শান্তিতে-সমরে সবখানেই এখন অনন্য বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী। সার্বভৌমত্ব রক্ষা, উচ্চ পেশাদারিত্ব, সামাজিক-মানবিক নানা কর্মকাণ্ড এবং উন্নয়ন-অগ্রযাত্রায় দেশ ও জনগণের আস্থার প্রতীকে পরিণত হয়েছে সশস্ত্র বাহিনী (সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী)। কেবল নিজ দেশেই নয়, জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী হিসেবে হাজার হাজার মাইল দূরে গোলযোগপূর্ণ বিভিন্ন দেশে গিয়েও উচ্চ পেশাদারিত্ব ও মানবিকতার উজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখে চলেছেন সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা। আজ ২১ নভেম্বর সেই ‘সশস্ত্র বাহিনী দিবস-২০২৩’। দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি ও সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক মো. সাহাবুদ্দিন এবং প্রধানমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী শেখ হাসিনা বাণী দিয়েছেন।
আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদফতর (আইএসপিআর) জানিয়েছে, যথাযথ মর্যাদা ও উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে আজ সশস্ত্র বাহিনী দিবস উদযাপিত হবে। দেশের সব সেনানিবাস, নৌঘাঁটি এবং বিমানবাহিনী ঘাঁটির মসজিদগুলোতে দেশের কল্যাণ, সমৃদ্ধি এবং সশস্ত্র বাহিনীর উত্তরোত্তর উন্নতি ও অগ্রগতি কামনা করে ফজরের নামাজ শেষে বিশেষ মুনাজাতের মধ্য দিয়ে দিবসের কর্মসূচি শুরু হবে। দিবসটি উপলক্ষে আজ ঢাকা সেনানিবাসে যান চলাচল সীমিত থাকবে। এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে আজ বিকাল ৪টায় ঢাকা সেনানিবাসের সেনাকুঞ্জে এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।
জানা যায়, মহান মুক্তিযুদ্ধকালেই যে সশস্ত্র বাহিনীর (তৎকালীন বাংলাদেশ ফোর্সেস) জন্ম হয়েছিল সেই সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনী এখন স্বতন্ত্রভাবেই বিশে^র উন্নত-আধুনিক দেশগুলোর সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে চলেছে। ত্রিমাত্রিক সক্ষমতা অর্জনের পাশাপাশি বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী সক্ষমতা-দক্ষতায় বিশে^র সামরিক অঙ্গনেও নিজেদের সুনামের সঙ্গে তুলে ধরছে। আধুনিক ট্যাঙ্কার, মিসাইল, অরলিকন রাডার কন্ট্রোল গান, মাল্টিপল লঞ্চ রকেট/মিসাইল সিস্টেম, অত্যাধুনিক সাবমেরিন, আধুনিক এয়ারক্রাফট, যুদ্ধজাহাজ, যুদ্ধবিমান, অত্যাধুনিক হেলিকপ্টারসহ বিশ্বমানের আধুনিক সব যুদ্ধ সরঞ্জাম এখন সশস্ত্র বাহিনীর হাতে। এর বাইরেও দেশের অবকাঠামো উন্নয়নে ভূমিকা রাখার পাশাপাশি বিশ্বের গোলযোগপূর্ণ অনেক দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠাতেও অত্যন্ত প্রশংসনীয়ভাবে কাজ করে যাচ্ছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনী।
এ প্রসঙ্গে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদফতরের (আইএসপিআর) পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবু হায়দার মোহাম্মদ রাসেলুজ্জামান সময়ের আলোকে বলেন, ‘দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা থেকে শুরু করে উন্নয়ন ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী অনন্য ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। দেশ ও জনগণের আস্থার প্রতীক হিসেবে সুনামের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছে সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী। এ ছাড়াও জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনেও গৌরবের স্বাক্ষর রেখেছেন বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর শান্তিরক্ষীরা।’ আইএসপিআর পরিচালক বলেন, ‘বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের পেশাদারিত্ব, সাহসিকতা এবং আন্তরিকতা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশকে এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে।’
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিশ্ব শান্তিরক্ষার পাশাপাশি দেশের সার্বভৌমত্ব ও অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা, পার্বত্য অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠা, দুর্গম এলাকায় রাস্তাঘাট ও ব্রিজ নির্মাণ, দেশের মেগা প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়নে অসামান্য ভূমিকা, অসহায়তাদের খাদ্য-চিকিৎসাসেবাসহ নানা ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী অনন্য ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। একইভাবে নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীও তাদের মূল দায়িত্বের বাইরে নানা সামাজিক ও মানবিক কর্মকা- পরিচালনা করে ইতিমধ্যেই ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছে।
সশস্ত্র বাহিনী দিবসে যত কর্মসূচি :
আইএসপিআর জানিয়েছে, সশস্ত্র বাহিনী দিবস উপলক্ষে আজ (মঙ্গলবার) সকালে ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে আত্মোৎসর্গকারী সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী ঢাকা সেনানিবাসের শিখা অনির্বাণে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। এরপর সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল এসএম শফিউদ্দিন আহমেদ, নৌবাহিনী প্রধান অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ নাজমুল হাসান এবং বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল শেখ আবদুল হান্নান নিজ নিজ বাহিনীর পক্ষ থেকে শিখা অনির্বাণে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। প্রধানমন্ত্রী ঢাকা সেনানিবাসে অবস্থিত সশস্ত্র বাহিনী বিভাগে প্রধানমন্ত্রীর জন্য নির্ধারিত নিজস্ব কার্যালয়ে প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা বিষয়ক উপদেষ্টা ও তিন বাহিনী প্রধানদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করবেন। পরবর্তীতে বাহিনী প্রধানরা বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির সঙ্গেও সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন।
আইএসপিআর আরও জানায়, ‘সশস্ত্র বাহিনী দিবস-২০২৩’ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী ঢাকা সেনানিবাসে আর্মি মাল্টিপারপাস কমপ্লেক্সে বীরশ্রেষ্ঠদের উত্তরাধিকারী এবং নির্বাচিত সংখ্যক খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের উত্তরাধিকারীদের সংবর্ধনা প্রদান করবেন। এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক পাঁচজন সেনা, তিনজন নৌ এবং তিনজন বিমানবাহিনী সদস্যকে ২০২২-২৩ সালের শান্তিকালীন পদকে ভূষিত করা হবে। এ অনুষ্ঠানে মুক্তিযুুদ্ধ মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা উপদেষ্টা, সেনাবাহিনী প্রধান, নৌবাহিনী প্রধান, বিমানবাহিনী প্রধান, প্রধানমন্ত্রীর মূখ্য সচিব, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার (পিএসও) ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ বেসামরিক ও সামরিক কর্মকর্তারা উপস্থিত থাকবেন।
বিকালে সেনাকুঞ্জে সংবর্ধনা অনুষ্ঠান :
আইএসপিআরের তথ্যমতে, দিবসটি উদযাপন উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে আজ বিকালে ঢাকা সেনানিবাসে সেনাকুঞ্জে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। এ সংবর্ধনায় উল্লেখযোগ্য আমন্ত্রিত অতিথিদের মধ্যে রয়েছেন জাতীয় সংসদের স্পিকার, প্রধান বিচারপতি, প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি, সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা, প্রাক্তন প্রধান উপদেষ্টা, মন্ত্রী ও মন্ত্রীর পদমর্যাদা সম্পন্ন ব্যক্তিবর্গ, প্রতিমন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদা সম্পন্ন ব্যক্তিবর্গ, ডেপুটি স্পিকার, বাংলাদেশে নিযুক্ত বিদেশি রাষ্ট্রদূতরা, আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রধানরা, প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনাররা, বিচারপতি, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব, মূখ্য সচিব, সংসদ সদস্য (ঢাকা এলাকার), প্রাক্তন সামরিক কর্মকর্তা, তিন বাহিনীর প্রাক্তন প্রধানসহ আমন্ত্রিত বিভিন্ন পর্যায়ের বিশিষ্টজনরা। অনুষ্ঠানটি বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতার সরাসরি সম্প্রচারের ব্যবস্থা করছে।
আইএসপিআর আরও জানিয়েছে, সশস্ত্র বাহিনী দিবস উপলক্ষে আজ ২১ নভেম্বর নৌবাহিনী প্রধান নৌবাহিনীর খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের উত্তরাধিকারীদের সংবর্ধনা প্রদান করবেন। এ ছাড়া সেনাবাহিনী প্রধান এবং বিমানবাহিনী প্রধান ২৩ নভেম্বর খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা/তাদের উত্তরাধিকারীদের অনুরূপ সংবর্ধনা প্রদান করবেন। ঢাকা ছাড়াও বরিশাল, কক্সবাজার, বগুড়া, সিলেট, ঘাটাইল, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, যশোর, রংপুর ও খুলনা সেনানিবাস/ঘাঁটিতে সংশ্লিষ্ট এরিয়া সদর দফতরের ব্যবস্থাপনায় সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে। পাশাপাশি দিনটি যথাযোগ্য মর্যাদায় পালনের জন্য ঢাকার বাইরে দেশের অন্যান্য সেনা গ্যারিসন, নৌ এবং বিমানবাহিনী ঘাঁটিতেও বিভিন্ন কর্মসূচি পালিত হবে। ঢাকা, খুলনা, চাঁদপুর, বরিশাল ও চট্টগ্রামে বিশেষভাবে সজ্জিত নৌবাহিনী জাহাজগুলো ২১ নভেম্বর দুপুর ২টা থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সর্বসাধারণের দেখার জন্য নিকটস্থ ঘাটগুলোতে অবস্থান বা নোঙ্গরকৃত অবস্থায় রাখা হবে।
সশস্ত্র বাহিনী দিবসে গণমাধ্যমে যত আয়োজন :
আইএসপিআর জানিয়েছে, সশস্ত্র বাহিনী দিবসের তাৎপর্য তুলে ধরে গতকাল সোমবার বাংলাদেশ টেলিভিশনে রাত ৮টার বাংলা সংবাদের পর সশস্ত্র বাহিনীর পরিবেশনায় ‘বিশেষ অনির্বাণ’ অনুষ্ঠান সম্প্রচার করেছে। আজ সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় বাংলাদেশ বেতার ‘বিশেষ দূর্বার’ অনুষ্ঠান সম্প্রচার করবে। টেলিভিশনের জন্য নির্মিত ‘বিশেষ অনির্বাণ’ অনুষ্ঠানটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলোও পরবর্তীতে পর্যায়ক্রমে প্রচারিত হবে। সশস্ত্র বাহিনী দিবস উপলক্ষে আজ বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশিত হবে। এ উপলক্ষে সশস্ত্র বাহিনীর পরিচালনাধীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতেও রচনা ও চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছে।
ঢাকা সেনানিবাসে যান চলাচল সীমিত থাকবে :
আইএসপিআর জানায়, সশস্ত্র বাহিনী দিবস উপলক্ষে আজ ঢাকা সেনানিবাসে বিভিন্ন কর্মসূচি পালিত হবে। এদিন ঢাকা সেনানিবাসের রাস্তাগুলো (শহিদ জাহাঙ্গীর গেট থেকে স্টাফ রোড পর্যন্ত প্রধান সড়ক) যানজট মুক্ত রাখার লক্ষ্যে সেনানিবাসে অবস্থানকারী ব্যক্তি এবং আমন্ত্রিত অতিথিদের বহনকারী যানবাহন ব্যতীত সব ধরনের যানবাহন সকাল ৭টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত এবং দুপুর ১২টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত সেনানিবাস এলাকা দিয়ে চলাচল পরিহার করার জন্য অনুরোধ করা যাচ্ছে।
সশস্ত্র বাহিনী দিবস পালন শুরু হয় যেভাবে :
সশস্ত্র বাহিনী সূত্রে জানা যায়, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার যুদ্ধ চলাকালে সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী সম্মিলিতভাবে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে আক্রমণের সূচনা করে। দেশ স্বাধীনের পর সেনাবাহিনী ২৫ মার্চ, নৌ বাহিনী ১০ ডিসেম্বর এবং বিমানবাহিনী ২৮ সেপ্টেম্বর আলাদাভাবে দিবসটি পালন করত। পরবর্তীতে আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে সম্মিলিতভাবে ২১ নভেম্বরকে সশস্ত্র বাহিনী দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি জাতির অগ্রযাত্রা ও বিজয়ের স্মারক সেই ২১ নভেম্বর-সশস্ত্র বাহিনী দিবস।