‘স্বপ্নেও ভাবি নাই আমগর দিন ঘুরবো। খাইয়া না খাইয়া কত দিন গেছে। পেডের তাগিদে মাইনসের বাড়ি বাড়ি গিয়া ভিক্ষা করছি। খিদার জ্বালায় পরের বাড়ি কামলির কাম করছি, রাস্তায় মাডি কাটছি। ভিক্ষা করা চালের ভাত আর কচুপাতা ভত্তা খাইয়া আমগর দিন গেছে। ঝি-পুত লইয়া কত কষ্টে দিন কাডাইছি। তহন চিন্তা করছি পুলাপাইনগরে কেমনে মানুষ করমু। মেলাদিন পর এহন আমগর দিন ঘুরছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমগরে বীরঙ্গনার স্বীকৃতি দিছে। পাক্কা বাড়ি বানাইয়া দিছে। বাড়িতে ওহন আমরা আরামে ঘুমাই। আমগর সংসার ওহন শান্তিতে চলে। আমরা দোয়া করি শেখের বেডি হাসিনারে আল্লাহ বাঁচাইয়া রাহুক। তার জন্য আমরা শরীলের রক্ত দিতেও রাজি আছি।’
এভাবেই কান্নাজড়িত কণ্ঠে কথাগুলো বললেন শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার কাঁকরকান্দি ইউনিয়নের মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত সোহাগপুর বিধবাপল্লীর শহীদ ফজর আলীর স্ত্রী বীরঙ্গনা জুবেদা বেগম (৭৫)।
আজ ২৫শে জুলাই। ঐতিহাসিক সোহাগপুর গণহত্যা দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে নৃশংস গণহত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছিল নালিতাবাড়ী উপজেলার কাঁকরকান্দি ইউনিয়নের সোহাগপুর গ্রামে। এদিন গ্রামের পুরুষরা কেউ কেউ ফসলের মাঠে হাল বইতে গিয়েছিলেন কেউ বা বসেছিলেন নিজ বাড়িতেই। পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার, আলবদর বাহিনী ভারত সীমান্তঘেঁষা এ গ্রামের সবটুকু এলাকা ঘিরে ফেলে। পরে শুরু করে নির্মম হত্যাযজ্ঞ। এতে ১৮৭ জন পুরুষকে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করে তারা। সেদিন রক্তের বন্যা বয়ে গিয়েছিল সোহাগপুর গ্রামে। রক্তে লাল হয়েছিল সোহাগ পুরের ফসলের মাঠ। স্ত্রীর চোখের সামনে স্বামীকে, সন্তানের চোখের সামনে বাবাকে ও ফসলের মাঠে গিয়ে গুলি করে মানুষ হত্যা করে পাকিস্তানি হানাদাররা। সারাগ্রাম পরুষশূন্য হওয়ায় লাশ দাফনে বিপদে পড়েন তারা। কাফনের কাপড় না পেয়ে অনেক কষ্ট করে পরনের ছেঁড়া কাপড় ও মশারি দিয়ে পেঁচিয়ে একেক কবরে একাধিক লাশ দাফন করেন তারা। জীবন ও সম্ভ্রম বাঁচাতে কেউবা আবার লাশ ফেলে চলে যান অন্যত্র। সকল পুরুষকে হত্যা করায় এই গ্রামের নামকরণ করা হয় ‘সোহাগপুর বিধবাপল্লী।’ এই পল্লীতে স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে ৫৬ জন বিধবা বেঁচে ছিলেন। বর্তমানে ২৩ জন বিধবা বেঁচে আছেন। এর মধ্যে ১৪ জন বিধবাকে বীরঙ্গনার স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এ থেকে ৩ জন বীরঙ্গনা দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন। এখন জীবিত আছেন বীরঙ্গনা ১১ জনসহ ২৩ বিধবা নারী। বাকি ১২ বিধবা বীরঙ্গনা তাদের স্বীকৃতির দাবি জানান।
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিধবাদের ভাগ্যবদল হয়েছে। উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে সোহাগপুর গ্রামে। ইতোমধ্যে স্বাধীনতা যুদ্ধে বিরোচিত ভূমিকা রাখায় ২৯ বিধবাকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১১ লাখ টাকা মূল্যের একটি করে বীরনিবাস নামে পাকাবাড়ি উপহার দিয়েছেন। বিধবাপল্লীতে যাওয়ার সড়ক পাকা করা হয়েছে। গ্রামের পাশেই প্রাথমিক বিদ্যালয় নির্মাণ করা হয়েছে। তবে তা এখনো সরকারিকরণ হয়নি। কাঁকরকান্দি বাজারের পাশে বরুয়াজানী গ্রামে শহীদদের স্মরণে ‘শহীদ মুক্তিযোদ্ধা কলেজ’ প্রতিষ্ঠা করে দিয়েছেন সংসদ উপনেতা ও স্থানীয় এমপি অগ্নিকন্যা বেগম মতিয়া চৌধুরী। এখানে চিহ্নিত করা হয়েছে শহীদদের গণকবর। আর যুদ্ধের স্মৃতিকে স্মরণীয় করে রাখতে নির্মাণ করা হয়েছে ‘সৌরজায়া’ নামে স্মৃতিসৌধ।
নালিতাবাড়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) খৃস্টফার হিমেল রিছিল বলেন, দিবসটি পালন উপলক্ষে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নানা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। এসব কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের ‘সৌরজায়া’ স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ, আলোচনাসভা, বীরঙ্গনাদের সংবর্ধনা প্রদান, নগদ অর্থ বিতরণ ও উন্নতমানের খাবার পরিবেশন করা।