কাসল, হিমাচল প্রদেশের কুল্লু জেলার একটি গ্রাম। পার্বতি নদীর তীরে অবস্থিত কাসল। এই অসাধারণ গ্রাম তার সরলবর্গীয় বন ও পাহাড়ের জন্য জনপ্রিয় বেশ জনপ্রিয়। কাসল প্রকৃতিপ্রেমি এবং পাহাড় আরোহী সকলের কাছেই একটি আনন্দদায়ক জায়গা।
বেশ শীত শীত ভাব, বাস ছুটে চলেছে। দিল্লী থেকে ভোর ৫ টায় শুরু করে প্রায় ১১টা ৩০ মিনিটের সময় পৌঁছলাম চণ্ডীগড়। সেখান থেকে আবার ৭-৮ ঘণ্টা পাহাড়ি রাস্তা পেরিয়ে হিমাচল প্রদেশের ভুনটুর পৌঁছাতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। মানালিগামী যে কোনো বাসে চড়লে ভুনটুর যাওয়া যায় সেখান থেকে, কাসল তোষ আর মনিকরনের রাস্তা আলাদা হয়ে গেছে। দীর্ঘ বাস যাত্রার ধকলে সেই দিন আমরা ভুনটুরেই রাত কাটালাম। পরেরদিন সকালে হিমাচলের বিখ্যাত সাদা বাস সবুজ বর্ডার দেয়া, আমরা যাত্রা শুরু করলাম কাসলের উদ্দেশ্যে।
রাস্তা আঁকা বাঁকা পথে এগিয়ে গেছে, পথের মধ্যে মাঝে মাঝেই আপেল গাছ। লোকাল বাসে যাবার সুবিধা একটাই স্থানীয় মানুষদের সঙ্গে একাত্ম হওয়া যায়। বাসের মধ্যে উঠল হিমাচলের প্রধান পোশাক পরা একদল কচি-কাঁচার দল। সামনের গ্রামে শিবরাত্রি উপলক্ষে যাত্রাপালা করবে। প্রত্যেকের মধ্যেই যেন খুশির হাওয়া বইছে। শুনলাম মানডিতে শিবরাত্রির বিশাল মেলার আয়োজন হয়েছে। বাসে ওঠা একদল যাত্রী তাদের স্থানীয় ভাষায় গান ধরেছে। দু’পাশে আপেলের ক্ষেত, মাথার ওপর মুক্ত নীল আকাশ আর তাতে সাদা মেঘের ভেলা আর দূরে খাড়া পাহাড়ের হাতছানি, ভেসে যাচ্ছিলাম বন্ধুত্বের দেশে।
আমরা যখন কাসল পৌঁছলাম তখন প্রায় ১ টা। বাস থেকে নামতেই শীতল ঠাণ্ডা বাতাস এসে জড়িয়ে ধরল আমার পুরো শরীর। অপূর্ব সুন্দর একটা ছোট পাহাড়ি গ্রাম কিন্তু এর আদব কায়দা পুরো বিদেশি কেতায়। প্রচুর বিদেশি পর্যটক এখানে আসে। কাসল থেকে ২১ কিলোমিটার দূরত্বেই আছে মালানা গ্রাম। সেখানেই পাওয়া যায় বিখ্যাত মালানা ক্রিম অর্থাৎ মালানার মারিজুয়ানা। আগেই শুনেছিলাম কাসল হল আধুনিক হিপিদের পীঠস্থান। বিশেষ করে ইজরায়েল স্পেন রাশিয়ার বহু হিপিরা এখানে আসে। আমার হিপিদের বেশ পছন্দ; কারণ হিপিদের জগৎটাই একদম স্বতন্ত্র আর আলাদা রহস্যে পূর্ণ।
আগেই শুনেছিলাম কাসলের বিখ্যাত ‘দ্য এভারগ্রীণ ক্যাফে’র নাম। আমরা একটা সস্তার হোটেলে জিনিসপত্র রেখে গেলাম সেখানে। ভেতরে ঢুকে চক্ষু চড়কগাছ। এ যেন চলে এসেছি সত্তরের দশকের হিপি সম্প্রদায়ের মধ্যে। ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন একদল বিদেশি সঙ্গে চলছে বব মারলের গান, আলো আধারির মাঝে দেখতে পেলাম দেয়ালে টাঙানো অসংখ্য ছবি, কাঁচের জানলার বাইরে নীল ধুয়ো মাখা পাহাড়ে সাদা আলপনা।
স্প্যানিশ ডিস নিলাম তাতে দেয়া দু’টা চিকেন কিমার স্যান্ডউইচ, রঙ বেরঙের সবজির সালাদ, একটা অমলেট, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, আর সঙ্গে হট চকলেট। দু’টা জার্মানি মেয়ের সঙ্গে আলাপ হলো; ওরা হ্যামবারগ থেকে এসেছে। কাসলে ওদের ১৫ দিন হয়ে গেল। বুঝতে বাকি রইলো না, জায়গাটির প্রেমে পড়েছেন এই দুই সুন্দরী। এরপর ওরা যাবে পৃথিবীর এক প্রাচীন শহর বেনারস। ট্রাভেলিং এর একটা দারুণ মজা। বহু মানুষ বিভিন্ন দেশ তাদের বিভিন্ন ভাষা বিভিন্ন সংস্কৃতি বিভিন্ন চিন্তাধারার সঙ্গে প্রতিনিয়ত পরিচিত হতে হতে ভাবি আর বিশ্বমানব হতে চেষ্টা করি।
কাসলের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে সুন্দরী পাহাড়ি সবুজ নীলের স্রোতস্বিনী পার্বতি নদী। দূরে বরফ মোড়া পাহাড়ের গায়ে মেঘ জমতে শুরু করেছে। বাঁশের তৈরি ব্রিজ দিয়ে পার্বতি নদী পেরিয়ে আমরা হাঁটা শুরু করলাম ওপাশের পাহাড়ি গ্রাম ছালালের পথে। পাইনের ঘন বন, নিস্তব্ধতা, প্রচুর নাম না জানা পাখির মিষ্টি ডাক, হঠাৎ করে গ্রামের এক চিলতে কাঠের ঘর থেকে ভেসে আসা বাচ্চার মিষ্টি হাসি। পাশে নীল সবুজ পার্বতির উত্তাল গর্জন সব মিলিয়ে মন্ত্রমুগ্ধের মতো এগিয়ে যাচ্ছিলাম। দেড় কিলোমিটার পথ আমরা ৩০ মিনিটের আগেই পৌঁছে গেলাম। দেখলাম অনেক অ্যাডভেঞ্চার টিম জঙ্গলের মাঝে নদীর পাশে তাবু খাটিয়ে ক্যাম্প ফায়ারের আয়োজন করছে।
পার্বতি নদীর একদম গায়ে লাগানো একটা ক্যাফেতে ফ্যানা ওঠা ধূমায়িত কফি পান করে আমরা কাসলের পথ ধরলাম। কাল সকালে মনিকরন হয়ে তোষ গ্রামে পাড়ি দিবো। দু’দিন কাসলে থেকে কাসলের বোহেমিয়ানার প্রেমে পড়েছি। রাতে স্বাদ বদলের জন্যে গেলাম ‘ব্লু মুন নাইট ক্যাফে’তে। এটা একদম পার্বতি নদীর সামনের পাড়ায় অবস্থিত। বেশি লোক নেই ক্যাফেতে। দেখলাম কেবল একজন একটা টেবিলে বসে ডায়েরি লিখছে।
আলাপ হলো অস্ট্রেলিয়া থেকে আসা তরুণী ভ্রমণ লেখিকা জেফিনির সঙ্গে। তার গলায় এক বিষাক্ত সাপের ট্যাটু। চোখের মনি সবুজ আর মাথার চুল নীলচে। জেফিনির থেকে জানলাম সে হিমাচল প্রদেশের পার্বতি ভ্যালির উপর ডকুমেন্টারি ফিল্ম বানাতে চায়। কথায় কথায় চলে এলো গরম গরম চিকেন চাউমিন, টুনা পাস্তা, চিলি মাশরুম আর জেফিনির গ্রিন সালাদ। চাঁদের আলোয় পার্বতি নদীর ধারে জমে উঠল আমাদের আড্ডা।