নিজস্ব প্রতিবেদক :
প্রতিবছরের ন্যায় এবারও পর্যটকের পদভারে মুখরিত শেরপুরের ঝিনাইগাতী গজনী-অবকাশ। নগর জীবনের যান্ত্রিকতাকে ছুটি জানিয়ে একটু মুক্তির আশায় প্রতিদিনই ভিড় করেছে হাজারও ভ্রমন পিপাসু মানুষ। দেশের পশ্চিম-উত্তর সীমান্তের গারো পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত অন্যতম বিনোদন কেন্দ্র এটি। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যই গজনীর মূল আকর্ষণ। চারদিকে উঁচু পাহাড় আর গাছ আপনাকে স্বাগত জানাবে প্রাকৃতিক নির্মলতায় । উঁচু পাহাড়ে দাঁড়িয়ে দূরের পাহাড়ে সবুজ গাছ দেখে চোখ জুড়াতেই যেন গজনীতে আসেন ভ্রমন পিপাসু পর্যটকরা।
১৯৯৫ সনে তৎকালীন শেরপুর জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে শেরপুর জেলা সদর থেকে ২৮ এবং ঝিনাইগাতি উপজেলা সদর থেকে ৮ কিলোমিটার উত্তরে কাংশা ইউনিয়নে গজনি পাহাড়ের প্রায় ৯০ একর পাহাড়ি টিলায় ‘গজনি অবকাশ কেন্দ্র’ নামে একটি পিকনিক স্পট গড়ে তোলা হয়। এখানে দেশের প্রায় সব জেলা-উপজেলা থেকেই ভ্রমনপিপাসুরা প্রতি বছর ভিড় জমায়। তবে গজনী অবকাশের প্রধান আর্কষণ লেক পাড় তথা কৃত্রিম দ্বীপটি পাহাড়ী ঢলে বিদ্ধস্ত হওয়ায় এর আগে যারা এসেছে তাদের মন কিছুটা খারাপ হলেও অন্যান্য সৌন্দর্য বৃদ্ধি পাওয়ায় তারা ঘুরে আনন্দিত।
সরে জমিনে ঘুরে গত শুক্রবার কথা হয় ময়মনসিংহ মুকুল নিকেতন উচ্চ বিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক এ.কে.এম. সাজেদুল হকের সাথে। তিনি বলেন, কর্মজীবনের ব্যস্ততার মাঝে এমন একটি জায়গা ঘুরে খুব ভাল লাগল। কিন্তু এর আগে এসে কৃত্রিম দ্বীপটি দেখে ভাল লেগেছিল। এবার না থাকায় আনন্দ থেকে অনেকটা বঞ্চিত হয়েছি। তবে আগের চেয়ে অনেক উন্নতি হয়েছে।
অন্যদিকে ত্রিশাল কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ব বিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্র কামরুল মুজাহিদ অভিযোগ করে বলেন, এই পিকনিক স্পটে ছিনাইয়ের ঘটনা ঘটেছে আমাদেরই এক প্রিয়জনের সাথে । তাই আমরা বনের ভিতর প্রবেশ করতে পারি নাই। এই বিষয়টিতে প্রশাসনের নজর দেয়া খুবই জরুরী । নয়ত পর্যটকরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগবে এবং এখানে আসতে চাইবেনা ।
গজনী-অবকাশের সাইট ভিউ টাওয়ারের ইজারাদার মো.নাজমুল হাসান বলেন, গত বছরের চেয়ে এবার অনেক পর্যটক আসতে শুরু করেছে। তবে আবাসিক হোটেল, খাবারের ভাল মানের হোটেল, বিশুদ্ধ পানিসহ অন্যান্য সৌন্দর্য বর্ধনের কাজ করলে আরো অনেক পর্যটকের ভিড় হতো।
যেভাবে ঘুরে দেখবেন এ পর্যটন কেন্দ্রটি :
প্রবেশ ও অবস্থান নিয়ে গজনী পিকনিক স্পটের কোনো স্পট ভাড়া না থাকলেও প্রবেশপথে আপনাকে বাসের জন্য ৪’শ টাকা, মাইক্রোবাস ২’শ টাকা,জীপ ১’শ ৫০ টাকা দিয়ে একটি ছাড়পত্র নিতে হবে এবং সেটি বডার গার্ড অব বাংলাদেশের কর্মীকে দেখাতে হবে। তারা কিছু বিষয়ে সর্তকবাণী জানিয়ে দেবেন। তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে হয়। সন্ধ্যার আগেই ত্যাগ করতে হবে পিকনিক স্পট ।
যাবেন যেভাবে :
রাজধানী ঢাকা থেকে গজনীর দূরত্ব ২৩০-২৪০ কি.মি.। কিন্তু যেতে সময় লাগে অনেক। বাসে গেলে ৬ থেকে ৭ ঘণ্টা সময় লাগবে। তাই একদিনের পিকনিক হলে ঢাকা থেকে রাতে রওনা দেওয়া ভালো, তাহলে সকালে স্পটে পৌঁছে যাওয়া যায় এবং সারা দিন ঘোরাফেরা করা যাবে। আর ট্রেনে যাওয়া যাবে জামালপুর পর্যন্ত সেখান থেকে সিএনজি বা বাসে শেরপুর তার পর সিএনজিতে অবকাশ । ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়েও যাওয়া যায়।
বিনোদন ও বিশ্রাম:
গজনী পিকনিক স্পটে আছে মুক্তমঞ্চ। সেখানে সারা দিন অনুষ্ঠান করা যায়। তার পাশেই আছে ৬ কক্ষবিশিষ্ট রেস্ট হাউস। প্রতি রুমের ভাড়া ১০০০ টাকা। বিদ্যুৎ,পানিসহ সব সুবিধা আছে এখানে। রুমের ভেতরের ঠাণ্ডা আবহাওয়া এসিকেও হার মানাবে।
দেখার মত যা আছে :
গজনী অবকাশ পিকনিক স্পটে আছে ড্রাগন, ঝুলন্ত ব্রিজ, ময়ুরপঙ্খী নাও, পাহাড়, টিলা, পদ্মসিঁড়ি, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভ, শিশুপার্ক, মিনি চিড়িয়াখানা, মৎস্যকুমারী, শত বছরের বটগাছ। এখানে পাতালপুরী নামে একটা গুহা আছে। গুহাটা খুবই আকর্ষণীয়। আর পুরা গজনীর রূপ একবারে দেখতে হলে অবশ্য উঠতে হবে সাইটভিট টাওয়ারে। মাত্র ১০ টাকার বিনিময়ে একসঙ্গে দেখা যাবে গজনীর রূপ। ঘোড়ার গাড়িতে ঘুরে আসা যায় বাংলাদেশ-ভারতের সীমানা। অবকাশের উত্তর এবং পশ্চিম পাশেই রয়েছে বিচিত্র জীবন-জীবিকার মানুষ আদিবাসী গারো-কোচ-হাজংসহ ৬ সম্প্রদায়ের লোকজন।
খাবার কি হবে :
গজনীতে রান্না করার জায়গার সুব্যবস্থা আছে। পাহাড়ের উপরে ফাঁকা জায়গায় কাঠ দিয়ে রান্না করা যায়। কিন্তু কাঠ বাইরে থেকে কিনে নিয়ে যেতে হবে। আর এখানে রান্নার পানির খুব অভাব। তাই পানি এনে দেওয়ার মহিলা পাওয়া যায়। তাদের কিছু টাকা দিলে দূর থেকে খাবারযোগ্য পানি এনে দেবেন। রান্না শেষে অবশ্যই পানি দিয়ে আগুন নিভিয়ে দিতে হবে।
কেনাকাটা:
গজনীর পাহাড়ের উপরের তৈজসপত্র, বেতের তৈরি জিনিস, বাঁশ-কাঠের তৈরি চুড়ি, কানের দুল, আয়না, কলম, কাঠের তৈরি বাচ্চাদের ব্যাটসহ অনেক কিছু কিনতে পাওয়া যায়। দুটি দোকানে আছে তাঁতে বোনা কাপড় । যা খুবই অল্প দামে কেনা যায়। এছাড়া বেতের লাঠি এখানের দোকানের আরও একটি আকর্ষণ।
পরিবার-পরিজন, অফিস কলিক কিংবা সংগঠনের সদস্যদের নিয়ে প্রকৃতির মাঝে একদিনের জন্য হারিয়ে যাওয়ার জন্য গজনী পিকনিক স্পট একটি উত্তম জায়গা।
সতর্ক থাকবেন যে বিষয় গুলোতে :
পাহাড়ি এলাকা। পাহাড় থেকে হাতির দল নেমে আসে। তাই হাতি থেকে সাবধান। পাহাড়ে ওঠার সময় পা যেন ফসকে না যায়। আর ভারতের সীমানা দিকে খেয়াল রাখতে হবে। তাছাড়া প্রশাসনের পক্ষ থেকে ঝ্ুঁকিপূর্ণ স্থান গুলোতে যে সতর্ক বাণী ঝুলিয়ে দেওয়া আছে তা মেনে চলতে হবে । নয়ত আপনিও পড়তে পারেন নানা ঝক্কি ঝামেলায়।
যদিও ঝিনাইগাতী থানার ওসি মিজানুর রহমান বলেন, গজনী-অবকাশ পিকনিক স্পর্টের নিরাপত্তা ব্যবস্থা অনেক ভাল। প্রতিদিনই পোশাকে ও সাদা পোশাকে পুলিশ,বিজিবি ,গ্রাম পুলিশ, কমিউনিটি পুলিশ টহলে থাকে । ইতিমধ্যে আমরা বেশ কয়েকজন দূবৃত্তকে গ্রেফতার করেছি। আমরা আশ্বস্থ করতে পারি এখানে পর্যটকরা নিরাপদ থাকবে।
এসব ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এ.জেড.এম শরীফ হোসেন বলেন, গজনী অবকাশ কেন্দ্রটি ভ্রমণ পিপাসুদের জন্য একটি সুন্দর স্থান। এই স্পর্টের সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহন করা হচ্ছে। পাশাপাশি ছিনতাই সহ যে ধরণের বিছিন্ন সমস্যা আছে তা সমাধানে আমরা চেষ্ঠা অব্যাহত রেখেছি । অন্যায় করে কেউ পার পাবেনা।