তথ্যপ্রযুক্তি, জ্ঞানবিজ্ঞান ও উদ্ভাবনীতে তীব্র গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে বিশ্ব। প্রতিযোগিতাময় বর্তমান যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে নানাভাবে নিজেদের প্রস্তুত করে জীবনযুদ্ধে নামছে বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ। এরই পরিপ্রেক্ষিতে স্কুল থেকেই শুরু হয়ে যায় শিক্ষার্থীদের জীবনযুদ্ধ। শুরু থেকেই তাদের মস্তিষ্কে এমন কিছু তথ্য দেওয়া হয়, যাতে সে জ্ঞানার্জনের জন্য নয় বরং পড়াশোনা করার একমাত্র উদ্দেশ্য একটি ভালো সার্টিফিকেট ও চাকরি। বর্তমানে আমরা এমন একটি সময়ে অবস্থান করছি, যেন শিক্ষাব্যবস্থার মূল উদ্দেশ্য সরকারি চাকরি। কোন ধরনের শিক্ষা গ্রহণ করলে চাকরির বাজারে অধিক মূল্যায়িত হবে, শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে অবিভাবকদেরও ধ্যানজ্ঞান সেদিকেই। দক্ষতা অর্জনের চেয়ে সার্টিফিকেট ও ভালো রেজাল্টের প্রতি ঝোঁক সবার। আসলে বাস্তবিক দিক থেকে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এমন চিত্রই স্বাভাবিক।
প্রতি বছর হাজার হাজার শিক্ষার্থী সর্বোচ্চ ফলাফল নিয়ে ছাত্রজীবন পাড়ি দেয় অথচ চাকরির বাজারে দেখা যায় যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও কর্মসংস্থানের অভাব অপ্রতুল। ছোট থেকেই আমরা চাকরি পাওয়ার জন্য কীভাবে কী করতে হবে, করে আসছি; তার পরও চাকরির সময়টাতে এসে আমাদের মধ্যে কেন এমন অসহায়ত্ব ও হতাশা? পরীক্ষায় ভালো ফলাফলকারী অনেকেই মেধাবী, এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু আমাদের দেশে যে প্রক্রিয়ায় মেধা যাচাই করা হয়, তা সঠিক নয়। শিক্ষা এবং প্রকৃত শিক্ষার মধ্যে যেমন পার্থক্য আছে, ঠিক তেমনি মেধাবী ও প্রকৃত মেধাবী শব্দের মধ্যেও গুণগত পার্থক্য আছে।
উচ্চশিক্ষা এমন একটি স্তর, যা প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তর থেকে স্বতন্ত্র। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাকে মাধ্যমিক শিক্ষার অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হলেও বর্তমানে তা উচ্চশিক্ষার অংশ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে, যা পরবর্তী সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নের যোগ্যতা অর্জনে সহায়ক ভূমিকা রাখে। কারণ সুশীল সমাজ গঠন, রাষ্ট্র পরিচালনা এবং বিভিন্ন পেশায় দক্ষ নেতা সৃষ্টিকরণে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো সহায়ক ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কাজেই উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহকে অবশ্যই সার্বিক বিষয়ে প্রদত্ত শিক্ষার মান সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। আধুনিক ও প্রগতিশীল চিন্তার মাধ্যমে উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থাকে অবশ্যই অনেকগুলো বিশেষ বিশেষ ধারায় উপযোগী করে গড়ে তুলতে হবে।
বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় স্নাতকে বিভিন্ন বিষয়ে পড়াশোনা শেষ করে গতানুগতিক সেই সাধারণ জ্ঞান, বাংলা ইংরেজি পড়েই বিভিন্ন সরকারি চাকরি পেতে হচ্ছে। তাহলে একাডেমিক পড়াশোনার প্রয়োজনীয়তা কোথায়! এমন ব্যবস্থার জন্য শিক্ষার্থীরা একাডেমিক পড়াশোনার চেয়ে চাকরির পড়াশোনাতে বেশি আগ্রহ দেখায়। ফলে একাডেমিক শিক্ষায় যথেষ্ট ঘাটতি থেকে যায়। আমাদের দেশে অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী রয়েছে। কিন্তু শিক্ষাব্যবস্থা ও এর যথাযথ প্রয়োগের অভাবে বেকারত্বের হতাশায় ডুব দিতে বাধ্য হয়। গতানুগতিক এই ধারা অবলম্বন করতে প্রতিনিয়ত হাজার হাজার মেধাবীদের উদ্ভাবনী শক্তির অপমৃত্যু হচ্ছে। আমাদের সবার মানসিকতা এমন পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে যে, একমাত্র সরকারি চাকরি পেলেই সে প্রতিষ্ঠিত, নচেত্ জীবন অর্থহীন। এমন চিন্তাধারাই আমাদের তরুণ সমাজের বেকারত্বের প্রধান আরেকটি কারণ। যুগ পরিবর্তন হচ্ছে। দেশও প্রযুক্তির সঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছে। সবকিছুরই উন্নতি হচ্ছে, শুধু উন্নতি হচ্ছে না আমাদের মানসিকতার। যত সময় যাচ্ছে, আমরা মানসিকভাবে ততই পিছিয়ে যাচ্ছি।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট হওয়া উচিত, আপনি কী চান তা বাচ্চার ওপর চাপিয়ে না দিয়ে, বরং সে কী চায়, কোন বিষয়টি পড়তে সে বেশি পছন্দ বা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে, সে বিষয়ে অবিভাবকদের অধিক গুরুত্ব দেওয়া। কেউ গাইতে পছন্দ করে, কেউ আঁকতে পছন্দ করে, কেউ নাচতে পছন্দ করে, কেউ সোশ্যাল ওয়ার্ক করতে ভালোবাসে, কেউ ব্যবসায়ী হতে চায়, কেউ উদ্যোক্তা হতে চায়, কেউ কৃষিকাজ করতে চায়, অনেকে খেলাধুলায় পারদর্শী, আবার কেউ পড়াশোনা করতে ভালোবাসে। যার যেদিকে আগ্রহ আছে, তাকে যদি সে বিষয়ে উত্সাহ ও পারিবারিক সাপোর্ট দেওয়া হতো, তাহলে নিজের পছন্দের কাজ গুছিয়ে ও ভালোবেসে করত। এতে আত্মতৃপ্তি হতো, পাশাপাশি সফলতাও আসত। পারিবারিক সাপোর্ট থাকলে পছন্দের কাজ করে কীভাবে ক্যারিয়ার গড়ে তুলতে হবে, সে নিজেই ব্যবস্থা করে নিতে পারত। এভাবে যদি সবাই ভিন্নধর্মী কাজে সাপোর্ট দিত, তাহলে দেশে হয়তো এত হতাশাগ্রস্ত বেকারদের রাস্তায় রাস্তায় ফাইল হাতে ঘুরতে হতো না।
আমরা জোর করে মেধাবী বানাতে চাই, আর উন্নত দেশগুলো মেধাবীদের বাছাই করে গবেষক বানায়। এখানেই আমাদের সঙ্গে তাদের ঢের পার্থক্য। তারা মেধাকে সহজাত করে। জোরাজুরিতে শুধু পরীক্ষায় ভালো ফল আসে; কিন্তু এতে দেশ ও জাতি কোনোভাবেই উপকৃত হয় না। এই চাপিয়ে দেওয়ার জন্য অনেক প্রতিভাবান শিক্ষার্থীদের স্বপ্নের অপমৃত্যু হয়। এসব ক্ষেত্রে অবিভাবকরাই পারেন সমাজের বর্তমান চিত্র বদলে দিতে। শিশুদের সঙ্গে বন্ধুত্বশীল আচরণ করুন, তাদের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনুন। খেলাধুলা ও সৃজনশীল কাজে উত্সাহ দিন। তারা যে বিষয়ে আগ্রহী সেটাকে কীভাবে পেশা হিসেবে নেওয়া যায়, তার দিকনির্দেশনা দিন। এতে যেমন দেশে বেকারত্ব হ্রাস পাবে, তেমনি তরুণদের মধ্যে যে হতাশা তাও শতভাগ লাঘব হবে। সেই সঙ্গে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার দিকেও সংশ্লিষ্টদের নজর দেওয়া উচিত। কিছুদিন পরপর নতুন সিদ্ধান্ত না চাপিয়ে কীভাবে তাদের সৃজনশীলতা ও তাদের মধ্যে লুকিয়ে থাকা প্রতিভাকে কাজে লাগানো যায়, তার ব্যবস্থা করতে হবে। তাদেরকে সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে। মেধা অনুযায়ী প্রাপ্য মর্যাদা ও স্বীকৃতি দিতে হবে।
লেখক : নওশিন তিতলী শিক্ষার্থী
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া