জামালপুরের সরিষাবাড়ী উপজেলার পিংনা ইউনিয়নের ১১৪নং বালিয়া মেন্দা প্রকাশ মীরকুটিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ ওঠেছে। এক কক্ষবিশিষ্ট একমাত্র টিনশেট ঘরে গাঁদাগাদি করে প্রতিদিন ৬টি ক্লাশের পাঠদান ও বিদ্যালয়ের দাপ্তরিক কার্যক্রম চললেও উন্নয়ন বরাদ্দের সমস্ত টাকা পকেটস্থ করেন তিনি। ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক আব্দুল বারী সপ্তাহে ২-১দিন বিদ্যালয়ে এসে বাকি সময় পারিবারিক কাজে ব্যস্ত ও বিদ্যালয়ের সমস্ত খাতাপত্র নিজবাড়িতে রাখার অভিযোগও উঠেছে। এতে চরাঞ্চলের কোমলমতি শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষা ব্যাহত হচ্ছে।
জানা গেছে, উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৪০ কি.মি. দূরে পিংনা ইউনিয়নের দুর্গম চরাঞ্চলে যমুনা নদী বেষ্টিত ১১৪নং বালিয়া মেন্দা প্রকাশ মীরকুটিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি অবস্থিত। বিদ্যালয়ে শিক্ষকদের নিয়মিত বেতন-ভাতা, শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে বই ও উপবৃত্তিসহ সরকারি সকল সুযোগ-সুবিধা থাকা সত্ত্বেও ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দুর্নীতির কারনে প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে বলে এলাকাবাসী অভিযোগ করেন।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, এক কক্ষবিশিষ্ট একমাত্র টিনশেট ঘরে গাঁদাগাদি করে একসাথে তিনটি ক্লাশের পাঠদান চলছে। সকালে আরো তিনটি ক্লাশের পাঠদান শেষ করে শিক্ষার্থীদের ছুটি দেন শিক্ষকরা। একই কক্ষে রাখা হয়েছে বিদ্যালয়ের নির্মাণ সামগ্রী। এ সময় ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষককে বিদ্যালয়ে খোঁজে পাওয়া যায়নি। এ ব্যাপারে মোবাইলে প্রশ্ন করলে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক আব্দুল বারী জানান, ‘তিনি বিদ্যালয়ের কাজে উপজেলা শিক্ষা অফিসে আছেন।’ উপজেলা শিক্ষা অফিসে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তিনি সেখানে যাননি। এ ব্যাপারে সহকারী শিক্ষক ফজলার রহমান বলেন, ‘এভাবেই তিনি নানা অযুহাতে অধিকাংশ সময়ে অনুপস্থিত থাকেন। আর বিদ্যালয়ের সমস্ত কাগজপত্র তার বাড়িতে রাখায় ১০-১৫ দিন পর পর শিক্ষকদের হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর করতে হয়।’
শিক্ষার্থীদের হাজিরা খাতায় লিপিবদ্ধ সংখ্যা অনুযায়ী দেখা যায়, ৫ম শ্রেণিতে খাতায় আছে ২৬ জন উপস্থিত ১৪ জন, ৪র্থ শ্রেণিতে ৩৭ জনের মধ্যে ১৩ জন, ৩য় শ্রেণিতে ৩২ জনের মধ্যে ৬ জন, ২য় শ্রেণিতে ৩৭ জনের মধ্যে ৭ জন, ১ম শ্রেণিতে ৪৩ জনের মধ্যে ১৩ জন ও প্রাক প্রাথমিকে ১০ জনের মধ্যে মাত্র ১ জন শিক্ষার্থী উপস্থিত রয়েছে। এলাকাবাসীর অভিযোগ, দিন দিন শিক্ষার্থীর উপস্থিতি কমলেও ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের সেদিকে কোন নজর নেই।
এ ব্যাপারে বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি মো. বদিউজ্জামান অভিযোগ করেন, ‘ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক কমিটির কোন কথাই মানেন না। নিজের ইচ্ছামতো বিদ্যালয়ে আসেন, ইচ্ছামতো যান। বিদ্যালয়ে প্রতি বছর বিভিন্ন উন্নয়ন বরাদ্দ এলেও তার স্বাক্ষর জাল করে ব্যাংক থেকে উত্তোলন করে আত্মসাৎ করেন।’ তিনি আরো জানান, ‘চলতি বছরেও বিদ্যালয়ের অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য ৪০ হাজার টাকা স্লিপ বরাদ্দ হয়েছে। কিন্তু তা ব্যাংক থেকে উত্তোলন না করে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক আত্মসাতের চেষ্টা করছেন।’
সুত্র জানায়, বালিয়া মেন্দা প্রকাশ মীরকুটিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি ইতোপূর্বে ডাকাতিয়া মেন্দায় অবস্থিত ছিল। গভীর যমুনায় সেটি তলিয়ে যাওয়ায় ২০১০ সালে বিদ্যালয়টি বালিয়া মেন্দায় স্থানান্তর করা হয়। একই বছর প্রধান শিক্ষকের পদ শূন্য হওয়ায় সহকারী শিক্ষক আব্দুল বারীকে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এদিকে ২০১৪ সালে পিইডিপি-৩ প্রকল্প থেকে বিদ্যালয়ের একটি টিনশেট ঘর ও দু’টি বাথরুম নির্মাণ শুরু হয়। প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার আগেই ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক প্রকল্প থেকে উৎকোচ নেওয়ায় ঠিকাদার কাজ বন্ধ করে চলে যান। ঘরটির মাঝখানে কোন পার্টিশন ও দরজা-জালানা না থাকায় এবং বাথরুম ব্যবহার উপযোগী না হওয়ায় শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা দুর্ভোগে পড়েন। স্লিপ বরাদ্দের টাকা দিয়ে ক্লাশরুম গুলোর পার্টিশন নির্মাণ ও বাথরুম ব্যবহার উপযোগী করা সম্ভব হলেও ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক তা করছেন না বলে স্থানীয়দের অভিযোগ।
৫ম শ্রেণির শিক্ষার্থী রাফেজা আক্তার মলি, রাবেয়া আক্তার মনি ও শারমিন আক্তার মিম জানায়, ‘তাদের বিদ্যালয়ে কোন খেলাধুলার ব্যবস্থা নাই।’ স্থানীয় অভিভাবক সেলিম মুন্সি জানান, ‘৩য় শ্রেণিতে পড়–য়া তার ছেলে ইয়াহিয়া ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় ইউনিয়নে শ্রেষ্ঠ হওয়ার পরও ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক খরচের ভয়ে তাকে উপজেলা পর্যায়ের প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করাননি।’ অধিকাংশ অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, বিদ্যালয়ে উপস্থিতি বৃদ্ধি, পড়াশোনার মান বা মেধাবিকাশ নিয়ে মাথা ঘামান না ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক।’
সব অভিযোগ অস্বীকার করে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক আব্দুল বারী বলেন, ‘স্থানীয় কিছু লোক তার বিরুদ্ধে এগুলো অপপ্রচার করছে।’
এ ব্যাপারে উপজেলা শিক্ষা অফিসার মোহাম্মদ ফেরদৌস বলেন, ‘ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের বিভিন্ন অনিয়মের একটি লিখিত অভিযোগ পেয়েছি। তদন্তপূর্বক তার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।’