:রনি রেজা:
আগে প্রায়ই সাংবাদিকদের একটি প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হতো; সব খবর কিভাবে সবার আগে পান? প্রশ্নটি কিছুটা জটিল হলেও এরমধ্যে ছিল এক প্রকার আত্মতৃপ্তি। গর্বের সহিতই প্রশ্নকর্তার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসি মিশ্রিত উত্তরটা দিতেন। মুখে উত্তর যা-ই দিতেন; মনে মনে বলতেন, ‘এখানেই তো সাংবাদিকদের ক্যারিশমা। সাবর আগে খবর পাই বলেই তো আমরা সাংবাদিক।’
তখন ভুলে যেতেন রোদ-ঝড়-বৃষ্টি মাথায় করে সংবাদ সংগ্রহের কষ্টের কথা। অগ্রজদের মুখে এখনো সেই গল্প শোনা যায়। তবে মেলে না এসব প্রশ্নের। কারণ, উত্তর অনেকেরই জানা। এক কথায় উত্তর একটাই, ‘ঘরে ঘরে আছে ডটকম’। এই ডটকমে ভর করেই দেশে কয়েক হাজার নাম সর্বস্ব পত্রিকা চলছে। আবার এই ডটকমও চলছে নিজস্ব গতিতেই। কপি-পেস্ট প্রকৃয়ায় চালাতে প্রয়োজন হচ্ছে না প্রতিবেদকের। প্রয়োজন হচ্ছে না কোনো সোর্সের। একটি বা দুটি কম্পিউটার আর নেট লাইন থাকলেই হলো। মুহূর্তের খবর পৌঁছে দেয় মুহূর্তে। বর্তমানে বাংলাদেশে অনলাইন নিউজ পোর্টালের সংখ্যা কমপক্ষে পাঁচ হাজার। এর মধ্যে পেশাদারিত্ব এবং মোটামুটি পেশাদারিত্ব আছে এমন নিউজ পোর্টালের সংখ্যা পাঁচ বা ছয়ের বেশি হবে না (টিভি ও দৈনিক পত্রিকার ওয়েবসাইট বাদে)। অর্থাৎ পাঁচ হাজারে পাঁচটা। শতাংশের হিসাবে তা ০.১ ভাগ। তার মানে হলো ৯৯.৯ ভাগ পোর্টালের পেশাদারিত্ব নেই। এই পোর্টালগুলো অন্য পোর্টালের সংবাদ নির্লজ্জভাবে চুরি করে কিছুটা পরিবর্তন করে বা হুবহু প্রকাশ করে থাকে। এগুলোতে কোনো বিনিয়োগ নেই। প্রয়োজনের তুলনায় নিজস্ব সংবাদকর্মী নেই। এদের একমাত্র মূলধন ঐ চৌর্যবৃত্তি। মানে কপি এবং পেস্ট। কপি ঠেকানোর কোনো কার্যকর ব্যবস্থা থাকলে এ পোর্টালগুলোর জন্মের পরই মৃত্যু হতো। হয়তো জন্মই হতো না।
গণমাধ্যমের মূল দায়িত্ব সংবাদ সরবরাহের চেয়ে এরা ব্যক্তি স্বার্থ উসুলের উদ্দেশ্যেই অনলাইনগুলো চালু করেন। সবথেকে কষ্টের বিষয় হচ্ছে, ‘এই অনলাইনে ভর করেই মারাত্মক আকার ধারণ করেছে হলুদ সাংবাদিকতা।’ আমাদের দেশে একসময় প্রচুর শোনা যেত, ‘কবির চেয়ে কাকের সংখ্যা বেশি। এখন নির্দ্বিধায় বলা যায়, যে কোনো পাখির চেয়ে সাংবাদিক বেশি। এই গণসাংবাদিক তৈরিতেও নগ্ন ভূমিকা রয়েছে অনলাইনগুলোর। নিউজের চেয়ে এরা সাংবাদিক উৎপাদনেই বেশি কার্যকর বলা যায়। আর এই গণহারে উৎপাদিত সাংবাদিকরাও কোনো প্রকারের সাংবাদিকতা জ্ঞান ছাড়াই চর্চা করে যাচ্ছেন হলুদ সাংবাদিকতা। অধিকাংশই জানেন না সাংবাদিকতার এথিক্স আছে। জানলেও তা মানার প্রয়োজন আছে বলে মনে করেন না। পাঁচশ’ টাকা খরচ করলেই নীলক্ষেত থেকে চকচকে প্রেসকার্ড ও ভিজিটিং কার্ড করে চালিয়ে যান হলুদ সাংবাদিকতা। যদিও অনেক আগে থেকেই ছিল এই হলুদ সাংবাদিকতা। কিন্তু তার প্রসার বর্তমানে মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছেছে। ইতিহাস থেকে জানা যায়, সাংবাদিকতায় ইয়েলো জার্নালিজম বা হলুদ সাংবাদিকতা শব্দটি এসেছে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে। দুই ভুবন বিখ্যাত সাংবাদিক জোসেফ পুলিৎজার ও উইলিয়াম হার্স্টের এক অশুভ প্রতিযোগিতার ফসল আজকের এই ‘হলুদ সাংবাদিকতা’। ১৮৮৩ সালে নিউইয়র্ক ওয়ার্ল্ড নামে একটি সংবাদপত্র কিনেন প্রখ্যাত সাংবাদিক জোসেফ পুলিৎজার। পত্রিকাটির আগের মালিক ছিলেন জে গোল্ড। অন্যদিকে উইলিয়াম হার্স্ট ১৮৮২ সালে ‘দ্য জার্নাল’ নামে একটা পত্রিকা কিনে নেন জোসেফ পুলিৎজারের ভাই অ্যালবার্ট পুলিৎজারের কাছ থেকে। কিন্তু পরিবারের সদস্যের পত্রিকা হার্স্টের হাতে চলে যাওয়ার বিষয়টিকে সহজভাবে নিতে পারেননি পুলিৎজার। শুরু হয় হার্স্টের সঙ্গে পুলিৎজারের স্নায়ুযুদ্ধ। পুলিৎজার নিউইয়র্ক ওয়ার্ল্ড কিনেই ঝুঁকে পড়লেন চাঞ্চল্যকর খবর, চটকদারি সংবাদ ইত্যাদি প্রকাশে। রিচার্ড ফেন্টো আউটকল্ট নামে একজন কার্টুনিস্টকে চাকরি দিলেন তার কাগজে। ঐ কার্টুনিস্ট ‘ইয়েলো কিড’ বা ‘হলুদ বালক’ নামে প্রতিদিন নিউইয়র্ক ওয়ার্ল্ডের প্রথম পাতায় একটি কার্টুন আঁকতেন এবং তার মাধ্যমে সামাজিক অসংগতি থেকে শুরু করে এমন অনেক কিছু বলিয়ে নিতেন, যা ছিল অনেকটাই পক্ষপাতদুষ্ট। এক সময় হার্স্ট পুলিৎজারের নিউইয়র্ক ওয়ার্ল্ডের কার্টুনিস্ট রিচার্ড ফেন্টো আউটকল্টকে অধিক বেতনের প্রলোভনে নিয়ে এলেন তার ‘জার্নাল’ পত্রিকায়। হার্স্ট তাতেই ক্ষান্ত থাকেননি, মোটা বেতনের লোভ দেখিয়ে নিউইয়র্ক ওয়ার্ল্ডের ভালো সব সাংবাদিককেও টেনে নেন নিজের পত্রিকায়। বেচারা পুলিৎজার রেগে আগুন। তিনি অগত্যা জর্জ চি লুকস নামে আরেক কাটুনিস্টকে নিয়োগ দেন। এদিকে জার্নাল, ওদিকে নিউইয়র্ক ওয়ার্ল্ড – দুটো পত্রিকাতেই ছাপা হতে লাগলো ইয়োলো কিডস বা হলুদ বালক কার্টুন। শুরু হয়ে গেলো পত্রিকার কাটতি নিয়ে দুটো পত্রিকার মধ্যে দ্বন্দ্ব। জার্নাল এবং নিউইয়র্ক ওয়ার্ল্ডের বিরোধ সে সময়কার সংবাদপত্র পাঠকদের কাছে ক্রমেই আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছিলো। দুটো পত্রিকাই তাদের হিট বাড়ানোর জন্য ভিত্তিহীন, সত্য, অর্ধসত্য ব্যক্তিগত কেলেংকারিমূলক খবর ছাপা শুরু করলো। এতে দুটো পত্রিকাই তাদের মান হারালো। তৈরি হলো একটি নষ্ট মানসিকাতর পাঠকশ্রেণি, যারা সব সময় চটকদার, ভিত্তিহীন, চাঞ্চল্য সৃষ্টিকারী, অর্ধ-সত্য সংবাদ প্রত্যাশা করতো এবং তা পড়ে তৃপ্তি পেতো। এভাবেই জোসেফ পুলিৎজার ও উইলিয়াম হার্স্ট দু’জনেই হলুদ সাংবাদিকতার দায়ে অভিযুক্ত এবং ইতিহাসে চিহ্নিত হয়ে রইলেন। আর তাদেরই উত্তরসূরী হয়ে এই হলুদ সাংবাদিকতা যুগ যুগ জিইয়ে রাখছেন কিছু সাংবাদিক। যার ফলে ব্যহত হচ্ছে মূল ধারার সাংবাদিকতা। বাধাপ্রাপ্ত হতে হচ্ছে পেশাদারিত্বের জায়গায়। ফ্র্যাঙ্ক লুথার মট হলুদ সাংবাদিকতার পাঁচটি বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেছেন। তা হলো- ‘সাধারণ ঘটনাকে কয়েকটি কলামজুড়ে বড় আকারের ভয়ানক একটি শিরোনাম করা। ছবি আর কাল্পনিক নকশার অপরিমিত ব্যবহার। ভুয়া সাক্ষাৎকার, ভুল ধারণার জন্ম দিতে পারে এমন শিরোনাম, ভুয়া বিজ্ঞানমূলক রচনা আর তথাকথিত বিশেষজ্ঞ কর্তৃক ভুল শিক্ষামূলক রচনার ব্যবহার। সম্পূর্ণ রঙিন রবিবাসরীয় সাময়িকী প্রকাশ, যার সঙ্গে সাধারণত কমিক্স সংযুক্ত করা হয়। স্রোতের বিপরীতে সাঁতরানো পরাজিত নায়কদের প্রতি নাটকীয় সহানুভূতি।’ যার সবগুলোই বর্তমানের ব্যাঙের ছাতার ন্যায় বেড়ে ওঠা অনলাইনগুলোর মধ্যে রয়েছে।
জনপ্রতিনিধিসহ ও সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদের ব্যক্তিরাও অনলাইন নিউজ পোর্টালের প্রতি ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন বিভিন্ন সময়। কিছু বুঝে ওঠার আগেই এই ধারার গণমাধ্যমকে কঠোর নিয়মের মধ্যে রাখার কথাও তারা বলেছেন। এমনকি সরকারঘেঁষা সাংবাদিকরাও সে কথা সমর্থন করেছেন। শেষ পর্যন্ত তারা নীতিমালা তৈরিতেও হাত দিয়েছেন। তবে একসময় অনেক তোড়জোড় থাকলেও খসড়া নীতিমালা প্রকাশের পর নানা সমালোচনার মুখে তা আলোর মুখ দেখেনি এখনো। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী এখন সে বিষয়ে আর কোনো কথাও বলেন না। গেল বছরের সেপ্টেম্বরে একটি গণমাধ্যম হাউজের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী অনুষ্ঠানে সাংবাদিকতার শিক্ষক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক তার নিজের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে বলেছিলেন, ‘তথ্য যাচাই-বাছাই না করে কোন ধরনের সম্পাদনা ছাড়াই অধিকাংশ অনলাইন নিউজপোর্টালের সংবাদ প্রকাশ করার ফলে সাংবাদিকতায় বস্তুনিষ্ঠতা নষ্ট হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘সম্পাদনাই হচ্ছে সাংবাদিকতার প্রাণ। কিন্তু অধিকাংশ অনলাইন সংবাদপত্রের সংবাদে সম্পাদনার চিহ্নমাত্র নেই। যিনি সংবাদ সংগ্রহ করছেন, তিনিই সেটা আপলোড করছেন এবং সেটা নিয়ে আমরা ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিচ্ছি, বহু কিছু করছি, কিন্তু মূল জায়গায় অর্থাৎ এটা যে কোনো সাংবাদিকতাই নয়, সেটা অনেক সময় বোঝা যাচ্ছে না।’
সরকারি নির্দিষ্ট কোনো নীতি না থাকাতে অনলাইনগুলো আরো বেশি বেপরোয়া হয়ে উঠছে। এগুলো দমনে সরকারের যেমন ভূমিকা থাকা জরুরি তেমনি মূল ধারার সাংবাদিকদেরও সচেতনতা জরুরি। একজন পেশাদার সাংবাদিকের যে পরিমাণ মায়া এ পেশার প্রতি রয়েছে তা অন্যকেউ উপলব্ধি করতে পারবে না। সেই অনুধাবন থেকে হলেও হলুদ সাংবাদিকতা রোধে পেশাদার সাংবাদিকদের এগিয়ে আসতে হবে সবার আগে। রুখতে হবে গণমাধ্যমের শত্রু হলুদ সাংবাদিকদের।
লেখক:-ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, ডেইলি বাংলাদেশ।