ষাটের দশকে বলিউডের ‘ভাই ভাই’ সিনেমার একটি গান বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সুরসম্রাজ্ঞী লতা মঙ্গেশকরের সেই গানটির কথাগুলো ছিল এমন, ‘ইস্ দুনিয়া মে সাব চোর চোর/কই প্যায়সা চোর কই মুরগি চোর/ওর কই দিল কা চোর।’ পৃথিবীর সবাই চোর নয়, কিন্তু সুযোগ পেলে যেকোনো পরিস্থিতিতেও অনেকে যে তাদের রূপ পাল্টায় না, করোনাভাইরাসের এক কঠিনতম সময়ে এসে বাংলাদেশের সরকার দলীয় অনেক নেতা ও জনপ্রতিনিধিরা তাই দেখালেন।
করোনাভাইরাসের এই লকডাউনে বাংলাদেশসহ গোটা বিশ্ব অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছে। এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য দিনমজুর ও শ্রমহারা মানুষদের খাদ্য-অর্থ সহায়তা দিচ্ছে বাংলাদেশ সরকার। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতা, সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিসহ অনেকেই সেই সহায়তা মানুষদের মাঝে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব পেয়েছেন। সেই সুযোগে দেশের এই চরম সংকটেও গরিবের ত্রাণ চুরি বা লুট করছেন অনেকে। এরই মধ্যে গণমাধ্যমে তাদের কয়েকজন সম্পর্কে খবরও বের হয়েছে।
‘ডিজিটাল চোর’
ত্রাণ চুরির তালিকায় রয়েছেন চট্টগ্রামের হাটহাজারীর ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যান নুরুল আবছার। তাকে আমরা ডিজিটাল চোর বলতে পারি। কেননা তিনি সেই ত্রাণ চুরি করতে গিয়ে ডিজিটাল কায়দায় কাজ করেছেন। গত ৬ এপ্রিল ইউনিয়ন পরিষদে মানুষদের ডেকে ২৬টি পরিবারকে ত্রাণ দেন চেয়ারম্যান। সবাইকে ত্রাণ দিয়ে সেই ছবি তোলেন তোলা। এরপর সবার থেকে সেই ত্রাণ কেড়ে নেওয়া হয় (বাংলাদেশ প্রতিদিন অনলাইন, ৭ এপ্রিল ২০২০)। আর তখনই ফাঁস হয়ে যায় চেয়ারম্যানের ডিজিটাল কৌশল। পাবলিক এর প্রতিবাদ করলে উল্টো পিটুনি খায়। আহারে গরিব, ত্রাণ তো পেলই না, উল্টো পকেটের টাকায় মলক কিনতে হলো ঘা সারাতে! যদিও সেই খবর পেয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সরকারি কোষাগার থেকে ওই পরিবারগুলোকে ত্রাণ দিয়েছেন বলে গণমাধ্যমে বলেছেন।
‘অ্যাকশন চোর’
ওই ডিজিটাল চোরের মতোই অ্যাকশন চোরের দেখা মিলেছে রাজশাহীতে। তিনিও জনপ্রতিনিধি বলে দাবি করেন নিজেকে। কেননা বাঘা উপজেলার আড়ানি পৌরসভার মেয়র তিনি, নাম মুক্তার আলী। পাবলিকের ত্রাণ আত্মসাত করতে তিনি কোনো কায়দা-কানুনে যাননি, সরাসরি অ্যাকশনে গেছেন। সোজা কথায় বলতে গেলে, মেরেছেন এক নারী ও আরিফুল ইসলাম নামের ভ্যানচালককে (দৈনিক আমাদের সময় অনলাইন, ৭ এপ্রিল ২০২০)। শুধু কি তাই? ত্রাণ চাইতে যাওয়ায় তাদেরকে মারধর করে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেওয়া হয়েছে।
গরিব মানুষ ত্রাণের জন্য গিয়েছিলেন, কিন্তু তালিকায় নাকি তাদের নাম ছিল না। পেটের ক্ষুধা কি অত তালিকা-টারিকা বোঝে? তাই তারা ত্রাণ চেয়েছিলেন। কিন্তু মুক্তার আলী যে পুরোনো অ্যাকশন পার্টি, সেটা স্থানীয়রা জানলেও ওই হতদরিদ্র নারী-পুরুষ বোঝেনি। তাই যা হওয়ার তাই হয়েছে।
‘দাম্ভিক চোর’
দেশ এত উন্নত হচ্ছে, বিচার-বুদ্ধি সবার বাড়ছে। সেখানে বৃদ্ধি না খাটিয়ে দাম্ভিকতা দেখাতে গিয়ে ধরা খেয়েছেন আয়েত আলী। তার পরিচয় নওগাঁর রানীনগর উপজেলার কালিগ্রাম ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য। বলা চলে বয়সী নেতা। খাই-দাইয়ে পুরোনো হস্ত তার, সেটা বলাই বাহুল্য।
তাই তো গরিবের চাল নিজের গুদামে রেখেছিলেন তিনি। দেশ ডিজিটাল, এমন তথ্য-প্রযুক্তির অবাধ প্রবাহে সেই চুরির খবর কি আর আটকে থাকে! সেই খবর চলে যায় ইউএনও’র কাছে। এরপর ঘটনাস্থলে পৌঁছে খাদ্য অধিদপ্তরের সিল মারা ১৩৮টি চালের বস্তা জব্দ করেন ইউএনও। এ ছাড়া ওই গুদাম থেকে খাদ্য অধিদপ্তরের সিল মারা আরও ২০০টি খালি বস্তা জব্দ করা হয় (প্রথম আলো অনলাইন, ৩ এপ্রিল ২০২০)। ওই ঘটনার পর থেকে সেই চোর নাকি পলাতক।
‘কৌশলি চোর’
আয়েত আলী ধরা খাওয়ার পর সেই ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে ভিন্ন পন্থায় পা বাড়িয়েছিলেন ঝালকাঠি সদর উপজেলার বাসন্ডা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মনির হোসেন। কিন্তু কৌশলি এই চোরকেও শেষ পর্যন্ত ধরা খেতে হয়েছে। পরিচয়ে একজন জনপ্রতিনিধিও তিনি, আগড়বাড়ি গ্রামের ৮ নম্বর ইউপি সদস্য। শুধু কি তাই, জেলা মেম্বর ফোরামের সভাপতিও তিনি। ভাবা যায়, এত বড় প্রতিনিধি ব্যক্তিত্ব, তার কি কম কৌশল থাকবে? আহারে দুনিয়া, সেই কৌশলও ধরা খেল।
তাহলে ঘটনা বলি, ত্রাণের সরকারি আড়াই টন (২৫০০ কেজি) চাল মনির হোসেনের বাড়ি থেকে জব্দ করে ঝালকাঠি জেলা প্রশাসন। গত ৫ এপ্রিল রাতে সেই চালগুলো জব্দ করা হয় (বাংলাদেশ প্রতিদিন অনলাইন, ৬ এপ্রিল ২০২০)। কৌশল খাটিয়ে চালগুলো সরকারি বস্তা খুলে অন্য বস্তায় রাখা হয়েছিল, যেন কেউ বুঝতে না পারে। প্রথমে হয়তো বোঝার উপায় ছিল না সেই চাল কার। কেননা চালের গায়ে তো আর লেখা নেই! কিন্তু তারপরও দক্ষ প্রশাসনের দৃষ্টি পড়ে নেতার সেই গোলাঘরে। নিমিষেই সেই গোলা ফাঁকা হয়ে যায়। স্বপ্নের ‘তাসের ঘর’ ভেঙে যায় রাতারাতি।
‘আত্মসাৎ করা চোর’
দেশে এত সব চোর দেখে বগুড়ার সারিয়াকান্দি কুতুবপুর বাজারের ডিলার গাজীউল হক গাজী একটু-আধটু উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। তাই হতদরিদ্রের চাল নিজের মতো করে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন। ওএমএস’র (ওপেন মার্কেট সেল) ১০ টাকা কেজির দরের ২৮৮ বস্তা চাল আত্মসাতের অভিযোগে তাই তার জেলও হয়েছে এক মাস। ভ্রাম্যমাণ আদালতের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. রাসেল মিয়া গত ৬ এপ্রিল সকাল ১০টার দিকে ভ্রাম্যমাণ আদালতে এ আদেশ দেন। এ ছাড়া তার ডিলার শিপ বাতিল করা হয়েছে (ইত্তেফাক অনলাইন, ৬ এপ্রিল ২০২০)।
জেলে গিয়ে গাজীউল হক হয়তো ভাবছেন, ‘ইস্ দুনিয়া মে সাব চোর চোর’, কিন্তু আমি একাই ধরা খেলাম। বাকিদের হয়তো কিছুই হবে না। এমনটি অন্য যাদের নাম গণমাধ্যমে অসেনি, তারা তো এখরো হিরো।
চোরের আরও অনেক খবর গণমাধ্যমে এসেছে। এই যেমন সিলেট সিটি করপোরেশনের এক কাউন্সিলরের বাসায় ১২৫ বস্তা ত্রাণের চাল পাওয়া গেছে। বরগুনার পাথরঘাটায় জেলেদের চাল আত্মসাতের ঘটনায় ইউপি চেয়ারম্যানকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। বাগেরহাটের শরণখোলায় পাচারের সময় ১৮ বস্তা চল জব্দ করা হয়েছে। নোয়াখালীতে চাল পাচারের ঘটনায় যুবলীগ নেতার বিরুদ্ধে থানায় মামলা হয়েছে।
করোনার এই সংকট সময়ে যারা সুযোগ নিচ্ছেন, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রযোগ করা প্রয়োজন। না হলে আগামী দিনে এরাই বাংলাদেশকে চুষে খাবে। কিন্তু বাস্তবে ক্ষমতার পাশে থাকা এসব মানুষদের হয়তো কিছুই হবে না। তাই শাস্তির আশা করাটাও হয়তো বোকামি।