তালাত মাহমুদ
এবারের বন্যা এত দীর্ঘস্থায়ী হবে তা ধারণা করা যায়নি। করোনার মত বন্যাও মানুষকে অসহায় করে তুলেছে। সারাদেশে কোন কোন অঞ্চলে দ্বিতীয় ও তৃতীয় বারের মত বন্যার করাল থাবা বিস্তার করে জীবনযাত্রাকে ব্যহত করে চলেছে। ধ্বংস করছে আমাদের কৃষি অর্থনীতিকে। দেশের ৫ লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী। চরাঞ্চলের মানুষের করুণ অবস্থা বর্ণনা করার মত নয়। বিশেষ করে নারী ও শিশুদের অবস্থা সবচেয়ে করুণ।
তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। ৫৫টি নদীর উজানে বাধ দিয়ে এক তরফাভাবে ভারত সরকার পানি প্রবাহ তার দেশের মধ্যে ধরে রাখায় বাংলাদেশ মরুভূমিতে পরিনত হতে চলেছে। সেই ১৯৫০এর দশক থেকেই এ প্রক্রিয়া শুরু হয়। ফলে বাংলাদেশের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত বড় বড় নদ-নদীগুলো নাব্যতা হারিয়ে ফেলেছে। সামান্য বন্যা হলেই তা উপচে ফসলী জমিতে প্রবেশ করে এবং কৃষি অর্থনীতির উপর প্রভাব ফেলে। মানবিক বিবেচনায় এ উপমহাদেশের মানুষের চাহিদার সঙ্গতিপূর্ণ নিষ্পত্তি অত্যন্ত জরুরী। এক্ষত্রে পক্ষপাতিত্ব বা একতরফা কুটনীতি ভাটি অঞ্চলের মানুষ ও অর্থনীতিকে ধ্বংষ করে ছাড়ে।
এবারের ঈদ বানভাসি মানুষ আর করোনার কারণে স্ব স্ব পেশা থেকে ছিটকে পড়া কর্মহীন মানুষ কঠিন বিপর্যয়ের মধ্যে কাটিয়েছে। চারদিকে শুনসান। কী দারুণ শূন্যতা বিরাজ করছে। নেই শিশুদের নতুন জামা কাপড় পরিধান করে বাড়ি বাড়ি বেরানো। নেই বর্ণিল সাজে সেজে কিশোরীদের দল বেঁধে ছুটে চলা।
বাড়ি বাড়ি কুরবানীর মাংস কাটার তেমন দৃশ্য দৃষ্টির মধ্যে ছিলনা। ছিলনা জটলা বেঁধে থাকা মানুষের ভীড়। আসা যাওয়া ছিলনা কোন আত্মীয় স্বজনের। যারা কুরবানী দিয়েছেন তাঁরা স্বাস্থ্যবিধি আর সামাজিক দূরত্ব মেনে কুরবানী দিয়েছেন। চোখে পড়ার মত নয়।
ঈদ করতে পারেননি অনেক সরকারি কর্মচারী। কারণ তাঁরা বেতন পাননি। তাঁদের অনেকের সন্তান, পরিবারের সদস্য ও আত্মীয় স্বজনরাও কুরবানীর মংস খেতে পারেনি। রাজস্ব বিভাগের কর্মচারী আমার এক আত্মীয় কুরবানীর গরু কিনে বিপদে পড়েছিলেন। শেয়ারে গরু কেনার পর বেতন না পাওয়ায় অনেকে কুরবানীর শেয়ার না নেয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলে অগত্তা বাধ্য হয়ে তাঁকে একাই গরুটি কুরবানী দিতে হয়।
আমার এক শুভ্যার্থী ফেবু’তে জানিয়েছেন, শেরপুর ও জামালপুর জেলার চরাঞ্চল ও নি¤œাঞ্চলের বানভাসী মানুষের করুণ চিত্রের কথা! এত কষ্ট মানুষ সহ্য করতে পারে তা স্বচোখে না দেখলে বিশ্বাস কারা যায়না। চক্ষুলজ্জার কারণে অভাবের তাড়নায় কত মানুষ অসহায় জীবন যাপন করছে। সেটা আমরা হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করছি। বন্যা কবলিত এলাকায় এক মধ্যবয়েসী মহিলাকে গাছের ডালে বসে থাকতে দেখেছি। জীবন বাঁচাতে একটি গাভীকে ঘরের চালের উপর উঠে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি। রাজহাঁসের পিঠের উপর বিষধর সাপকে আশ্রয় নিতে দেখেছি। অভিভাবকদের অসচেতনতার কারণে বানের পানিতে ডুবে অনেক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। নৌকাডুবি, বজ্রপাত ও সর্প দংশনে মারা গেছে এমন মানুষের সংখ্যাও কম নয়। করোনায় মৃত্যু সংবাদ আমরা প্রতিদিনই পাচ্ছি টেলিভিশনের মাধ্যমে।
সরকারের ত্রাণ, প্রণোদনা, সমবেদনা কোন কাজেই আসছেনা। এসব কোথায় যাচ্ছে, কারা পাচ্ছে ধুলায় অন্ধকার। টেলিভিশনের নিউজ কভার করতে কিছু কিছু মানুষকে আনুষ্ঠানিক ত্রাণ বিতরণ করতে দেখা যায়। সেটাও কালেভদ্রে। সাংবাদিকরা হেলে পড়েছে একটা নির্দিষ্ট বলয়ের দিকে। যাদের তেল মর্দনে ব্যস্ত। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, দেশে কোন সরকার নেই। সাংবাদিকতার বিধি মোতাবেক একজন সরকারি কর্মচারিকে কিভাবে সম্বোধন করতে হবে, সেটাও তারা জানেনা। পদের আগে মাননীয় এবং কর্মচারির নামের শেষে মহোদয় সেঁটে দিয়ে সচেতন মহলে হাস্যরসের সৃষ্টি করছে। আর প্রচার পাগল সরকারি কর্মচারীরাও ওই সুযোগটা লুফে নিচ্ছেন।
আমরা পত্রিকার সংবাদে কখনোই দেখিনাÑ মহামান্য রাষ্ট্রপতি মো: আবদুল হামিদ মহোদয় বা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মহোদয়। আমরা দেখি- রাষ্ট্রপতি মো: আবদুল হামিদ, আমরা দেখি- প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সাংবাদিকতা ও সংবাদ লিখনের কতগুলো নিয়মকানুন রয়েছে। সেগুলো আমাদের অনুধাবন ও অনুশরণ করতে হবে। আবেগ উচ্ছ্বাস প্রতীতি আর তেলবাজি হচ্ছে প্রকৃত সাংবাদিকতার শত্রু। ক্যামেরায় যেমন হুবহু ছায়াচিত্র উঠে আসে, সাংবাদিকের লেখনীতে তেমনি হুবহু খবরচিত্র বিধৃত হবে। কোন প্রকার অলঙ্কারিক চলবেনা।
উদ্ভুত পরিস্থিতিতে সাংবাদিককে ভাবতে হবে, শিশুখাদ্য, মানবখাদ্য আর গো-খাদ্যের সঙ্কট প্রকট আঁকার ধারন করেছে। বন্যার পানি বাহিত বিভিন্ন রোগ বালাইয়ের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। বিশুদ্ধ পানির সঙ্কটও দেখা দিয়েছে। সব জায়গায় বন্যার পানি উঠায় রান্নাবান্না করতেও কষ্ট হচ্ছে। বন্যা ও পাহাড়ি ঢলের পানিতে চরাঞ্চলের ও বীরাঞ্চলের নি¤œাঞ্চল তলিয়ে যাওয়ায় আমন ধানের বীজতলা, তরিতরকারি ও শাক সব্জির ক্ষেত তলিয়ে গেছে। কৃষকের ক্ষতি হয়েছে কোটি কোটি টাকা।
শেরপুর ও জামালপুর জেলার অনেক রাস্তা-ঘাট বিব্ধস্ত হয়েছে। ব্রিজ-কালভার্ট দেবে গেছে। যানবাহন ও মানুষের চলাচলে মারাত্মক বিঘœ ঘটছে। দেওয়ানগঞ্জ, বকশীগঞ্জ, ইসলামপুর, মাদারগঞ্জ, সরিষাবাড়ী, জামালপুরের পূর্বঞ্চল, শেরপুর ও নকলার দক্ষিণাঞ্চল বন্যার পানিতে এবং শ্রীবরদী, ঝিনাইগাতী ও নালিতাবাড়ী উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকা পাহাড়ি ঢলে তলিয়ে যাওয়ায় কৃষকদের মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে। মৎস্যচাষীদের প্রজেক্টের মাছ ভেসে যাওয়ায় তাদের কোটি কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। এ ক্ষতি পুষিয়ে ওঠা কারো পক্ষেই সম্ভব নয়।
এবারের ঈদে অসংখ্য ঈদ শুভেচ্ছা পেয়েিেছ। শত শত। কবি সাহিত্যিক, সাংবাদিক, চিকিৎসক, রাজনীতিক, সমাজসেবী, সেনা কর্মকর্তা, জনপ্রতিনিধি, ভক্ত অনুরক্ত আরো অনেক শ্রেণি পেশার প্রিয় মানুষ গুলো আমাকে পবিত্র ঈদের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। এর প্রথম ও প্রধান কারণ হলো আমি অসুস্থ। অনেকেই জানেন আমি ডায়াবেটিসে ভোগছি। ঈদের ৩/৪দিন আগে ডায়াবেটিস পরীক্ষা করানো হলে ফলাফল আসে ২৬.৮। আমার স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়েছে। ওজন কমেছে ১৪ কেজি। রিপোর্টটি ফেসবুকে প্রচারিত হলে অনেকে আমার খোঁজ খবর নেন। আমাকে নানা পরামর্শ দেন এবং কিছু নিয়ম মেনে চলতে বলেন। জিনোম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ম্যানেজিং ডিরেক্টর আমার চাচা ও সহপাঠী প্রফেসর ডা: একেএম সাইদুর রহমান তাৎক্ষণিক আমাকে পরামর্শপত্র প্রেরণ করেন এবং কিছু নিয়ম মেনে চলতে বলেন। আর্থিক দুরবস্থায় আছি একথা বললে আমার মান সম্মান যাবেনা। করোনাকালে প্রায় সবার পকেট ফাঁকা। পত্রিকা অফিস থেকে কোন টাকা আসছেনা।
প্রিয় পাঠক, আমি ছাত্রজীবন থেকে কুরবানী দিয়ে আসছি। নিষ্ঠুর নিয়তির কি নির্মম পরিহাস (!) এবার আমার বাসায় ঈদ নেই। ঈদ আমাকে বর্জন করেছে নাকি আমিই ঈদকে বর্জন করেছি, বুঝতে পারছিনা। একই অবস্থা সরকারি কলেজের একজন সহ. অধ্যাপকের বেলায়ও। টেকনিকেল কারণে তিনিও কুরবানী দিতে পারেননি। আমরা সবাই পরিস্থিতির শিকার। শেরপুর জেলায় কেজি স্কুলের ৩ হাজার শিক্ষক কর্মচারি কর্মহীন হয়ে পড়ায় দারা পরিবার নিয়ে অত্যন্ত মানেবেতর জীবন যাপন করছেন। এর মধ্যে অনেক অসহায় দু:স্থ ও পঙ্গু কবি সাহিত্যিক এবং সাংবাদিক রয়েছেন। এদের জন্য কোন ত্রাণ নেই, প্রণোদনা নেই। কেজি স্কুলের শিক্ষক কর্মচারিরা বাঁচার তাগিদে মানববন্ধন পর্যন্ত করেছেন। কিন্তু কে শোনে কার কথা।
ঈদের দিন অভুক্ত দিন কাটিয়েছে বন্যা কবলিত এলাকার আর্তপীড়িত মানুষ। নৌকায় বসে ব্রয়লার মুরগীর মাংশ রান্না করছিলেন এক মধ্যবয়েসী নারী। সাংবাদিক দেখেই তিনি হাউ মাউ করে কেঁদে উঠেছিলেন। পাশে বসা দুইজন বৃদ্ধের চোখেও পানি ছিল। ওই পরিবারের আর কোন সদস্যকে দেখা যায়নি। তারা বিশুদ্ধ পানি পান করতে পারেন না। প্র¯্রাব পায়খানা করার কোন ব্যবস্থা না থাকায় নৌকার একপাশে ছালার চট্টি দিয়ে ঘের দিয়ে তারা সে কাজটি সারেন।
মহাকবি শেখ সাদী বলেছেন, ‘তজবীহ এবং সিজদা দেখে খোদ এলাহী ভুলবেনা/মানব সেবার কুঞ্জী ছাড়া স্বর্গদ্বান খুলবেনা’।‘মানুষ মানুষের সহানুভূতি কি পেতে পারেনা ও বন্ধু, মানুষ মানুষের জন্য’। ভুপেন হাজারিকার গানের এই বিখ্যাত কলিটি উচ্চারণ করা ছাড়া যেন আর কিছুই বলার থাকেনা আমাদের। চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষের সময়কার একটি কবিতার পংক্তিÑ মরছে মানুষ বাংলাদেশে মরতে দাও/ জ্বলছে আগুন মায়ের বুকে জ্বলতে দাও/এযে মানুষ মারার ছল/ এযে শোষণ করার ছল/ তাইতো মানুষ মরছে সবাই ভবঘুরের দল/দেখবিওে যাই চল্/স্টেশনে ফুটপাতে আর আমার শ্মশান গাঁও..।
শেষকথা, এক সময় বন্যার পানি নেমে যাবে। মাঠে ফসল থাকবেনা, বীজতলায় আমন ধানের বীজ থাকবেনা। গোয়াল ঘওে গরু থাকবেনা, কৃষকের মাথায় থাকবে হাত। এই হাতকেই আবার কর্মীর হাতিয়ারে পরিণত করতে হবে। তখন কৃষককে দিতে হবে পর্যাপ্ত আর্থিক প্রণোদনা ও কৃষিসামগ্রী এবং যোগাতে হবে শক্তি ও সাহস। কৃষি প্রধান বাংলাদেশের কৃষি ক্ষতিগ্রস্ত হলে তার প্রভাব পড়বে গোটা জাতির উপর। তখন জীবন ও জীবিকা হয়ে উঠবে দুর্বিসহ। খরা দুর্ভিক্ষ প্লেগ মহামারীর প্রাদুর্ভব ঘটবে। কাজেই এসব মোকাবেলায আগে থেকেই প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে হবে।
লেখক: কবি সাহিত্যিক সাংবাদিক ও কলামিস্ট এবং সভাপতি, কবি সংঘ বাংলাদেশ।