প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপূর্ব লীলাভূমি শেরপুর জেলার সীমন্তবর্তী উপজেলা ঝিনাইগাতীর ঐতিহ্যবাহী গারো পাহাড়। গারো পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত সীমান্তবর্তী গজনী অবকাশ কেন্দ্র । সারি সারি শাল, গজারী, সেগুন, ছোট-বড় মাঝারি টিলা, লতাপাতার বিন্যাস প্রকৃতি প্রেমিদের নিশ্চিত দোলা দিয়ে যাবে ।
অন্যদিকে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে নতুন করে পাহাড়ের বুক জুড়ে তৈরী হচ্ছে সুদীর্ঘ ওয়াকওয়ে। পায়ে হেঁটে পাহাড়ের স্পর্শ নিয়ে লেকের পাড় ধরে হেঁটে যাওয়া যাবে এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে।
উঁচু পাহাড় থেকে তৈরী হচ্ছে কৃত্রিম জলপ্রপাত। জলপ্রপাতের নীচে পাথরে বসে আড্ডা আর ওয়াকওয়ের পাশে লেকের ধারে তৈরী হচ্ছে মিনি কফিশপ।
পূর্বে ছোট পরিসরে একটি চিড়িয়াখানা থাকলেও নতুন করে এতে সংযুক্ত করা হয়েছে মেছো বাঘ, অজগর সাপ, হরিণ, ভাল্লুকসহ প্রায় ৪০ প্রজাতির প্রাণি।
পড়ন্ত বিকেলে ছোট ছোট নৌকায় করে ঘুরার জন্য রয়েছে লেক। লেকের বুকে নৌকায় চড়ে পাহাড়ের পাদদেশে কফি আড্ডা আর গান এখানে আগত দর্শণার্থীদের জন্য অন্যরকম অভিজ্ঞতা তৈরী করবে।
গারো মা ভিলেজেও ছোঁয়া লেগেছে নতনত্বের। মাশরুম ছাতার নীচে বসে বা পাখি ব্রেঞ্চে বসে পাহাড়ের ঢালে আদিবাসীদের জীবনযাত্রা, দিগন্তজোড়া ধান ক্ষেত আর পাহাড়ী জনপদের ভিন্ন জীবনমান উপভোগ করা যাবে খুব সহজেই।
আগত শিশু দর্শণার্থীদের জন্য চুকুলুপি চিলড্রেনস পার্কের পাশাপাশি এবার নতুন যুক্ত হচ্ছে শিশু কর্ণার। সাথে আছে শেরপুর জেলা ব্র্যান্ডিং কর্ণার। পর্যটনের আনন্দে, তুলসীমালার সুগন্ধে শেরপুর – এই স্লোাগানে শেরপুর জেলা ব্র্যান্ডিং এর জন্য নির্মিত এই ব্র্যান্ডিং কর্ণারে জেলার বিভিন্ন ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্বলিত ছবি, পুস্তক, ভিডিও চিত্র থাকবে। জেলার ব্যান্ডিং পণ্য তুলসীমালা চালের জন্যও থাকছে নির্দিষ্ট স্থান।
এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে যাবার জন্য এবার নতুন তৈরী হচ্ছে ক্যাবল কার। যা গজনী অবকাশে আগত ভ্রমণপিপাসুদের জন্য আলাদা মাত্রা যোগ করবে।
সাধারনত শীত মৌসুমে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ভ্রমন পিপাসুরা দল বেধেঁ ভিড় করে ঝিনাইগাতীর গারো পাহাড়ের গাজনী অবকাশ কেন্দ্রে । নৈস্বর্গীক সৌর্ন্দযের লীলা ভূমি ও প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর এ গারো পাহাড়। সীমান্ত ঘেঁষা বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে ছবির মতো গারো পাহাড়ের সারি আর বনভূমি মানুষকে আকৃষ্ট করেছে সব সময়।
শেরপুর জেলা শহর থেকে আনুমানিত ৩০ কিলোমিটার দূরত্বে ১৯৯৩ সালে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে এই অবকাশ কেন্দ্রটি নির্মাণ করা হয়। ঝিনাইগাতী উপজেলার কাংশা ইউনিয়নের প্রায় ৯০ একর পাহাড়ী এলাকা জুড়ে এর অবস্থান। নির্মাণের পর থেকেই প্রতি বছর ক্লান্ত জীবনের ব্যস্ততাকে পিছনে ফেলে অবসরে হাজারো পর্যটক ভীড় করেন এই গজনী অবকাশ কেন্দ্রে।
ভারতের মেঘালয়ের কোল ঘেঁষে ও বাংলাদেশের উত্তর সীমান্তে অরণ্যরাজি আর গারো পাহাড়ের পাদদেশে পাহাড়ি নদী ভোগাই, চেল্লাখালি, মৃগী, সোমেশ্বরী, মালিঝি, মহারশীর ঐশ্বরিক প্রাচুর্যস্নাত অববাহিকায় সমৃদ্ধ জনপদ শেরপুর। এ জেলার বিশাল অংশজুড়ে গারো পাহাড়ের বিস্তৃতি। লাল মাটির উঁচু পাহাড়। গহীন জঙ্গল, টিলা, মাঝে সমতল। দু’পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে ছন্দ তুলে পাহাড়ী ঝর্ণার এগিয়ে চলা। পাহাড়, বনানী, ঝরণা, হ্রদ এতসব প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মধ্যেও কৃত্রিম সৌন্দর্যের অনেক সংযোজনই রয়েছে গজনী অবকাশ কেন্দ্রে।
বিভিন্ন সময় জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে বেশ কিছু স্থাপনা ও ভাস্কর্য তৈরী হয়েছে। গজনীর প্রবেশমুখে মৎস্যকন্যা (জলপরী), ডাইনাসোরের প্রতিকৃতি, ড্রাগন ট্যানেল, দন্ডায়মান জিরাফ, পদ্ম সিঁড়ি, লেক ভিউ পেন্টাগন, হাতির প্রতিকৃতি, স্মৃতিসৌধ, গারো মা ভিলেজ, ওয়াচ টাওয়ার অন্যতম।
ভ্রমন পিপাসুদের জন্য গজনী অবকাশ কেন্দ্রে রয়েছে ক্রিন্সেন্ট লেক, লেকের ওপর রংধনু ব্রীজ, কৃত্রিম জলপ্রপাত, শিশু পার্ক, কবি নজরুল ইসলাম ও কবি রবীন্দ্র নাথ ঠাকুরের স্মৃতিফলক, মাটির নিচে এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে যাতায়তের জন্য ড্রাগন ট্যানেল মুখের ভিতর দিয়ে পাতালপুরি, লাভলেইন, কবিতাবাগ।
অবকাশ কেন্দ্রে অন্যতম আকর্ষণ সাইট ভিউ টাওয়ার। ৮০বর্গফুট উচ্চ এ টাওয়ারে উঠলে দেখা যাবে পাহাড়ী ঢিলার অপরূপ বৈচিত্রময় দৃশ্য।
গজনী অবকাশে আগতদের খাবার পরিবেশনে ব্যাক্তি উদ্যোগে ইতোমধ্যে খাবার হোটেল গড়ে উঠেছে বেশ কয়েকটি। এর মধ্যে অবকাশ বিরিয়ানী হাউজ ও পাঠান কনফেকশনারী অন্যতম। পাহাড় ঘুরে ক্লান্ত হয়ে গেলে দুপুরের খাবার অথবা স্ন্যাক্সের জন্য এসব দোকানে পাবেন কোমল পানীয়, কফি, ফাস্টফুড ও দুপুরের খাবার। এর পাশাপাশি জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে এবার থেকে নির্দিষ্ট স্থানে আগতদের রান্নার জন্য সুব্যবস্থা করা হচ্ছে।
শীত শুরু হওয়ার সাথে সাথে গজনী অবকাশে ভ্রমণপিপাসুদের পদচারণাও শুরু হয়েছে। প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বনভোজন বা শিক্ষা সফরে আসা শুরু করেছে। সেই সাথে বেচা কেনা বাড়ছে স্থানীয় দোকানগুলোতে।
সোমবার (১৩ নভেম্বর) সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান থেকে ভ্রমণপিপাসুরা এসেছেন গজনী অবকাশ দেখতে। কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরাও এসেছেন শিক্ষা সফরে।
ঘুরতে আসা নাহিদা সুলতানা বলেন, গারো পাহাড়ের নাম অনেকবার শুনেছি, এবারে নিজে চোখে দেখতে এলাম। খুব সুন্দর জায়গা। নিরাপত্তা ব্যবস্থাও বেশ ভালো।
রাত্রিযাপনের কোন সুযোগ না থাকায় আক্ষেপ করে আলোকচিত্রী নাইম ইসলাম বলেন, আমি শখের বশে ছবি তুলি। এর আগে একবার খুব অল্প সময়ের জন্য গজনীতে এসেছিলাম। তবে এবারে অনেক সকালে এসেও সব ছবি তুলতে পারিনি। এখানে যদি কোন আবাসিক হোটেল থাকতো তাহলে আজ রাতটা থেকে কাল আরো কিছু ছবি তুলতে পারতাম।
একই সুরে সুর মিলিয়ে ব্যাংকার সজীব ইসলাম বললেন, আমি এসেছি বরিশাল থেকে। পার্শ্ববর্তী ইকোপার্ক ঘুরে গজনীতে আসতে বিকেল হয়ে গেছে কিন্তু সব দেখা শেষ হয়নি। ভালোমানের হোটেল থাকলে রাত্রি যাপন করে আগামীকাল বাকীটা ঘুরে দেখা যেত।
টাঙ্গাইল থেকে আগত দিদার আহমেদ শেরপুর টাইমসকে বলেন, আমরা শেরপুর হয়ে লোকাল বাসে ও সিএনজি করে এসেছি। সন্ধ্যা নামতে আর কিছুক্ষণ বাকী। সাথে গাড়ী না থাকায় গাড়ী ম্যানেজ করতে বেগ পেতে হচ্ছে। জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে পরিবহনের বিশেষ সার্ভিসের বা নির্দিষ্ট মাইক্রো বা সিএনজি চালকের ফোন বুক থাকতো, তাহলে সহজেই গাড়ী ম্যানেজ করা যেতো।
গজনী অবকাশের এই নতুন রুপদান আর জেলা প্রশাসকের আন্তরিকতার প্রতি কৃজ্ঞতা জানিয়েছেন স্থানীয় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা।
পাঠান কনফেকশনারীর রতন মিয়া বলেন, এখনকার ডিসি স্যারের সহযোগিতায় গজনী অনেক সুন্দর ফুটে উঠেছে। আশা করি গতবারের চাইতে এবারে অনেক বেশি মানুষ আসবে। আমাদের বিক্রিও বাড়বে।
নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক এক ইজারাদার শেরপুর টাইমসকে বলেন, যদিও এবার বেশি টাকায় ইজারা নিয়েছি, তবে এবারের সিজনে অনেক বেশি মানুষ আসার সম্ভাবনা আছে। তাই লস হবেনা ইনশাআল্লাহ।
মিনিবাস ও ছোট গাড়ীর পার্কিং এর ইজারাদার ফারুক মিয়া শেরপুর টাইমসকে বলেন, এর আগের সময়গুলোতে দিনে প্রায় আড়াইশ থেকে চারশ বাস, ২শ থেকে ৩শ মিনিবাস আর মাইক্রো গজনী ঢুকতো। গত ২ বছর একটু কম আসছে। কিন্তু এবার নতুন কাজ হওয়ায় ধারনা করতেছি, এবারো আগের মতই অনেক গাড়ী আসবে।
গজনী অবকাশের এই নতুন রুপে সজ্জিত হওয়া ও প্রশাসনের সহযোগিতার ব্যপারে স্থানীয় সরকারের উপ-পরিচালক (উপসচিব) ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক এটিএম জিয়াউল ইসলাম শেরপুর টাইমসকে বলেন, গারো পাহাড়ে ঘেরা গজনী অবকাশ ভ্রমণ পিপাসুদের পছন্দের একটি জায়গা। তাই এর রক্ষণাবেক্ষনের জন্য জেলা প্রশাসন যথেষ্ট আন্তরিক। পুরোনো আয়োজনের পাশাপাশি আগতদের জন্য নতুন নতুন স্থাপনা ও ভাস্কর্য তৈরী হচ্ছে। আগতদের জন্য একটি মোটেল তৈরীর প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। প্রস্তাবটি পাশ হলেই আগতদের রাত্রি যাপনের সুযোগ হবে।
শেরপুর জেলা প্রশাসক ড. মল্লিক আনোয়ার হোসেন শেরপুর টাইমসকে বলেন, শেরপুর জেলাকে পর্যটন এলাকা হিসেবে তুলে ধরতে জেলা প্রশাসন নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। দীর্ঘ সীমান্ত সড়ক তৈরীর ফলে গজনী অবকাশে যাতায়াত আরো সহজ হয়েছে। খুব সহজেই দেশের যেকোন প্রান্ত থেকে মানুষ এখানে আসতে পারছেন। এখানে আগত দর্শণার্থীদের জন্য নতুন বেশ কিছু আইটেম সংযোজন হচ্ছে, যা ভ্রমণ পিপাসুদের নতুন অভিজ্ঞতা সঞ্চারে সাহায্য করবে। শেরপুরকে পর্যটনের মাধ্যমে ব্র্যান্ডিং করতে জেলা প্রশাসনের পাশাপাশি স্থানীয় জনগণের সহযোগিতাও প্রয়োজন।
পর্যটনকে উপজীব্য করে ব্যান্ডিং হচ্ছে শেরপুর জেলা। পুরোনো স্থাপনায় নতুন রঙের আঁচড়ের পাশাপাশি নতুন স্থাপনাগুলোর নির্মাণকাজ শেষ হলে নতুন সাজে সাজবে গারো পাহাড়ে ঘেরা গজনী অবকাশ কেন্দ্র। নিরাপত্তা ব্যবস্থা স্বাভাবিক থাকলে আর বিগত কয়েক বছরের মত দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা না থাকলে এই মৌসুমে বিপুল সংখ্যক দর্শণার্থীদের পদচারণায় মুখরিত হবে গজনী অবকাশ কেন্দ্র এমনটাই প্রত্যাশা সংশ্লিষ্টদের।