ইতিহাস কখনও মুছে যায় না। তবে কিছুদিনের জন্য মাঝে মধ্যে আড়াল পড়ে থাকে। সে আড়াল থেকে আবারও উকি দেয় এবং সে ইতিহাস ক্রমাগত প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে স্মরনীয় হয়ে থাকে।
আঠার থেকে উনিশ শতক পর্যন্ত তৎকালের শেরপুর পরগনা বা বর্তমান শেরপুর জেলায় জমিদারদের দাপট ছিলো। এসব জমিদার বৃটিশ শসকদের অনুগত ছিলো। তৎকালের জমিদাররা শেরপুর অ লের শাসন ক্ষমতা বা জমিদারী ছড়ি কিভাবে চালাতো সে প্রসঙ্গে যাবো না। কারণ তৎকালের জমিদারদের শাসন বা ক্ষমতা নিয়ে রয়েছে নানা সমালোচনা।
জমিদারদের শাসন ব্যবস্থা যাই থাকনা কেন এই অ লে শিক্ষার বিস্তার ঘটাতে তাদের কার্পন্য ছিলো না। তার জলন্ত উদহারণ শহরের সরকারী ভিক্টোরিয়া একাডেমী, জিকে (গোবিন্দ কুমার) পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় ও নালিতাবাড়িতে হিরণ্ময়ী উচ্চ বিদ্যালয়সহ আরো অনেক প্রমান রয়েছে। শিক্ষার প্রসার ঘটার পাশাপাশি তৎকালে এ অঞ্চলের সাহিত্যাঙ্গনও ছিলো বেশ মজবুদ।
তৎকালে খোলা ময়দানে নারী স্বাধিনতার অবস্থা যাই ছিলো না কেন জমিদার বাড়ির ইট-শুড়কির তৈরী প্রাচিরের ভিতরেও নারী সাহিত্যের জাগরণ ঘটা নেহায়েত কম কথা নয়। শেরপুরের তৎকালের জমিদার হরচন্দ্র চৌধুরীর তৃতিয় পুত্র হেমাঙ্গ চৌধুরীর স্ত্রী ছিলেন হিরণ্ময়ী চৌধুরী।
শেরপুরের সাহিত্যাঙ্গন নিয়ে অনুসন্ধানী কাজ করছেন শেরপুর সরকারী বালিকা বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক কবি, সাহিত্যিক ও আলোচক জ্যোতি পোদ্দার। তার অনুসন্ধানী লেখা ‘শেরপুর পরগনার কচড়া’ লেখায় উল্লেখ করেছেন,‘অন্তপুর বাসিনীর হয়েও তিনি স্থানীয় বিভিন্ন কল্যাণমুলক কাজে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন। সামন্ততান্ত্রিকতার ভিতর নারীর ভূমিকা কেবলই সেবিকা-আলাদা করে স্বীকৃতি দেবার ক্ষেত্রে সামন্ত জমিদার কুন্ঠিত। কেননা
এক মাত্র তারামণি ছাড়া আর কোন অন্তপুর বাসিনীর নামে কোন স্থাপনার নামাঙ্কিত করতে দেখা যায়নি কিন্তু ব্যতিক্রম হিরণ্ময়ী চৌধুরীর ক্ষেত্রে।
হিরণ্ময়ী নয় আনী বাড়ি জমিদারের পুত্রবধূ ছিলেন, কিন্তু তার কাজের স্বীকৃতি বা স্মৃতি ধরে রাখার ক্ষেত্রে শধু নয় আনী বাড়ি নয়, আড়াই আনি জমিদারের নানা তৎপরতা চোখে পড়ে। এই তরফের জমিদার গোপাল দাস চৌধুরী তার পিতার নামে গোবিন্দ্র কুমার পিস মেমোরিয়াল নামে যে স্কুল টি প্রতিষ্ঠা করেন (বর্তমানে জিকে পাইলট হাই স্কুল) সেই স্কুলে তৎকালে ৫ হাজার বইয়ের সমাবেশ নিয়ে হিরণ্ময়ী লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠা করেন।
বর্তমানে ওই লাইব্রেরীতে বই রয়েছে মাত্র ১ হাজার ৪ শতটি এর মধ্যে স্বাধিনতাত্তোর শতাধিক বই রয়েছে। ওই লাইব্রেরীতে এই অ লের ঐতিহ্যবাহী তালপাতার পুঁথি সংরক্ষিত ছিল। যা এখন স্মৃতিহীন ইতিহাস। যদিও বর্তমান প্রধান শিক্ষক ওই লাইব্রেরীর প্রায় ধ্বংসাবশেষ সু-উচ্চ (প্রায় ১৫ ফিট উচু) বুক সেলফ বা আলমিরাগুলো সম্প্রতি সংস্কার করে বেশ কয়েকটি সেলফ এবং প্রায় ১ হাজার ৪ বই সংরক্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে।
অন্যদিকে নালিতাবাড়ি উপজেলা শহরে আড়াই আনী বাজারে শেরপুরের আড়াই আনী জমিদারের হিস্যার অংশে গোপাল দাস চৌধুরী হিরণ্ময়ী মইনর স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন বর্তমানে তা হিরণ্ময়ী উচ্চ বিদ্যায়লয় হিসেবে পরিচিত।
ওই স্কুলটিরও কেবল মাত্র সাইন বোর্ডে হিরণ্ময়ী নাম ছাড়া আর কোন স্মৃতি চিহৃ নেই। শিক্ষার্থী তো দুরের কথা অনেক শিক্ষকই জানেন না কে এই হিরণ্ময়ী।
জ্যোতি পোদ্দার তার ওই লেখায় লিখেছেন, কবি হিরণ্ময়ী এই উত্তর জনপদের প্রথম নারী-যার একটি কাব্য গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল। এই গ্রন্থের ভূমিকাও লিখেছিলেন জমিদার গোপাল দাস চৌধুরী। তবে দু:খের বিষয় হলো সেই গ্রন্থটি বর্তমানে কোথাও সংগ্রহে নেই।
প্রাচীণ কালের সেই হাজার হাজার বই যেখানে ধরে রাখা যায়নি সেখানে শেরপুরের প্রথমা নারী কবি হিরণ্ময়ীর কাব্য গ্রন্থটি ধরে না রাখাটা মামুলি ব্যপার। তবুও রক্ষা- অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতকে প্রকাশিত কিছু বইয়ের নাম ও লেখক তালিকা তৎকালের হরচন্দ্র চৌধুরীর লেখা “সেরপুর বিবরণ” (১৮৭৩ খ্রীষ্টাব্দ) এবং বিজয় চন্দ্র নাগ এর লেখা “নাগ বংশের ইতিহাস” বইয়ে প্রকাশিত হয়েছিল।
তা না হলে হিরণ্ময়ীসহ এ অন্চলের সাহিত্যের অনেক ইতিহাস মুছে যেতো। অধ্যবধি উল্লেখিত বইগুলোর ইতিহাস রক্ষার্থে পুন:মুদ্রন করা হয়নি। যে তথ্য বা বইয়ের লেখা পাওয়া যায় তা কেবলমাত্র ফটোকপিই ভরসা স্থানীয় পাঠকদের।
শেরপুর জিকে পাইলট হাই স্কুলের বর্তমান প্রধান শিক্ষক মঞ্জুরুল হক জানায়, আমি দায়িত্ব গ্রহনের পর দেখলাম হিরণ্ময়ী লাইব্রেরী ধ্বংসের প্রায় শেষ প্রান্তে চলে যাচ্ছে। আলমিরার ও শত বছরের পুরোনো বইগুলো উইপোকা সাবার করে ফেলছিলো। অনেকগুলো বই আমি বস্তা বন্দি অবস্থা থেকে তুলে এনে বাঁধাই ও গ্রন্থ তালিকা করেছি। কাঠের আলমিরা গুলোকেও সংস্কার করা হয়েছে।
স্কুলের শত বর্ষ উপলক্ষে লাইব্রেরীর ভিতর প্রতিষ্ঠা করা হযেছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মুক্তিযুদ্ধ কর্ণার। লাইব্রেরীর ছাদ চুয়ে পানি পড়ায় নির্মান করা হয়েছে নতুন ছাদ। ফলে এখন শিক্ষার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করে বই পড়ার সুযোগ স্মৃষ্টি হয়েছে।
নালিতাবাড়ি হিরণ্ময়ী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. আমিনুল হক জানায়, বর্তমানে স্কুলে হিরণ্ময়ী কোন স্মৃতি চিহৃ নেই। তবে ব্রিটিশ আমলে স্কুল পরির্দশন বইটি রয়েছে। এতে সেসময়ের বিভিন্ন লাটদের পরিদর্শন সাক্ষর রয়েছে। এছাড়া জমি জমার কাগজপত্র রয়েছে।