শেরপুর জেলার অন্যতম বিনোদন কেন্দ্র নালিতাবাড়ী উপজেলায় স্থাপিত ‘মধুটিলা ইকোপার্ক এ শীত মৌসুমে ভ্রমনপিয়াসীদের পদভারে মুখরিত হয়ে উঠে। সীমান্তবর্তী এই পার্কের চারপাশে উচু-নিচু পাহাড়ীটিলা, কৃত্রিম লেক আর সবুজের সমারোহ দেখতে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত দর্শনার্থী ও ভ্রমনপিয়াসীরা ভীড় জমান। প্রকৃতির সান্নিধ্য পেতে বর্তমান মৌসুমে সপ্তাহের প্রতি বৃহস্পতিবার, শুক্রবার এবং শনিবার হাজার হাজার দর্শনার্থী সমবেত হয়ে বনভোজন বা শিক্ষা সফর করে কর্মকান্তি ভুলে আনন্দচিত্ত্বে ফিরে যান নিজগৃহে। তাই ইট, কাঠ, কংক্রিট আর পাথরে গড়া নগর জীবনের কোলাহল ছেড়ে বেরিয়ে আসতে পারেন এই পার্ক থেকে।
শেরপুর জেলা শহর থেকে ২৪ কিলোমিটার, নালিতাবাড়ী উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১৪ কিলোমিটার উত্তরে পোড়াগাঁও ইউনিয়নে ময়মনসিংহ বন বিভাগের ব্যবস্থাপনায় মধুটিলা ফরেষ্ট রেঞ্জের সমেশ্চুড়া বন বীটের আওতায় ৩৮০ একর বনভূমিতে গারো পাহাড়ের মনোরম পরিবেশে সরকারীভাবে বিগত ২০০০ সালে নির্মিত হয় ‘মধুটিলা ইকোর্পাক’ তথা পিকনিক স্পট। স্থাপনকাল থেকেই শীত মৌসুমে এ পার্কে পর্যটকরা ভীড় জমান।
এই পার্কটির প্রধান ফটক পেড়িয়ে ভেতরে ঢুকতেই প্রথমে চোখে পড়বে সারি সারি গাছ। রাস্তার ডান পাশে খোলা প্রান্তর আর দু-পাশে রকমারি পণ্যের দোকান। সামনের ক্যান্টিন পার হলেই পাহাড়ী ঢালু রাস্তা। এর পরই হাতি, হরিণ, রয়েল বেঙ্গল টাইগার, সিংহ, বানর, কুমির, ক্যাঙ্গারু, মৎস্য কন্যা, মাছ ও পাখির ভাষ্কর্য। পাশের আঁকাবাঁকা পথে ঘন গাছের সারি লেকের দিকে চলে গেছে। তারপর কৃত্রিম লেকের উপর ষ্টারব্রিজ। দেখে প্রাণ পায় নব চেতনা, মন হাড়িয়ে যায় যেন প্রকৃতির মাঝে। লেকে নৌকায় চরে ঘুরাফেরার পর পাহাড়ের চুড়ায় পর্যবেণ টাওয়ারে আরোহণ করলেই নজর কেড়ে নেয় ভারতের উঁচু নিচু পাহাড় আর সবুজের সমারোহ। প্রকৃতির এই নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হন ভ্রমন পিয়াসীরা।
কর্তৃপক্ষ জানান, ইকোপার্কে ঢুকতে জনপ্রতি ১০ টাকা, বড় বাস ৬০০ টাকা, মিনিবাস ৪০০টাকা, মাইক্রোবাস ২০০ টাকা, মোটরসাইকেল ৩০ টাকায় টিকেট কাটার ব্যবস্থা রয়েছে। এখানে আলাদা আলাদা ফি দিয়ে প্যাডেল বোট চালানো, পর্যবেণ টাওয়ারে উঠা, শিশু পার্কে প্রবেশের সুযোগও রয়েছে। শুধু দিনের বেলায় ব্যবহারের জন্য ভ্যাটসহ ৪ হাজার ৭০২ টাকার বিনিময়ে পাহাড়ের চূড়ায় চার ক বিশিষ্ট শীতাতাপ নিয়ন্ত্রিত (এসি) সুসজ্জিত মহুয়া নামের রেষ্ট হাউজ। এ রেষ্ট হাউজ ব্যবহার করতে চাইলে মধুটিলা রেঞ্জঅফিস, ময়মনসিংহ অথবা শেরপুর বন বিভাগ অফিসে বুকিং দিতে হয়। এ ছাড়াও এখানে রয়েছে ডিসপ্লে মডেল, তথ্য কেন্দ্র, গাড়ী পার্কিং জোন, ক্যান্টিন, মিনি চিড়িয়াখানা, বন্য প্রাণির বিরল প্রজাতি পশু-পাখির ভাষ্কর্য। আরো আছে জীবন্ত হরিন, ঔষধি ও সৌন্দর্য বর্ধক প্রজাতির বৃক্ষ এবং ফুলসহ বিভিন্ন রঙ্গের গোলাপের বাগান। তবে সৃজনভেদে এ সবের ফি কম বেশি হতে পারে।
মধুটিলা ইকোপার্কের ভারপ্রাপ্ত রেঞ্জকর্মকর্তা ইলিছুর রহমান বলেন, তৃতীয় ফেইজে বিগত ২০০৯ সালে এ পার্কের আরো সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য ঝুলন্ত ব্রিজ, লেক এক্সটেন, মসজিদ নির্মান ও অফিস ভবন নির্মানসহ পার্কটির সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য ২ কোটি ৮০ লাখ টাকার প্রস্তাবনা পাঠানো হলে তা নাকচ করা হয়। তবে সরকার প্রতি বছর এ পার্ক থেকে প্রায় ২০ থেকে ৩০ লাখ টাকার রাজস্ব আয় করলেও পার্কের সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য কোন প্রকার অর্থ ব্যয় করছে না। আমরা মাঝে মাঝেই উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করে আসছি। এখনো ওই প্রস্তাবনা পাশ হয়নি।
স্থানীয়রা অভিযোগ করে বলেন, ইকোপার্কটি জীববৈচিত্র ও বিভিন্ন প্রাণির সমাহার ঘটিয়ে যেভাবে সাজানোর কথা ছিল এখনও তার কিছুই হয়নি। কর্তৃপরে সুদৃষ্টির অভাবে সম্ভাবনাময় ইকোপার্কটির সম্ভাবনা ম্লান হতে বসেছে। ভ্রমণ পিপাসু মানুষ প্রকৃতির অপার নৈসর্গিক সৌন্দর্যের টানে বারবার এ পার্কে ছুটে আসে। বিনোদন ও পাহাড়ী এলাকার মানুষের কর্মসংস্থানের জন্য পার্কটি বিশাল ভূমিকা রেখেছে। সম্ভাবনাময় এ পার্কটির প্রতি নজর দেওয়ার জন্য জোড় দাবি জানিয়েছেন এলাকাবাসী।
অপরদিকে, এই ইকোপার্কটি সীমান্তবর্তী হওয়ায় এখান থেকে ভারতের দুরত্ব ১ কিলোমিটার। যুগ যুগ ধরে সীমান্তবর্তী এ পাহাড়ে গারো আদিবাসীরা বসবাস করে আসছেন। এখান থেকে খুব সহজে আদিবাসী গারোদের জীবনধারা ও সংস্কৃতি খুব কাছে থেকে দেখারও সুযোগ রয়েছে।
রাজধানী ঢাকা থেকে মধুটিলা ইকোপার্কের দুরত্ব প্রায় ২০০ কিলোমিটার। ঢাকা বাসস্ট্যান্ড থেকে ময়মনসিংহ হয়ে শেরপুর আসতে হবে। শেরপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে নালিতাবাড়ী উপজেলার নন্নী বাজার পর্যন্ত লোকাল বাস সার্ভিস রয়েছে। এ ছাড়াও শেরপুর থেকে ভাড়ায় সিএনজি অথবা মটরসাইকেলযোগে মধুটিলা ইকোপার্কে আসা যায়। অথবা নিজস্ব গাড়ীতে সরাসরি ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ হয়ে শেরপুর পৌঁছানোর আগে নকলা উপজেলা থেকে নালিতাবাড়ী উপজেলা সদর হয়ে ইকোপার্কে আসা সহজ হয়। সব মিলিয়ে শীত মৌসুম ছাড়াও সম্ভাবনাময় এই ইকোপার্কে প্রায় সারা বছরই দেশি-বিদেশি পর্যটক ও ভ্রমন পিয়াসীদের ভীড় লেগেই থাকে।