সমকালীন মহানায়ক থেকে মহাকালীন মহানায়ক হতে তাকে জিততে হবে একটা ম্যাচ। এটা ফুটবলীয় কোনো বিচার হতে পারে? কিন্তু বিশ্বকাপ ফুটবলের অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যতকে আবেগের এক মোহনায় এনে মিলিয়ে ফেলছেন সবাই। হ্যাঁ, আমজনতা থেকে ফুটবল বিশেষজ্ঞ— সবাই রোববারের ফাইনালকে লিওনেল মেসির জীবনের অগ্নিপরীক্ষা মনে করছেন। মেসির হাতে বিশ্বকাপ দেখতে চাই। এটা যেন ঈশ্বরের কাছে ফুটবল বিশ্বের আর্তি!
তাহলে কী দাঁড়ালো? একটা ফাইনাল জয় লিওনেল মেসির বাকি বিশ বছরের সব অর্জনের চেয়ে অনেক বড়। রোববার ফরাসিদের বিপক্ষে ফাইনাল না জিতলে মেসির সব অর্জন পারস্য উপসাগরে বিসর্জন হয়ে যাবে? মেসি ভক্ত, আর্জেন্টিনা সমর্থক এবং ব্রাজিল বা অন্য দেশের সমর্থকরা এই জায়গায় সম্মিলিত আওয়াজ তুলবেন হ্যাঁ, তাই।
কিন্তু কেন জানেন? মেসি কাপ না জিতলে অন্যকে সেরার বেদিতে বসিয়ে রাখা যাবে। সেটা মেসির দেশ থেকে পাশের দেশের মানুষের এই এজেন্ডা আছে।
মেসির দেশের লোকরা বলতে পারবেন, ডিয়েগো বিশ্বকাপ জিতেছে। লিও আমাদের কাপ এনে দিতে পারেনি। তাহলেও কিসের সেরা? ব্রাজিলিয়ানরা বলতে পারবেন, আমাদের পেলে তো অনেক দূর গ্রহের। রোনালডো, রিভালদো, কাকা, কাফু রোনালদিনহো, রোমারিও, বেবতোও কাপ এনে দিয়েছেন দেশকে। মেসি কি পেরেছেন? এদের কথা শুনে মনে হবে, একটু পর গ্রেটের তালিকায় দুঙ্গার নামটাও বসিয়ে দেবেন। দুঙ্গা যুক্তরাষ্ট্রে কাপ উঁচিয়ে ধরেছিলেন সক্রেটিসের ভাই রাইয়ের জায়গায় অধিনায়কের আর্ম ব্যান্ড পরার সুযোগ পেয়ে।
ব্রায়ান লারা বিশ্বকাপ জিততে পারেননি। তাতে কি তার গ্রেটনেস কমে যাবে? তার জন্য কি কাপ জয়ী গৌতম গম্ভীরকে লারার পাশে গ্রেটের তালিকায় বসিয়ে দেওয়া যাবে?
আবার ফকল্যান্ড যুদ্ধ আর ম্যারডোনার শতাব্দী সেরা গোলের কথা মাথায় রেখে ব্রিটিশ মিডিয়া বলছে কাপটা মেসির হাতে ওঠা উচিত। এই উচিত চাওয়ার পেছনেও কমপক্ষে দুটো কারণ। এক. তাহলে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ফুটবল মাঠে ম্যারাডোনার নেয়া সেই প্রতিশোধের স্মৃতি কিছুটা ভুলিয়ে দেওয়া যাবে। বলা হবে ডিয়েগোর চেয়ে মেসি এগিয়ে। তিনি-ই সেরা। আর না পারলে বলা যাবে, পেলের আশেপাশে কেউ নেই। মেসির হাতে কাপ দেখার এই আর্তির মাঝেও অনেক কূটনৈতিক ভাষা আছে। নিছক আবেগ শুধুমাত্র আর্জেন্টিনা সমর্থক বাঙালির চাওয়াতে।
মেসির কাপ জয়ের জন্য ঈশ্বরের কাছে এতো মানুষ প্রার্থনা করছেন, যা দেখে মনে হয়, মেসি একাই খেলবেন। বাকিরা মাঠে নামবেন একশ বিশ গজে বাইশজন ফুটবলারের সংখ্যা মেলানোর জন্য।
ধরে নিলাম মেসি কাপ হাতে নিতে পারলেন না। তাতে কি তার জেতা ব্যালন ডি’অরগুলো, চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ট্রফিগুলো, লা-লিগার শিরোপাগুলো, কোপা আমেরিকা— এসব আটলান্টিকে ভেসে যাবে? না, যাবে না। তবে তিনি সর্বকালীন সেরাদের সনদপত্র পাবেন না। এটাও ঠিক। মেসি নিজেও জানেন।
মেসির হাতে বিশ্বকাপ ওঠা মানে অনেক বিতর্কের মীমাংসা হয়ে যাওয়া। তারপরও একটা প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে, ফুটবলে বিশ্বকাপই কি সব? কাপ তো অনেকেই জিতেছেন। কিন্তু কজনকে মনে রেখেছে ফুটবল বিশ্ব? কাপ জয়ীদের কজন দাবি রাখেন সর্বকালের সেরাদের তালিকার থাকার। আঙুলের কর গুনে দুটোর পর তৃতীয় নাম পাওয়া যায় না। কিন্তু কাপ না জিতে মেসি কিন্তু ওই তালিকায় থাকার জোরালো দাবিদার। কারণ লিওনেল মেসি প্রান্ত বরাবর থেকে বাঁ মাঝ মাঠ দিয়ে দৌড়ালে পৃথিবীর অর্ধেকেরও বেশি মানুষের স্বপ্ন দৌড়ায়। মেসি দৌড়ালে মনে হয় পৃথিবীটা খুব সুন্দর।
কিন্তু বিশ্বকাপ দিয়ে যদি সব মূল্যায়ন হতো তাহলে ব্রাজিলের প্রথম বিশ্বকাপ জয়ে পেলেকে পেলে বানালেন যিনি সেই ‘লিটল বার্ড’ গারিঞ্চা? যিনি ’৬২-এর বিশ্বকাপ জেতালেন, ফুটবল সমাজ তাকে কী মূল্যায়ন করেছে? পেলে বলেন, ব্রাজিলের সাবেক অনেক ফুটবলারও বলেন, গারিঞ্চা পেলের চেয়ে বেটার ফুটবলার ছিলেন। গারিঞ্চার সেই বিখ্যাত বডি ফেইন্টিং! ডিফেন্ডাররা যা ভাবতেন শরীর ঠিক তার উল্টো দিকে ঘুরে যেতো। ব্রাজিলকে দুই দুটো বিশ্বকাপ জেতানো অসম্ভব প্রতিভাবান ফুটবলারকে বিশ্ব সেভাবে মনে রাখলো কোথায়? রিও ডিজেনিরিও থেকে পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরে এক অজপাড়াগায়ে হলুদ-সবুজ জার্সির সেই লোকটার সমাধি রংচটা কাঠ দিয়ে ঘেরা থাকবে কেন। বাড়ির কেন জীর্ণ দশা। যদিও তার নামে গ্রামে একটা স্কুল আছে। আর সমাধির গায়ে লেখা ‘ধন্যবাদ। অফুরন্ত আনন্দ দেওয়ার জন্য অসীম কৃতজ্ঞতা।’
’৫৮-এর ফাইনালে সুইডেনে যখন এগিয়ে যায়, গারিঞ্চার একের পর এক ডজ ম্যাচ ঘুরিয়ে দেয়। আর ’৬২-তে নাকি প্রায় একাই ব্রাজিলকে জিতিয়েছেন। তবে ভাগ্যকে তিনি ডজ দিতে পারেননি। আসলে বিশ্বকাপ জেতা মানে সব নয়। আবার বিশ্বকাপ জিততে ভাগ্যও দরকার।
রোববার ফাইনাল জিতলে হয় তো ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানিয়ে মেসি বলবেন, ‘শুধু তুমি জানতে আর জানতাম আমি।’ তবে সর্বকালের সেরাদের সরণিতে দাঁড়িয়ে মেসি। দৌড় শুরুর অপেক্ষা। কাতার বিশ্বকাপ জিতলে ফুটবলের সর্বকালের মহানায়ক তিনি। পেলে, ম্যারাডোনা আগামী প্রজন্মের কাছে পেছনে পড়ে থাকলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। ব্রাজিলের দুই দুটো বিশ্বকাপ জয়ের নায়ক গারিঞ্চা যদি কাকা, কাফু, কারলোস, রোনালদোদের আড়ালে চলে যান, তাহলে জিতলে মেসির কারণে অনেকে সিংহাসনচ্যুত হবেন। স্বর্গে বসে কেউ নড়েচড়ে উঠবেন। আর গারিঞ্চা হয়তো স্বর্গ থেকে তার এক টিমমেটকে বলবেন, ‘জীবদ্দশায় অনেক হিসাব মিটিয়ে আসতে হচ্ছে, বুঝতে পারলে!’
তাই সর্বকালীন মহানায়ক হতে বিশ্বকাপ জয় সত্যিই খুব জরুরি? তাহলে ব্রাজিলের দুটো কাপ জয়ের নায়ক আলোচনায় উপেক্ষিত থেকে যান কীভাবে? সর্বকালীন হতে হলে শুধু বিশ্বকাপ জয় নয় প্রতিভা, দক্ষতা আর ভাগ্য লাগে। গারিঞ্চার সঙ্গে ভাগ্য ছিল না। তাই জীবনের খাজনা মেটাতে হয়েছে তাকে অন্যভাবে।