:রায়হান আহমেদ:
ভৌগোলিকভাবে ভূতাত্ত্বিক গঠনে বাংলাদেশ একটি বদ্বীপ অঞ্চল। বদ্বীপ অঞ্চল গ্যাসসম্পদে বিপুলভাবে সমৃদ্ধ হওয়ার কথা অন্তত বিশ্বের অন্যান্য বদ্বীপ অঞ্চলকে বিবেচনায় নিলে। আন্তর্জাতিক গ্যাস জরিপ প্রতিষ্ঠানগুলোর মূল্যায়নেও একই মত প্রকাশিত হয়। বাংলাদেশে যথেষ্ট মাত্রায় গ্যাস অনুসন্ধান না হওয়ার কারণে গ্যাসসংকট তৈরি হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে গ্যাসসম্পদের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্বের সর্বাপেক্ষা কম অনুসন্ধানকৃত দেশগুলোর একটি। যথেষ্ট অনুসন্ধানের মাধ্যমে ভূগর্ভে লুকায়িত গ্যাস উত্তোলন করলে সংকট থাকবে না। বিদ্যুৎ উৎপাদনের অন্যতম প্রধান উপাদান জ্বালানি। দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের যথেষ্ট সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও প্রয়োজনীয় জ্বালানির অভাবে অধিক পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায় না। তবুও উৎপাদিত বিদ্যুতের বেশিরভাগ নির্ভর করে আমদানি করা জ্বালানির ওপরÑ যার পরিমাণ ক্রমাগতভাবে বেড়ে চলেছে। সম্প্রতি বিভিন্ন গণমাধ্যমে জ্বালানি সংকটের পাশাপাশি দেশে ডলার ও রিজার্ভ সংকটের কথা শোনা যাচ্ছে। কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, আমদানি-রপ্তানিবাণিজ্যের ভারসাম্য সংকটসহ বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প বা মেগাপ্রকল্পে নেওয়া বৈদেশিক ঋণের কিস্তি ডলারে পরিশোধের কারণে রিজার্ভে চাপ তৈরি হচ্ছে।
গত অর্থবছরে দেশে মোট ৯০ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছে। অন্যদিকে রপ্তানি ৫০ বিলিয়ন ডলার ছাড়ালেও বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ঘাটতির পরিমাণ ৪০ বিলিয়ন। এ পার্থক্য সামনে আরও বড় হবে বৈদেশিক ঋণের সুদ ও কিস্তি পরিশোধের কারণে। বলা বাহুল্য, দেশের অর্থনীতি কিছুটা সংকটকাল অতিক্রম করছে। ধারণা করা যায়, খুব শিগগিরই এ সংকট কাটবে না। বর্তমানে দেশের অর্থনীতির নানা প্রতিকূলতার মধ্যে রিজার্ভ সংকট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। রিজার্ভ সংকটের কারণে দেশে ডলারের বিপরীতে টাকার মান প্রতিনিয়ত কমছে। বাংলাদেশে গত কয়েক বছরে একাধিক গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কারের ঘোষণা এলেও দেশটিতে গ্যাসের সংকট তাতে কমেনি, বরং আরও বেড়েছে; এমনকি বিদেশ থেকে এলএনজি আমদানি করেও সংকট সামলানো যাচ্ছে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অতীতে জ্বালানি নিয়ে সরকারের নেওয়া ভুল নীতির কারণেই এখন গ্যাস নিয়ে এ সংকটের মুখোমুখি হতে হয়েছে।
আশির দশকে যখন অনেক গ্যাসক্ষেত্র পাওয়া গেলÑ তখন এমন অবস্থা ছিল যে, আপনার অনেক গ্যাস আছে। তবে চাহিদা ততটা নেই। ফলে এর পর আর গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধানে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। যে গ্যাসক্ষেত্রগুলো আবিষ্কার হয়েছে, সেগুলো হয়তো বিশাল বড় নয়। কিন্তু সম্মিলিতভাবে সেটির আকার ভালো। এগুলোর উন্নয়ন করার জন্য যেসব পদক্ষেপ নেওয়া উচিত, সেটি নেওয়া হচ্ছে না। কারণ কর্তৃপক্ষের হয়তো ধারণা তৈরি হয়েছেÑ বাংলাদেশে বুঝি গ্যাস আর নেই, শেষ হয়ে গেছে। এ জন্যই গ্যাস উত্তোলন ও আহরণের জন্য যে চেষ্টা বা আগ্রহ থাকা উচিত ছিল, সেটি আমরা দেখতে পাচ্ছি না। এর চেয়ে আমদানির ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এ কারণে দেশীয় গ্যাসের আবিষ্কার ও উত্তোলন পিছিয়ে পড়েছে। বিশ্বে জ্বালানি সংকট মোকাবিলায় উন্নত দেশগুলোও সাশ্রয়ী দামে বিদ্যুৎসেবা দেওয়ার জন্য রেশনিংয়ের ব্যবস্থা করছে। তাই বৈশ্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় আমাদের অবস্থাও খারাপ। কেননা আমাদের যে নিজস্ব গ্যাস দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়, তা চাহিদার অর্ধেকের চেয়ে কম। বাকিটা বেশিরভাগ উৎপাদন হয় জ্বালানি তেল ও কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎপ্লান্টের মাধ্যমে। এখন যদি বিদ্যুতের চাহিদা পূরণ করতে এলএনজি এবং জ্বালানি তেল আমদানি করতে হয়, তা হলে উৎপাদন খরচ তিন-চারগুণ বেড়ে যাবে।
বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের ঘাটতিকে আমাদের গ্রহণযোগ্য হিসাবের খাতায় আনতে হবে। কেন রিজার্ভে টান? আর কেনই বা লোডশেডিং? অথবা এটি কি আমাদের কোনো অদূরদর্শিতার ফল? মেগাপ্রজেক্ট কি আমাদের অর্থনীতির জন্য বড় ঋণের ফাঁদ, না সহায়ক এবং সর্বোপরি আমাদের বাজেট ও পরিকল্পনা কতটা সঙ্গতিপূর্ণÑ এ জাতীয় বিষয়গুলোকে বিবেচনায় এনে সংকট নিরসনে সরকারকে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে।