রমজানের পূর্বাভাস নিয়ে হাজির হওয়া শাবান মাস ক্রমেই এগিয়ে যাচ্ছে সমাপ্তির দিকে। ক্ষমার মহান বারতা নিয়ে স্বমহিমায় হাজির হচ্ছে পবিত্র মাহে রমজান। দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ছে রমজানের আগমনী বার্তা। মুমিনের হৃদয়ে হৃদয়ে রমজানের চাঁদের প্রতীক্ষা ও ব্যাকুলতা। রমজান মাসে প্রতিটি ইবাদতের সওয়াব বহুগুণে বাড়িয়ে দেওয়ার পাশাপাশি মুমিনের জীবনকে বদলে দেওয়ার যে মহা সুযোগ আসে এ মাসেÑ তা যেন কিছুতেই হাতছাড়া না হয় সে জন্য প্রয়োজন প্রস্তুতি নেওয়ার। প্রতিটি মুসলমানের উচিত নিজেদেরকে আল্লাহর কাছে নিবেদন করতে রমজানের আগেই যথাযথ প্রস্তুতি গ্রহণ করা। রমজানের প্রস্তুতির ক্ষেত্রে নিম্নের বিষয়গুলো খেয়াল রাখা যেতে পারে।
পারিবারিক প্রস্তুতিপরিবারের সদস্যদের রমজানের ইবাদতসমূহের প্রতি আগ্রহী করে তুলতে রোজার ফজিলতের হাদিস ও এর বিভিন্ন উপকারিতা তুলে ধরে খাবারের টেবিলে বা অন্য কোনো সুযোগে প্রতিদিন কিছু সময় ঘরোয়া তালিম হতে পারে। এ ব্যাপারে পিতা-মাতা গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করতে পারেন। এ বছর কোন সন্তানের ওপর রোজা ফরজ হলো তা ভেবে তাদের রোজা রাখতে বলা, যাদের ওপর এখনও রোজা ফরজ হয়নি কিন্তু কাছাকাছি চলে এসেছে তাদের অন্তুত দুয়েকদিন পরপর রোজা রাখিয়ে রোজায় অভ্যস্ত করে তোলা উচিত। রমজানের স্কুলগুলো বন্ধ থাকে। কোনো সন্তান কোরআন তেলাওয়াত না জানলে অথবা তেলাওয়াত অশুদ্ধ থাকলে তাকে এ সুযোগে শুদ্ধ তেলাওয়াত শেখানোর ব্যবস্থা গ্রহণ পিতা-মাতার দায়িত্ব। এ জন্য রমজানের আগেই শিক্ষক ঠিক করে রাখা উচিত। অন্তত নামাজ পড়ার জন্য জরুরি পরিমাণ সুরা ও নামাজের মাসায়েল ভালোভাবে শেখানো এ রমজানেই নিশ্চিত করা চাই। পরিবারের প্রতিটি সদস্যই যেন রমজানে কোরআন তেলাওয়াতের অভ্যাস গড়ে তোলেন সে জন্য পরিবারপ্রধান তাদের উৎসাহিত করবেন। অনৈসলামিক টিভি প্রোগ্রামমুক্ত পরিবার গঠনের সিদ্ধান্তও নিতে হবে রমজান থেকে। সন্তানরা যেন ফেসবুক-টিভিতে অযথা সময় নষ্ট না করে ইবাদতে মনোযোগী হয় সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে।
পরিবারপ্রধান ও গৃহিণীর প্রস্তুতিপরিবারপ্রধানের উচিত হবে রমজানের আগেই প্রয়োজনীয় বাজার সদাই করে রাখা। যেন রমজানের সময়গুলো নির্বিঘেœ ইবাদতে মশগুল থাকা যায়। রমজানে বাজার করতে গেলে অনেক সময় শারীরিকভাবেও ক্লান্তি বয়ে আনে। পরিবারের সদস্যদের ওপর থেকেও কাজের চাপ কমিয়ে দেওয়া।
সাহরি ও ইফতার ব্যবস্থাপনা নিশ্চই সওয়াবের কাজ। তবে এগুলোতে লিপ্ত থেকে যেন নিজের ইবাদতে ব্যাঘাত না ঘটে সেদিকে প্রতিটি গৃহিণীর খেয়াল রাখা উচিত। কঠিন কোনো কাজ রমজানের জন্য ফেলে না রেখে আগে থেকেই এমন একটি পরিকল্পনা করা যাতে সংসারের কাজ কিছুটা কমিয়ে সময় বের করে হলেও কিছু সময় কোরআন তিলাওয়াতের জন্য বরাদ্দ রাখা। কিছুতেই যেন ফরজ নামাজ, তারাবিহ ছুটে না যায় সেদিকে খেয়াল রাখা। সংযমের মাসে প্রতিটি গৃহিণীর উচিত অপব্যয় ও অপচয় পরিহার করে পরিবারের অতিরিক্ত খরচ কমিয়ে তা দান-সদকার মতো ভালো কাজে ব্যয় করার ক্ষেত্রে স্বামীকে সহযোগিতা করা।
সামাজিক প্রস্তুতি
রমজানের রোজা শুধু আমার একার নয়। রোজার উপকারের অংশ লাভ করবে সমাজের সব শ্রেণির মানুষ। গরিব, অসহায়, পথশিশু, রোজাদার, অসুস্থ, বৃদ্ধ দলমত গোত্র নির্বিশেষে সবাই রমজানের আয়োজনের ভাগ পাবে। তাই সামাজিকভাবে রমজানকেন্দ্রিক ভাবনা প্রয়োজন। সামাজিক পরিমÐলে রমজানের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে প্রতিবেশী ও সমাজের লোকজন একে অন্যের সঙ্গে দেখা হলে রমজানের বিভিন্ন ফজিলত ও ইতিবাচক দিক নিয়ে আলোচনা করে অন্যকে রোজার ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করা চাই। হোটেল ও চা স্টলগুলোতে দেখা যায় পর্দা লাগিয়ে খাবার ও আড্ডা হয়, এটা বন্ধ হওয়া কাম্য। মালিকপক্ষ যদি রমজান উপলক্ষে শ্রমিকদের ওপর থেকে কাজের বোঝা হালকা করে দেন তাহলে তাদের হোটেলে প্রবেশের প্রয়োজন হবে না। রমজানের পবিত্রতা রক্ষায় এ মাস আসার আগেই সামজিকভাবে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে যেন পুরো সমাজ হয় ইসলামবান্ধব।
চাকরিজীবীদের প্রস্তুতি
রমজান তো ভালো মানুষ হয়ে যাওয়ার ট্রেনিং কোর্স। চাকরিতে মালিককে না ঠকানো এবং ইবাদত ছেড়ে নিজেও না ঠকার প্রশিক্ষণ নিতে হবে রমজানে। অনৈতিক কোনো অভ্যাস থাকলে তা ছেড়ে দেওয়ার দৃঢ় সংকল্প করতে হবে। কর্মব্যস্ততার ভেতরেও কীভাবে বেশি ইবাদত করা যায় তা পরিকল্পনা করা উচিত। অফিসের কাজের ফাঁকে ও অফিসে যেতে যে সময় রাস্তায় কাটে তাও ইবাদতে ব্যবহার করতে মোবাইলে কোরআন শরিফসহ বিভিন্ন ইসলামিক অ্যাপস চালু করে তা কাজে লাগাতে পারেন।
ব্যবসায়ীদের প্রস্তুতি
ঈমানদারদের বেশি সওয়াব অর্জনের প্রতীক্ষার বিপরীতে এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী প্রস্তুতি নিতে থাকেন গণমানুষকে ঠকিয়ে বেশি লাভ করার। ভ্রাতৃত্ব ও সৌহার্দের প্রশিক্ষণের মাস রমজানে ভাতৃঘাতী ও নির্মমতার চর্চা করেন তারা। মজুদকরণ বা অপকৌশলে নিত্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে ‘বড়লোক’ হওয়ার স্বপ্নে বিভোর হন। তাদের লুটেরা মনোভাবের কারণে যুক্তিগ্রাহ্য কারণ না থাকলেও বাড়ে নিত্যপণ্যের দাম। চাল-ডাল, ছোলা, চিনি, ভোজ্যতেল, খেজুর ইত্যিাদির দাম হয় গগণচুম্বী। একজন মুসলমান ব্যবসায়ীর রমজানকেন্দ্রিক এমন প্রস্তুতি হতে পারে না। কারণ পণ্য মজুদকরণের মাধ্যমে দাম বাড়ালে সে ব্যবসায়ীর প্রতি আল্লাহ তায়ালা ক্ষুব্ধ হন এবং সম্পর্ক ছিন্ন করেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি চল্লিশ দিন খাদ্য মজুদ রাখল সে আল্লাহ থেকে নিঃসম্পর্ক হয়ে গেল, আল্লাহও নিঃসম্পর্ক হয়ে গেলেন তার থেকে।’ (মুসনাদে আহমাদ : ৮/৪৮১)। তাই একজন ব্যবসায়ীর উচিত রমজানকেন্দ্রিক এমন একটি পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি গ্রহণ করা, যেন তার ব্যবসা তাকে নামাজসহ অন্যান্য ইবাদত থেকে বিরত রাখতে না পারে আবার ব্যবসায় সব ধরনের হারামকে ‘না’ বলে আল্লাহর বান্দাদের জন্য সুলভ মূল্যে নিত্যপণ্য সরবরাহ করে ব্যবসাকেও যেন পরিণত ইবাদতে পরিণত করতে পারেন। দুনিয়াবী জীবনে ব্যবসায় আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে বরকত ও হাশরের ময়দানে নবীজির (সা.) সঙ্গী হওয়ার মতো ব্যবসার চর্চা করার প্রস্তুতি নিতে হবে ব্যবসায়ীদের।
আর্থিক প্রস্তুতি
রমজান আর্থিক ইবাদতেরও এক অপূর্ব সুযোগ। এ মাসে দৈহিক ইবাদতের মতো আর্থিক ইবাদতেও সওয়াব বেশি। আত্মীয়-স্বজনের কাছে ইফতারসহ নিত্যপণ্য কিনে পাঠানোর মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারি। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘কেউ কোনো রোজাদারকে ইফতার করলে সে উক্ত রোজাদারের সমান সওয়াব পাবে। তবে এতে সে রোজাদারের সওয়াব একটুও কমবে না।’ (তিরমিজি : ৩/১৭১)। তাই প্রতিটি মুসলমানের উচিত রমজানকেন্দ্রিক আর্থিকও একটা পরিকল্পনা করা। শরীর সুস্থ ও সবল রেখে বেশি বেশি ইবাদত যেন করা যায়Ñ সে জন্য পুষ্টিকর খাবার কিনে খাওয়ার চেষ্টা করা।
প্রয়োজনীয় জ্ঞানার্জনে প্রস্তুতি
প্রতিটি মুসলমানেরই উচিত রমজানের প্রয়োজনীয় মাসায়েল জেনে নেওয়া। প্রয়োজনে রমজানের আগেই এ বিষয়ক কিছু পুস্তক কিনে নেওয়া যাতে পরিবারের অন্যান্য সদস্যরাও তা পড়তে পারে। ইতিকাফ করতে আগ্রহীরা ইতিকাফের জন্য প্রস্তুতি নেবেন আগে থেকেই।
লেখক : যুবায়ের আহমাদ
খতিব, বাইতুশ শফীক মসজিদ
বোর্ড বাজার, গাজীপুর