েমিতা কাটাতে মাঝে মধ্যে উৎসবের প্রয়োজন অপরিহার্য। উৎসব শুধু যে দেহ-মনে প্রশান্তি এনে দেয়, তা নয়; উৎসবের মাধ্যমে সামাজিক বন্ধনগুলো দৃঢ় হয়। মানুষের আত্মীয়তার বন্ধন ও সামাজিক সম্পর্কগুলো সজীব এবং প্রাণবন্ত করতে প্রয়োজন হয় কোনো উপলক্ষের দ্বারা আপন ও পরিচিত সব মানুষের সম্মিলনের একটি সুযোগ বের করা যার মাধ্যমে মানুষ চলমান একঘেয়ে জীবনের সংকীর্ণ গণ্ডি পেরিয়ে আত্মীয়তা, বন্ধুত্ব এবং ভালোবাসার মুক্ত-নির্মল বাতাসে বুকভরে নিজেকে ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে তুলে সামাজিক কল্যাণকর মানসিকতায় উদ্বুদ্ধ করে। নিজেকে নতুন শক্তিতে উজ্জীবিত করে মানবকল্যাণে শক্তি জোগাতে পারে। পৃথিবীজুড়ে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী জাতি-সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে বিভিন্ন উৎসবের প্রচলন আছে। উৎসব উদযাপন জাতিগত ঐক্যের চেতনা সৃষ্টি করে এবং জাতিগত স্বতন্ত্র ও পৃথক পরিচয়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন এবং প্রতীক বহন করে। একটি জাতির স্বতন্ত্র পরিচয়সত্তা ফুটিয়ে তুলতে ঐক্য, মৈত্রী ও ভ্রাতৃত্বের চেতনা জাগ্রত করতে সম্মিলিত আনন্দ এবং উদযাপন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
আজকের দিনে আমাদের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, এমনকি বৈশ্বিক বিভিন্ন প্রেক্ষাপট ঈদের আনন্দের প্রকৃত অর্থ অনুধাবনে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। সামাজিক বিভিন্ন সংকট যেমনÑ সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, সাম্প্রদায়িক বিভেদ, সমাজের শ্রেণিবিভাগের বৈষম্য, লিঙ্গবৈষম্যসহ নানাবিধ সংকট আমাদের মধ্যে বিভেদ তৈরি করছে। সম্মিলিত আনন্দ উদযাপনের ধর্মীয় শিক্ষা উপেক্ষিত হচ্ছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা দেশের সার্বিক পরিস্থিতিকে প্রভাবিত করছে। ফলে মানুষ দলমত, নির্বিশেষে ধর্মীয় উদযাপনে মিলিত হতে পারছে না। অসম অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতায় মানুষ আজ দিশাহারা হয়ে পড়েছে। এই অসম প্রতিযোগিতায় সমাজের একশ্রেণির মানুষ লাভবান হচ্ছে, ধনাঢ্য হচ্ছে সুযোগসন্ধানী মহল। আর সমাজের বড় অংশের মানুষ দারিদ্র্যের করালগ্রাসের শিকার হচ্ছে, সৃষ্টি হচ্ছে শ্রেণিবৈষম্যের। পুঁজিবাদী একটি চক্র মানুষকে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির অমানবিক জাঁতাকলে নিষ্পেষিত করছে। তা মানুষকে তার মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করে আসছে দীর্ঘ সময় ধরে। মানুষ ঈদের আনন্দকে ভাগাভাগি করতে নিজের জন্য; মা-বাবা, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন আপনজনের জন্য; পাড়া-প্রতিবেশী, দরিদ্র-অসহায় মানুষের জন্য কিছু উপহার কেনা এবং তাদের খাদ্যদ্রব্যের মাধ্যমে আপ্যায়নের উদ্দেশ্যে সারাবছরের উপার্জনের কিছু অংশ গচ্ছিত রাখে। কিন্তু দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে মানুষের উপার্জন না বৃদ্ধির কারণে ঈদের জন্য গচ্ছিত অংশের অর্থ দিয়ে এখন মা-বাবা, ভাই-বোনের জন্য উপহার কেনার পর অনেক সময় নিজের জন্য কিছু কেনার সুযোগ থাকে না। আর আত্মীয়স্বজন, আপনজন, পাড়া-প্রতিবেশী, দরিদ্র-অসহায় মানুষের জন্য কিছু কেনার আকাক্সক্ষা এখন স্বপ্নে পরিণত হচ্ছে। ফলে মানুষ ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও অপারগ হয়ে অনেকের ঈদের খুশি, অনন্দের ব্যবস্থা করতে পারছে না। সমাজের সামর্থ্যবান লোকজনের উপহার ও আপ্যায়নে আনন্দের ভাগীদার হয় সমাজের নিঃস্ব, হতদরিদ্র, অসহায় মানুষ। কিন্তু অর্থনৈতিক সংকট এখানে বাদ সেধেছে। একই সঙ্গে বর্তমানের উত্তাল বৈশ্বিক পরিস্থিতি আজ আমাদের আরও এক বড় সংকটের মুখোমুখি করেছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও বিভিন্ন দেশে দীর্ঘ সময় ধরে চলমান ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র যুদ্ধ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামার প্রভাব বিশ্বজুড়ে আজ এক মহাসংকট তৈরি করেছে। তা প্রতিটি দেশের অর্থনীতি ও ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতিকে এক অস্থিতিশীল অবস্থায় দাঁড় করিয়েছে। এই সংকট কাটিয়ে উঠতে না পারলে, এ যুদ্ধের উত্তাপ প্রশমিত করতে না পারলে সম্মিলিত আনন্দ ও শান্তিময় পরিস্থিতি কখনই সম্ভব নয়।
ঈদের তাৎপর্য ও নিগূঢ় অর্থ শুধু ঈদের নামাজের আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এক মাস সিয়াম সাধনা শেষ হওয়ার পরের প্রভাতে নিজেদের ঈদের নামাজের জন্য প্রস্তুত করে ঈদগাহে গিয়ে নামাজ আদায় আমাদের মনে প্রশান্তি দান করে। তবে শুধু এর মধ্যেই ঈদের গুরুত্ব সীমাবদ্ধ নয়। ঈদের অনুষ্ঠানিকতা পালন করার মাধ্যমে, ঈদের আনন্দে সবাইকে শামিল করার মাধ্যমে, ঈদের প্রকৃত মর্মবাণী সবার মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যমেই সমাজের সব শ্রেণির মানুষকে নিয়ে সম্মিলিতভাবে নির্মল, নির্মোহ, শুদ্ধ, পরিচ্ছন্ন এক প্রশান্তির পরিবেশ তৈরি করে সবাই মিলে আনন্দ উপভোগ করার মধ্যেই ঈদের প্রকৃত মর্মার্থ নিহিত।
মাহে রমজানের এক মাস সিয়াম সাধনার মাধ্যমে নিজের অতীত জীবনের পাপ-পঙ্কিলতা থেকে ক্ষমা চাওয়ার মাধ্যমে এবং সামনের সময়ে এই চর্চা চলমান রাখার সংকল্পের পবিত্র অনুভূতি ধারণ করে ঈদের খুশি পরিপূর্ণতা লাভ করে। আর আনন্দ ও পুণ্যের অনুভূতিই জগতে এমন এক দুর্লভ বিষয় যা ভাগাভাগি করলে ক্রমেই বৃদ্ধি পায়। রোজা ভাঙার আনন্দ বা ঈদের উৎসব মনে এমন এক পরিচ্ছন্ন আনন্দ অনুভূতি জাগ্রত করে যা মানবিক মূল্যবোধ সমুন্নত করে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্যলাভের পথপরিক্রমায় চলতে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের উদ্বুদ্ধ করে। প্রকৃতপক্ষে ঈদ দরিদ্র, সুখী-অসুখী, আবালবৃদ্ধবনিতাসহ সব শ্রেণির মানুষের জন্য কোনো না কোনোভাবে নিয়ে আসে নির্মল আনন্দের বার্তা। ঈদ সর্বস্তরের মানুষকে এককাতারে শামিল করে ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ ও ঐক্যবদ্ধ করার সুযোগ তৈরি করে এবং আমাদের ত্যাগের মহিমায় উদ্দীপ্ত করে। এবারের ঈদ সংকট কাটিয়ে সবার জন্য ভালোবাসা, সম্প্রীতি, সম্ভাবনা ও সমৃদ্ধির বার্তা নিয়ে আসবে বলে প্রত্যাশা করি।
লেখক:-অধ্যাপক ডা. মো. শহীদুল্লাহ সিকদার : সাবেক উপ-উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়