মহিউদ্দিন সোহেল ও শাকিল মুরাদ :
শেরপুরের নালিতাবাড়ীতে ১৬ বছর ধরে শিকলে বন্দী অবস্থায় রয়েছে ১৮ বছর বয়সী মুসলিমা আক্তার। সে উপজেলার মরিচপুরান ইউনিয়নের গুজাকুড়া গ্রামের মৃত আবুল কাশেমের মেয়ে।
শনিবার। ৪ জানুয়ারী। দুপুরে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ছোট্ট একটি টিনের চালা। ভেতরে চারপাশের চারটি খুঁটিতে লাগানো আছে শিকল। শিকলের শেষ অংশে ঝুলছে চারটি তালা। হাত ও পায়ের সঙ্গে লাগানো শিকলই যেনো মুসলিমার সারা দিনের সঙ্গী। শিকলের আঘাতে মুসলিমার হাতে ও পায়ে পড়েছে দাগ। ঝড়বৃষ্টি যা-ই হোক, সারাদিন কর্ম শেষে বাড়িতে মা না ফেরা পর্যন্ত মুসলিমাকে শিকলবন্দী হয়ে ঘরের মেঝেতেই শুয়ে থাকতে হয়। চিৎকার করলেও দেখতে আসে না কেউ।
মুসলিমার মা মনোয়ারা বেগম শেরপুর টাইমসকে জানান, তার মেয়েটি মানসিক প্রতিবন্ধী। নিজেই নিজের হাত-পায়ে কামড়ায়। শরীর থেকে জামাকাপড় খুলে ফেলে। সুযোগ পেলেই দৌঁড়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে যান। কয়েকবার পানিতেও পড়ে গিয়েছিলেন। তাই ঘরের ভেতর শিকলবন্দী অবস্থায় থাকতে হয়। অর্থের অভাবে মেয়েকে কোনো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে পারেননি। স্থানীয় বিভিন্ন কবিরাজি চিকিৎসা করিয়েছেন কিন্তু তাতে কোনো কাজ হয়নি। এই মেয়েকে ১৬ বছর ধইরা টানতাছি।
তিনি আরো জানান, তিনি বাড়ি বাড়ি গিয়ে সরিষা তৈল, বাদাম, চানাচুর, পান, পানের পাতাসহ বেশকিছু পণ্যসামগ্রী ফেরি করে বিক্রি করেন এবং তা দিয়ে সংসার চলান। মনোয়ারার নিজের নামে ৪ শতাংশ বসতভিটা রয়েছে। ছেলেদের সহযোগিতায় সেখানে কয়েকটি টিন দিয়ে ছোট একটি একচালা ঘর তুলেছে। তবে বড় ছেলে মাঝে মাঝে রিকশা চালাতে পরিবার নিয়ে রাজধানীতে চলে যায় সেসময় ফাঁকা ঘরে মা-মেয়ে একা থাকে আবার মা পেটের তাগিদে কর্মে গেলে মেয়েকে ঘরের মেঝেতে রেখে শিকল দিয়ে তালা মেরে চলে যায়।
মুসলিমার বড় ভাই মুসলিম উদ্দিন শেরপুর টাইমসকে জানান, তার বাবা রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন। তারা তিন ভাই ও এক বোন। তাসলিমার বয়স যখন দুই বছর তখনই তার বাবা মারা যায়। তখন থেকে তার মা চার সন্তান নিয়ে সংসারের দায়িত্ব নেন। তিনি বাজার থেকে তেল কিনে গ্রামের বাড়ি বাড়ি বিক্রি করে সংসার চালাতেন। তিন ছেলে স্বাভাবিকভাবে বড় হয়ে উঠলেও একমাত্র মেয়েকে নিয়ে পড়েন বিপাকে।
মুসলিমার আরেক ভাই মোখলেছুর রহমান শেরপুর টাইমসকে বলেন, আমার ছোট বোনের অনেক দিন ধরেই এই অসুখ। আমরা গরীব মানুষ। অনেক ছোট-খাটো কবিরাজ, ডাক্তার দেখানো হয়েছে কিন্তু কোন লাভ হয়নি। এখন জটিল অবস্থা আমার বোনের। তাই শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। এখন সরকার যদি আমাদের একটু সহযোগিতা করে তাহলে হয়তো আমার বোনটা সুস্থ্য হয়ে উঠবে।
প্রতিবেশী নাছিমা আক্তার, উমেছা খাতুন, জুয়েল, হানিসহ অনেকে শেরপুর টাইমসকে বলেন, অনেকদিন ধরে এই মেয়েটার এমন সমস্যা। তাই শিকল দিয়ে বেঁধে রাখছে তার মা। এখন মেয়েটিকে উন্নত চিকিৎসা করালে হয়তো সে সুস্থ্য হয়ে উঠবে। কারণ তাদের কাছে চিকিৎসা করার মতো টাকা নাই। যদি সরকার এই মেয়েটির চিকিৎসার ব্যবস্থা করে তাহলে মেয়ে আল্লাহ রহম সুস্থ্য হয়ে উঠবে।
নালিতাবাড়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আরিফুর রহমান শেরপুর টাইমসকে বলেন, শনিবার (৪ জানুয়ারী) সকালে আমি ওই মেয়েটিকে দেখে এসেছি। ওইসময় মেয়েটির পরিবারের হাতে নগদ ৫হাজার টাকাও দিয়েছি এবং তার ভাইয়ের চালানোর জন্য একটি ভ্যানগাড়ী ব্যবস্থা করে দিয়েছি। আমরা মুসলিমা আক্তারকে দ্রুত সময়ের মধ্যে উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা ও থাকার জন্য একটি ঘর নির্মাণের ব্যবস্থা করবো।