‘বসন্ত বাতাসে গো
বসন্ত বাতাসে
বন্ধুর বাড়ির ফুলের গন্ধ
আমার বাড়ি আসে…।’
বছর ঘুরে প্রকৃতির নানা পরিবর্তন পেরিয়ে আবার এসেছে বসন্ত। বসন্তের আগমনে মানুষের মন আর প্রকৃতিতে লেগেছে পরিবর্তনের ছোঁয়া। মানুষের মনে জাগছে আনন্দ-জোয়ার আর প্রকৃতি ধারণ করছে রূপলাবণ্যে ভরা মনোহর পরিবেশ।
গণমানুষের কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ভাষায়: ‘ফুল ফুটুক আর নাই ফুটুক/ আজ বসন্ত…’ – ফুল ফুটুক আর নাই ফুটুক, আজ বসন্ত।এমন মধুর সময়ে প্রকৃতি আর প্রাণের আপন উচ্ছ্বাস আর উৎসবে মেতে ওঠার মাহেন্দ্রক্ষণ এলো।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ তার বন্দনায় লিখেছেন, ‘আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে।/ তব অবগুণ্ঠিত কুণ্ঠিত জীবনে/ কোরো না বিড়ম্বিত তারে।
’জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায়,‘এলো খুনমাখা তূণ নিয়ে/ খুনেরা ফাগুন…।’
শিমুল-পলাশের রক্তিম আভা নিয়ে আগমন ঘটবে ফাল্গুনের। শীতের শেষে বসন্তের আগমণ। প্রকৃতির পরিবর্তনে শোক-তাপ, হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে সবাই মেতে উঠুক বসন্তের আবাহনে। বাংলা পঞ্জিকা অনুযায়ী ফাল্গুন ও চৈত্র মাস বসন্তকাল। কোকিলের কুহুকুহু গান, আর তরুণ-তরুণীদের বাসন্তী রংয়ের পোশাক পরে উৎসবে মেতে ওঠার ক্ষণ। কচি পাতায় আলোর নাচন, হৃদয়ের উচাটন আর ফুল ফোটার পুলকিত দিন বসন্ত। বন-বনান্তে, কাননে কাননে-পারিজাতের রঙের কোলাহল, আর বর্ণাঢ্য সমারোহে অশোক-কিংশুকে বিমোহিত ।
প্রকৃতি সেজেছে বর্নিল অবগাহনে। সুপ্রাচীন কাল থেকে ফাগুন মানেই আমাদের কাছে ভালোবাসার আহবান। ফাগুন মানে পায়ে আলতা, ফাগুন মানেই রমনীর খোঁপায় নতুন ফুলের ছোঁয়া। এই ফাগুন কত যে ফুল ফোটায়! বাতাসে মিশিয়ে দেয় নিজের গন্ধ, ছন্দ ও আনন্দ। প্রকৃতি মাতোয়ারা হয়। অধিকাংশ পাখির বুকের ভেতরে প্রেম জাগে, আনন্দে গলা খুলে গান গায়, জুটি বাঁধে ও মৌ মৌ প্রেমে মশগুল হয়। বসন্ত জীবনের প্রতীক। বসন্ত যৌবনের প্রতীক। ভালোবাসার প্রতীক।
অতি মঞ্জুল, শুনি মঞ্জুল গুঞ্জন কুঞ্জে শুনিরে/ শুনি মর্মর পল্লবপুঞ্জে, পিক কূজন পুষ্পবনে বিজনে, মৃদু বায়ু হিলোলবিলোল বিভোল বিশাল সরোবর-মাঝে কলগীত সুললিত বাজে/ শ্যামল কান্তার-’পরে অনিল সঞ্চারে ধীরে রে, নদীতীরে শরবনে উঠে ধ্বনি সরসর মরমর। কত দিকে কত বাণী, নব নব কত ভাষা, ঝরঝর রসধারা…।
ঋতুরাজ বসন্তের দিনগুলো অপার্থিব মায়াবী এক আবেশ ঘিরে রইবে বৃক্ষ, লতা, পাখ-পাখালি আর মানুষকে। এ ফাগুন সুখের মতো এক ব্যথা জাগিয়ে দেবে চিত্তে: ‘এতটুকু ছোঁয়া লাগে, এতটুকু কথা শুনি/তাই দিয়ে মনে মনে রচি মম ফাল্গুনী..। মন রাঙিয়ে গুন গুন করে অনেকেই গেয়ে উঠবেন- ‘মনেতে ফাগুন এলো..’। অথবা ‘পলাশ ফুটেছে, শিমুল ফুটেছে, এসেছে দারুণ মাস…কৃষ্ণচূড়া লাল হয়েছে ফুলে ফুলে, তুমি আসবে বলে..।’
ফাল্গুনের আরেক পরিচয় ভাষা শহীদদের তপ্তশোতিক্ত মাস। ঊনিশশ’ বায়ান্ন সালের একুশে ফেব্রুয়ারি অর্থাৎ আটই ফাল্গুন মাতৃভাষা ‘বাংলা’ প্রতিষ্ঠার জন্য রফিক, সালাম, জববার প্রমুখ বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছিল। বারবার ফিরে আসে ফাল্গুন, আসে বসন্ত। শোক নয়, সাম্রাজ্যবাদী ও আধিপত্যবাদী মোকাবিলার দুর্বিনীত সাহস আর অপরিমেয় শক্তি নিয়ে। বীর সন্তানদের অমর গাঁথা নিয়ে। যে কোন বিচারে এ এক অনন্য মাস, ঋতু। নৈসর্গিক ক্যানভাসে রক্তাক্ত বর্ণমালা যেন এঁকে দেয় অনির্বচনীয় সুন্দর এক আল্পনা। প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠে উদার সড়কের বুকে। দেয়ালগাত্র থেকে লোহিত ধারার মোহনা শহীদ মিনার পর্যন্ত।
আজ থেকে ১৮ বছর আগে বঙ্গাব্দ ১৪০১ সাল থেকে প্রথম ‘বসন্ত উৎসব’ উদযাপন করার রীতি চালু হয়। সেই থেকে জাতীয় বসন্ত উৎসব উদযাপন পরিষদ বসন্ত উৎসব আয়োজন করে আসছে।