সময়, স্রোত কারও জন্য অপেক্ষা করে না। সময়ের তালে সময় গড়ায়, বর্তমানও ক্ষণিকেই হয়ে যায় অতীত এটাই বাস্তবতা। গত বছরের ৭ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় শ্যামলবাংলাটুয়েন্টিফোরডটকম অফিসে সম্পাদক-প্রকাশক রফিকুল ইসলাম আধার, তৎকালীন নির্বাহী সম্পাদক শাহ আলম বাবুলসহ আমরা সকলেই কর্মব্যস্ত থাকাবস্থায় একটি অপরিচিত মোবাইল কলে জানতে পারি আমার বড়ভাই একটি শালিস বৈঠকে হঠাৎ হার্টস্ট্রোকে আক্রান্ত হয়েছেন। এমনি অবস্থায় তাকে নিয়ে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চলে যাই। পরে তাকে মেডিসিন বিভাগে ভর্তি করা হয়।
প্রভাতের রবি, রাতের জোৎস্না, ভোরের শিশির, ঝরনার কলতান, সাগরের মাতাল ঢেউ, পাখির গুঞ্জন, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও ঐশ্বর্য সকলকে বিমোহিত করে। তেমনি সমাজ সংসারে এমন কিছু মানুষ জন্মায়, যাদের মুক্ত ভাবনা, সরল আদর্শ মানুষকে উজ্জীবিত করে, বিমুগ্ধ করে, অনুপ্রাণিত করে যুগে যুগে। তাদের জীবন দর্শন ও জীবনালেখ্যে সমাজ-সংসার খুজে পায় আলোকিত পথ। কিন্তু আমরা আমাদের দৈনন্দিন অবিবেচক কর্মকান্ডের দ্বারা সে সকল আলোকিত মানুষের সৃষ্টি সুপ্ত উর্বর ভূমিকে কলংকিত করছে প্রতিনিয়ত। ফলে সামাজিকতার নৈতিক অবক্ষয়, ধর্মীয় চরম উন্মাদনা ও রাষ্ট্রীয় জীবনে দেখা দেয় চরম বিশৃংখলা।
এমনি এক অনুসরণীয় সত্য-সরল আদর্শ কর্মবীর যিনি আজ দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করে চলে গেছেন না ফেরার দেশে। সাংবাদিক, সাহিত্যিক, সংস্কৃতিকর্মী, রাজনীতিক ও শিক্ষকÑ যাকে নানা অভিধায় মূল্যায়ন করা যায়। দীর্ঘ বিরতি বিরহ পেরিয়ে যাকে নিয়ে লেখা, তিনি আমাদের শাহ আলম বাবুল ভাই। প্রয়াত শাহ আলম বাবুল ভাইয়ের দীর্ঘ কর্মময় বাস্তব জীবনের মূল্যায়ন করার মতো যোগ্য ব্যক্তি আমি নই। তবুও নিজ দায়ভার থেকে কিছুটা মুক্ত হওয়ার জন্যই আজকের এই লেখা। তিনি ছিলেন আমার প্রিয়ভাজন শ্রদ্ধেয় অনুসরণীয় বড়ভাইয়ের প্রতীক। এরই ধারাবাহিকতায় তারই উৎসাহ-উদ্দীপনা তথা পুনঃপুন তাগিদে সাংবাদিক-সংগঠক আধার ভাইয়ের সম্পাদনা ও প্রকাশনায় ২০১৩ সালের ৩১ জুলাই আনুষ্ঠানিকভাবে অনলাইন নিউজপোর্টাল ‘শ্যামলবাংলা২৪ডটকম’র আত্মপ্রকাশ। এতে আমাদের প্রিয় শাহ আলম বাবুল ভাই ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা নির্বাহী পরিচালক। শ্যামলবাংলা২৪ডটকম’র বার্তা সম্পাদক হওয়ার সুবাদে তার সাথে আমার হৃদয়ঙ্গম ঘটে। তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় মেধা ও মননশীলতায় প্রতিষ্ঠিত শ্যামলবাংলা২৪ডটকম’ ৩১ জুলাই ২০১৫ ৩য় বর্ষে পদার্পণ করেছে। কিন্তু তিনি আজ আমাদের মাঝে নেই। তার শূন্যতা আজ আমরা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করছি।
জীবন সায়াহ্নের শেষ দিকে তিনি শ্যামলবাংলা২৪ডটকম’কে মনে করতেন সেকেন্ড হোম। প্রতিদিন স্কুল শেষে বিকেল বেলায় নিজ কর্তব্যের তাগিদেই চলে আসতেন অফিসে। এটি ছিল তার নিত্য দিনের রুটিন। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর আপডেট করতেন। ভাবতেন শ্যামলবাংলার ভবিষ্যত নিয়ে। চলাফেরায় ছিল না কোন গাম্ভীর্য। স্বভাবে তিনি ছিলেন চাপা। সমাজ-সংসারের জন্য নিরলসভাবে কাজ করেও তিনি ছিলেন প্রচারবিমুখ। অনেক সময় তাকে নিঃসঙ্গ মনে হতো। কিন্তু কিছু জিজ্ঞেস করলে এড়িয়ে যেতেন তিনি। স্বল্প বেতনের স্কুল শিক্ষক বাবুল ভাই সীমিত আয় দিয়েও স্বাচ্ছন্দ্যে জীবন-যাপন করতেন। এ বিষয়টি বিশেষ করে আমি তার ব্যক্তিগত জীবন থেকে শিক্ষা নিয়েছিলাম। সাদামাটা জীবন যে কত আনন্দের হতে পারে, তা বাবুল ভাইকে দেখেই উপলব্ধি করেছি।
অল্প সময়ে তার স্নেহধন্য হওয়ায় অনেক স্মৃতিময় ঘটনায় নিজেকে সম্পৃক্ত করতে না পারলেও মৃতক্ষণে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ওই গুণি মানুষটির শয্যাপাশে দাঁড়াতে পেরে ধন্য হয়েছি। তবে সেই দুঃসহ স্মৃতি আমাকে আজও বিতাড়িত করে, ঘুমোতে দেয় না। নীরবেই নেমে আসে দু’চোখ বেয়ে অশ্রুবন্যা। সেই স্মৃতি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদায় আমাকে। পরিবার-সংসার-সমাজের পাশাপাশি মহান পেশা শিক্ষকতা আর সাহিত্য-সাংবাদিকতা ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে তার পথচলা নিভৃত হলেও নিজের গড়া অঙ্গণ ছিল আলোকিত- যা তাকেই খোঁজে; যে অঙ্গণে তিনি মৃত্যুর মাত্র ৪ দিন আগেও (৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ শনিবার রাত ৭টা পর্যন্ত) ছিলেন সচল-কর্মব্যস্ত। সেই তিনি ৭ ফেব্রুয়ারি মধ্যরাতে হঠাৎ ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে শরীরের অর্ধাংশ নিশ্চল আর মূক হয়ে আশ্রয় নেন ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউ’তে। তাকে পেয়ে বসে স্বভাবসুলভ ন্স্তিব্ধতার পাথর। অবশেষে সেই নিস্তব্ধতার কঠিন পাথরে লীন হয়ে চলে গেলেন না ফেরার দেশে, চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন পশ্চিম ঝিনিয়া নিজ বাড়ির আঙিনায়।
তার মৃত্যুকালে একখন্ড ভিটেমাটি ছাড়া কোন সহায়সম্পদ নেই। বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতার বেতনেই কষ্টে চলতো তার ৫ সদস্যের পরিবার। তার অকাল মৃত্যুতে এখন শিক্ষার্থী দুই মেয়ে ও এক ছেলে যথাক্রমে শেরপুর সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণীর মেধাবী শিক্ষার্থী জান্নাতুল ফেরদৌসী শাম্মী এবং আইডিয়াল প্রিপারেটরি এন্ড হাইস্কুলের পঞ্চম শ্রেণীর শিক্ষার্থী সাঈয়িদা তাসনিম তনু ও দ্বিতীয় শ্রেণীর শিক্ষার্থী আবু তালহা নীরবের পড়াশোনার ব্যয়সহ সংসারের ব্যয় নির্বাহ এখন বিধবা গৃহিণী স্ত্রী মুশরিনা জান্নাতের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়েছে। ফলে পুরো পরিবারেই নেমে এসেছে অমানিশার ঘোর অন্ধকার। ব্যক্তি জীবনে শত অভাব অনটনের মাঝেও ভাবনায় যার ছিল সামাজিক ও ধর্মীয় গোঁড়ামী থেকে মুক্তি, রাষ্ট্রের কাছে চাওয়া ছিল যার ধনী-দরিদ্রের সম অধিকার, কর্তব্যনিষ্ঠায় ও নিজ আদর্শে আমৃত্যু যিনি ছিলেন অনড় , আজ তার অসহায় পরিবারের দায় কি আমাদের সমাজ-রাষ্ট্রের উপর বর্তায় না? নিশ্চয় বর্তায়। এজন্য আমাদের সকলের ওই অসহায় পরিবারটির প্রতি সদয় দৃষ্টি রাখা দরকার। আমরা যারা সমাজ বিনির্মাণের ভাবনা ভাবি, তাদের সকলেরই একই পরিণতি হবে হয়তো। স্ত্রী-সন্তানদের জন্য রেখে যেতে পারব না সহায়-সম্পদ। তবে মরণে বেঁচে থাকার আকুতি আমাদের; তোমাদের মাঝে।
মোহাম্মদ জুবায়ের রহমান, নির্বাহী সম্পাদক, শ্যামলবাংলা২৪ডটকম