‘মোদের গরব, মোদের আশা, আ মরি বাংলা ভাষা’- সত্যিই বাংলা ভাষা আমাদের অহঙ্কার। বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করে মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা বাঙালি জাতির জন্য এক অনন্য দৃষ্টান্ত। পৃথিবীতে আর কোনো জাতিকে ভাষার জন্য এত বড় ত্যাগ স্বীকার করতে হয়নি। ভাষা যে একটি জাতির অস্তিত্বের প্রশ্ন, তা বাঙালি জাতি জীবন উৎসর্গ করে প্রমাণ করেছে। বর্তমান বিশ্বের সমৃদ্ধিশালী ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার অবস্থান চতুর্থ। বিশ্বের প্রায় ১০০ কোটি মানুষের মুখের ভাষা বাংলা। বাংলা সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাৎপর্যপূর্ণ বাংলা ভাষাকে ইউনেস্কো আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকৃত দিয়েছে। বিশে^র প্রত্যেক জাতিকে তার মাতৃভাষাকে সম্মান জানাতে শিখিয়েছে বাংলা ভাষা।
ভাষা গতিশীল। প্রতিনিয়ত ভাষায় যুক্ত হচ্ছে নানা বৈচিত্র্যতা। এই গতিশীল প্রক্রিয়ায় ভাষা যে সবসময় সঠিক পথে চালিত হচ্ছে, তা বলা যাবে না। ইতিবাচক বিষয়ের পাশাপাশি যুক্ত হচ্ছে নানা অসঙ্গতিসহ ভাষা বিকৃতির বিভিন্ন ধরন। রক্তে কেনা বাংলা ভাষার এই বিকৃতি আজ আমাদের লজ্জায় ফেলেছে। তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে ভাষাকে ব্যবহার করা হচ্ছে নানা আঙ্গিকে। গণমাধ্যম, সিনেমা, নাটকে বাংলা ভাষার প্রয়োগ নিয়ে রয়েছে বিতর্ক। বর্তমানে বাংলা ভাষা যেভাবে বিকৃৃত করা হচ্ছে, এতে মনে হয়- আমরা ভুলে গিয়েছি এই ভাষার নেপথ্যে আমাদের আন্দোলনের কথা। যে ভাষার জন্য আমাদের সূর্যসন্তান সালাম, রফিক, জব্বারসহ নাম না জানা অনেকে শহীদ হয়েছেন, ওই ভাষার বিকৃতি চলছে নগ্নভাবে। চমাস ডিয়ডিন বলেন, ‘মায়ের মুখের ভাষাকে আমি যেমন শ্রদ্ধা করি, তেমনি এর অশ্লীল প্রয়োগকেও মনে-প্রাণে ঘৃণা করি।’
গণমাধ্যম গণমানুষের কাছে পৌঁছে যায় খুব সহজেই। কিন্তু গণমাধ্যমে ভাষার ব্যবহার লক্ষণীয়। কিছু দায়িত্বহীন গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে বাংলা ভাষার ব্যবহার নিয়ে আপত্তি রয়েছে। শিশু-কিশোর যদি গণমাধ্যমের এই বিকৃত ভাষার প্রতি আকর্ষণবোধ করে, তা হলে এর পরিণতি হবে ভয়াবহ। গণমাধ্যমে যেমন আঞ্চলিক ভাষা চলে না, ঠিক তেমনি বিকৃত ভাষাও চলতে পারে না। ব্যক্তিগত সমস্যার জন্য উচ্চারণগত সমস্যা থাকতে পারে। কিন্তু ভাষা বিকৃতি অত্যন্ত বেদনাদায়ক ও লজ্জাজনক। টেলিভিশন চ্যানেলে প্রচারিত অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত ভাষা প্রায়ই না প্রমিত, না কোনো অঞ্চলের নির্দিষ্ট উপভাষা- তা বোঝার কোনো উপায় নেই। এসব অনুষ্ঠানের রচয়িতা ও কুশীলবরা যে ভাষা ব্যবহার করেন, তা দর্শকের বোধগম্য নয়। টিভি সিরিয়ালগুলোর মাধ্যমে বাংলা ভাষার বিকৃতি সবচেয়ে বেশি হচ্ছে। এতে বিশেষ অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষা বিদ্যমান। এসব আঞ্চলিক ভাষায় নাটক প্রচারিত হচ্ছে ও দর্শকপ্রিয়তা পাচ্ছে। তা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। কিন্তু বাংলা, ইংরেজি, আঞ্চলিকতা একসঙ্গে মিলিয়ে জগাখিচুড়ি ভাষার ব্যবহার সত্যিই দুঃখজনক। নাটকে আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহারের মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়াও শুদ্ধ ভাষাচর্চার অন্তরায়। বর্তমানে আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির আলোকে সবচেয়ে বহুল প্রচলিত সিরিয়ালগুলোয় এক অদ্ভুত ভাষা ব্যবহৃত হচ্ছে। তা বাংলা ভাষাভাষী মানুষের কাছে বোধগম্যহীন। নাটকের বিজ্ঞাপনে আটপৌরে ভাষার ব্যবহার টেলিভিশনের পর্দায় বড় কোম্পানিগুলোর অর্থায়নে যদি হতেই থাকে- তা হলে বাংলা ভাষার মান তো থাকবেই না, বরং ভাষার অস্তিত্ব নিয়েও টানাটানি হতে পারে।
এফএম রেডিও চ্যানেলগুলো বাংলা ভাষাকে যেমন ইচ্ছা, তেমনভাবে ব্যবহার করছে। সেখানে ভাষা ব্যবহারের ভয়াবহতা আমাদের নতুন করে ভাবিয়ে তোলে। কখনো ইংরেজি-বাংলা, কখনো হিন্দি- যে যেভাবে পারছেন বাংলা ভাষাকে টেনেহিঁচড়ে একাকার করে ফেলছেন। উচ্চারণের ক্ষেত্রে শোনা যায় নানা ধরনের ভঙ্গি। তা ভাষাকে প্রকৃত অর্থে ভিন্নপথে ধাবিত করছে। তরুণ প্রজন্ম আমাদের সবচেয়ে বড় শক্তি। সেই তরুণ প্রজন্মের ওপর সবচেয়ে প্রভাব ফেলে এসব বিষয়। এফএম রেডিও চ্যানেলগুলো এসব ভাষা অবলীলায় প্রয়োগ করছে। তা আমাদের জন্য কোনোভাবেই কল্যাণকর নয়। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ সড়ক-মহাসড়ক, বাজার, ফুটপাত, যানবাহন ও বিলবোর্ডগুলো বানানের ভুল প্রয়োগ ও বিকৃতিতে ছেয়ে গেছে। এদিকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং এফএম রেডিওগুলোয় ভাষার মাসেও বিকৃত উচ্চারণে কথা বলা বন্ধ হয়নি। এ সংক্রান্ত গবেষণাতেও ভাষা বিকৃতির ভয়াবহ চিত্রের প্রমাণ মিলেছে। দিনের পর দিন এমন ভুল বানান দৃশ্যমান হলেও এগুলো নজরদারি করার মতো কেউ নেই।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোয় বাংলা বানানের বিকৃতি ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করেছে। এখানে ভুলের চেয়ে বিকৃতিই বেশি। বাংলা-ইংরেজির মিশ্রণ, বাংলা শব্দের মনগড়া সংক্ষিপ্ত রূপ, নতুন শব্দ তৈরি ও ব্যবহার ইদানীং ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশে ফেসবুক ও ব্লগ এখন ব্যাপক জনপ্রিয়। অনেক দিন ধরেই ব্যবহার বাড়ছে ইউটিউবের, ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হচ্ছে টুইটারও। তবে এগুলোর কোনোটিই ফেসবুকের মতো জনপ্রিয় নয়। ফেসবুকে বাংলা লেখার ধরনও অদ্ভুত। শব্দের বিকৃত বানান ও উচ্চারণ। যেমন- বেসম্ভব (অসম্ভব), নাইচ (নাইস), কিন্যা (কিনে), গেসে (গেছে) ইত্যাদি। এ রকম অসংখ্য বিকৃত ব্যবহার চলছে সবসময়ই। বাংলা, হিন্দি, ইংরেজি মিলিয়ে বলা হচ্ছে মাগার, টাস্কিভূত ও ধিং সম্ভাবিলিটি, বিন্দাস। সবচেয়ে বড় ক্ষতিকর হচ্ছে ফেসবুকে অহরহ বাংলা ভাষাকে ইংরেজি অক্ষরে যে যার মতো করে মনগড়া শব্দ তৈরি করে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এখানে বাংলা শব্দ ও বাক্য গঠনে কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা করা হচ্ছে না। ফলে এভাবে বাংলা ভাষার চরম বিকৃতি ঘটছে।
ঢাকার বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষার্থীরা মৌখিকভাবে ব্যবহার করছে যে ভাষা না আঞ্চলিক, না প্রমিত। শুদ্ধ-অশুদ্ধের মিশেলে তা এক অন্যভাষা। যেমন- ‘এসেছ’, শিক্ষার্থীরা বলছে ‘আসছ’; ‘করেছিস’কে শিক্ষার্থীরা বলছে ‘করছেস’। এভাবে ‘তা হলে’কে ‘তাইলে’, ‘পাঁচটা’কে ‘পাসটা’, ‘কেন’কে ‘ক্যান’ ইত্যাদি। বর্তমানে তরুণসমাজ ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া যে ভাষা ব্যবহার করছে, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম ওই ভাষার নাম দিয়েছেন ‘বাংহিংলিশ’। তারা হিন্দি ও ইংলিশকে বাংলার সঙ্গে এমনভাবে মিশিয়ে কথা বলছে- যেন ভাষার নতুন একটি রূপ তৈরি হয়েছে।
২০১৪ সালের জুনে আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী সরকারি-বেসরকারি টেলিভিশন ও বেতারে বাংলা ভাষার বিকৃতি রোধে একটি কমিটি গঠন করে সরকার। দশ সদস্যের এ স্থায়ী কমিটির প্রধান তথ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব। কমিটি সরকারি-বেসরকারি ইলেকট্রনিক গণমাধ্যম তথা সব টেলিভিশন চ্যানেল ও বেতারে সংবাদ, অনুষ্ঠান এবং উপস্থাপনায় বাংলার সঙ্গে অহেতুক অন্যান্য ভাষার মিশ্রণ পরিহার করা ও ভাষার বিকৃতি না করার বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার কার্যক্রম সমন্বয় করবে। এ ছাড়া টেলিভিশন চ্যানেল ও বেতারে ইংরেজি বিজ্ঞাপন এবং মিশ্রভাষার ব্যবহার বন্ধ করার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ, অগ্রগতি, পরিবীক্ষণ ও এ বিষয়ে অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় সাধন এবং বাংলা ভাষার দূষণ, বিকৃতি উচ্চারণ, বিদেশি ভাষার সুরে বাংলা উচ্চারণ রোধের বিষয়ে ব্যবস্থা নেবে। পরবর্তী সময়ে এ কমিটির কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে জানা যায়নি।
বর্তমান বাংলাদেশে ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে যে নৈরাজ্য ও বিকৃতি চলছে, এর গতিরোধ করতে না পারলে বাংলা ভাষা অবক্ষয়ের মধ্য দিয়ে অবলুপ্তির পথে চলে যাবে। ভাষাবিশেষজ্ঞদের মতে, পৃথিবীতে যত দাপুটে ভাষা আছে, এগুলোয় বানানের সুনির্দিষ্ট কোনো নিয়ম নেই। বাংলা বানানের ক্ষেত্রে নিয়ম রয়েছে। বাংলা একাডেমির প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম মেনে এ ধরনের ভুল সহজেই এড়ানো যায়। বিকৃত উচ্চারণে বাংলার সঙ্গে বিদেশি শব্দের মিশ্রণ করে কথা বলাটাকে অনেকে গৌরবের মনে করেন। এ ধরনের মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। যত্রতত্র বাংলা বানানে ভুল ভাষার জন্য অমর্যাদাকর। আমরা যে ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছি, ওই ভাষাকে অবদমিত করা ঠিক নয়। যারা বাংলা ভাষাকে নিজেদের মতো করে বিকৃতভাবে ব্যবহার করছেন, তারা ভাষার গুরুতর ক্ষতি করছেন।
আমাদের একটি বিষয় মনে রাখতে হবে, বিশ^দরবারে আমরা বাংলা ভাষার মাধ্যমেই পরিচিতি লাভ করেছি। কেবল তা নয়, বাংলাকে জাতিসংঘের ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কাজেই বাংলা ভাষাকে আরও সমৃদ্ধ করে তুলতে হলে আমাদের উচিত সবার সম্মিলিত প্রয়াসে বাংলা ভাষার বিকৃতি রোধ করা। যে জাতি তার দেশ ও ভাষাকে যত বেশি মর্যাদা দেবে, ওই দেশ তত বেশি উন্নত হবে। আমরা যেমন মাকে ভালোবাসি, তেমনি বাংলা ভাষাকে ভালোবাসি। তাই তো মায়ের ভাষাকে রক্ষা করতে গিয়ে জীবন দিতে পিছপা হয়নি বাঙালি জাতি। রফিক, সালাম, বরকত, জব্বারসহ অনেকে জীবন দিয়ে বাংলা ভাষা রক্ষা করেছেন। আমরা কেন পারব না বাংলা ভাষার সঠিক ব্যবহার ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত করতে। লর্ড চেস্টারফিল্ডের মতে, ‘ভাষা হচ্ছে মন্দিরের মতো- যেখানে আত্মা বিচরণ করে।’ বাংলা ভাষার বিকৃতি রোধে আমাদের সবাইকে সম্মিলিতভাবে এগিয়ে আসতে হবে।
(সৈয়দ ফারুক হোসেন : ডেপুটি রেজিস্ট্রার, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়)