প্রিয়জন হারিয়ে যাচ্ছে না তো?
-ইমরান হাসান রাব্বী
আমার সহোদর, আমার জীবনের সবচেয়ে প্রিয় মানুষ। সদ্য এসএসসি শেষ করে একটি কলেজে ভর্তি হয়েছে। তথ্য প্রযুক্তির কল্যাণে স্মার্টফোনের সাথে তার সখ্যতা অনেক আগে থেকেই। যদিও পারিবারিকভাবে এসএসসির পর সে মোবাইল ফোন হাতে পায়। তবুও মাধ্যমিকের গন্ডি থেকেই বন্ধুদের মাধ্যমে অনলাইন গেমিং এর জগতে পদচারণা তার। সম্প্রতি তার কয়েকজন বন্ধুর অভিভাবকের সাথে কথা বলে জানতে পারি, অভিভাবকদের জিম্মি করেই তার বন্ধুদের মধ্যে অনেকেই মাধ্যমিকে পড়াকালে স্মার্টফোন কিনে নিয়েছে। কারণ হিসেবে বলেছে, গেম খেলার জন্য ফোন লাগবে। আর তাতেই নাকি সব বাজে অভ্যাস দূর করে পড়ায় মনোনিবেশ করবে তারা। অভিভাবকরাও সন্তানের প্রস্তাবে খুশি হয়েই স্মার্টফোন কিনে দিয়েছে প্রিয় সন্তানের হাতে।
এই অবস্থা শুধু আমাদের শেরপুরে নয়। বরং আধুনিকতার সাথে তাল মেলাতে গিয়ে আমরা সবই গুলিয়ে ফেলছি। একসময় আমরা (সন্তানরা) অভিভাবকদের নির্দেশে চলতাম, আর এখন অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের নির্দেশনায় চলছে। এটা খুব বাজে একটা দিক। সন্তান কোথায় যাচ্ছে, কি করছে এসব দিকে খেয়াল নেই কারোরই। হাল ছেড়ে দেবার সময় অতি সন্নিকটে; এখনো যদি প্রিয় সন্তান আর প্রিয় মুখের ব্যপারে সচেতন না হই, সময় ফুরিয়ে গেলে আর সাধন হবে না।
বছর দুয়েক আগে ক্যাশ অব ক্ল্যান নামের একটি গেমসের মাধ্যমে আমাদের দেশের ছেলে মেয়েরা অনলাইন গেমের প্রতি আকৃষ্ট হয়। নিজের সৈন্য বাড়ানো, নিয়ম করে যুদ্ধে যাওয়া। অস্ত্র ও গোলাবারুদ মজুদ করা, দিনশেষে বন্ধুরা মিলে ক্ল্যানে আক্রমণ করা। আমার চোখের সামনে অনেক বইপোকাদের এই গেমের কারণে হারিয়ে যেতে দেখেছি। কিশোর বয়সী ও তরুণদের নিজের একটা ক্যাশ অব ক্ল্যানের আইডি নেই, এমন মানুষ পাওয়া কঠিন। এমনও দেখেছি, নিজের স্মার্ট ফোন না থাকলেও বন্ধুদের ফোন দিয়ে হলেও একটা আইডি থাকা চাই। যদিও পাবজি, ফ্রি ফায়ার আর তাসের নিচে চাপা পড়েছে ক্যাশ অব ক্ল্যান গেমটি। তবে এটা বুঝেছি, এইসব গেম ছেলে মেয়েদের যথেষ্ট সময় নষ্ট করাচ্ছে। দিনের বেশির ভাগ সময় তাদের এটা ভাবতেই চলে যাচ্ছে, কখন গেমে ঢুকে একটু ঢুঁ দেয়া যাবে!
বর্তমান যুগে শিশু, কিশোর ও তরুণরাই বেশিরভাগ সময় অনলাইনে গেম খেলছে। সময় কাটায় মোবাইল ও কম্পিউটারে, যা ভাবিয়ে তুলছে মা-বাবাসহ শিক্ষক, চিকিৎসক এবং শিশু বিশেষজ্ঞদের। আমার পরিচিত মাধ্যমিক পড়ুয়া এক শিক্ষার্থী। সারা দিন গেম নিয়ে ব্যস্ত, মা–বাবার সঙ্গে কোনো দাওয়াতে যেতে চায় না, বন্ধুদের সঙ্গে মেশে না, গল্পের বই পড়ে না। ক্রিকেট বা অন্য কোনো খেলাও খেলে না। ডিজিটাল পর্দার গেম ছাড়া তার আর কোনো কিছুতে আগ্রহ নেই। বাসায় কয়েক মুহূর্তের জন্য ওয়াই–ফাই বন্ধ থাকলে তার উৎকণ্ঠা বেড়ে যায়। অস্থিরতা শুরু করে। মা–বাবা রাগ করে তার মুঠোফোনটি কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করতেই শান্ত–সুবোধ ছেলেটি অগ্নিমূর্তি হয়ে ধুমধাম করে বাসার দরজা আটকে দেয়, মা-বাবাকে কটুবাক্য বলে, চিৎকার করে আবার তার মুঠোফোনটি নিজের কবজায় নিয়ে আসে। সারা দিন ঘরের দরজা বন্ধ করে থাকে, ইদানীং স্কুলেও যেতে চায় না।
অনলাইন বা ভিডিও গেমের প্রতি শিশু-কিশোরদের আগ্রহ নতুন কিছু নয়। তবে এই আসক্তিকে সম্প্রতি ‘মানসিক রোগের’ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। সম্প্রতি গেমিং এর নেশা ঠেকাতে অনেক দেশে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। শিশুরা বেশি আসক্ত হয়ে পড়লে চিকিৎসার কথা বলছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। কিন্তু বাংলাদেশের চিত্রটি কি?
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা দীর্ঘদিন জরিপ আর গবেষণার পর ইন্টারন্যাশনাল ক্লাসিফিকেশন অব ডিজিজ ১১তম সংশোধিত সংস্করণে (আইসিডি-১১), ‘গেমিং অ্যাডিকশন’ হিসেবে একে মনোস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে গ্রহণ করেছে ২০১৮ সালের জুন মাসে।
যদিও অনলাই গেম আসক্তি বিষয়টি ইন্টারনেট আসক্তি থেকে খানিকটা আলাদা। কখনো দেখা যায় ইন্টারনেটে কেউ অতিরিক্ত পরিমাণে গেম খেলছে, কেউ পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত, কেউবা নানা সফটওয়্যার বা এসব নিয়ে মশগুল আর কেউবা ফেসবুকসহ নানান সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যয় করছে দিনের বেশির ভাগ সময়। মোটদাগে সবই হচ্ছে ননকেমিক্যাল অ্যাডিকশন বা আচরণজনিত আসক্তি। বিশ্বজুড়ে এই বিষয়ে প্রকাশিত ১৬টি গবেষণাপত্রের মেটা অ্যানালাইসিস করে দেখা গেছে কিশোর ও তরুণদের মধ্যে ৪ দশমিক ৬ শতাংশ ইন্টারনেট গেমিংয়ে আসক্তিতে ভুগছে। যাদের মধ্যে ৬ দশমিক ৮ শতাংশ হচ্ছে কিশোর আর ১ দশমিক ৩ শতাংশ কিশোরী (জে ওয়াই ফ্যাম, ২০১৮)।
বাংলাদেশে টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন—বিটিআরসির তথ্যমতে, এপ্রিল ২০১৯–এ বাংলাদেশে প্রায় ৯ কোটি ৩৭ লাখ মানুষ ইন্টারনেটের গ্রাহক, আর এদের মধ্যে ৮ কোটি ৭৯ লাখ ব্যবহারকারী মুঠোফোনের মাধ্যমে ইন্টারনেটে যুক্ত হয়। ২০১৬ সালের তথ্যমতে, বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের ৩৫ শতাংশ হচ্ছে মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থী অর্থাৎ বয়ঃসন্ধিকালের কিশোর–কিশোরী। এরাই কিন্তু গেমিং আসক্তি হওয়ার সবচেয়ে বড় ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।
মূলত ইন্টারনেট গেম আসক্তি অন্যান্য নেশাজাত দ্রব্যের (ইয়াবা, হেরোইন, গাঁজা, মদ ইত্যাদি) আসক্তির মতোই। পার্থক্য হচ্ছে এটি আচরণগত আসক্তি, আর অন্যান্য নেশাজাত দ্রব্যের আসক্তি, রাসায়নিক আসক্তি। মস্তিষ্কের যে অংশে (রিওয়ার্ড সেন্টার) ইয়াবা বা গাঁজার মতো বস্তুর প্রতি আসক্তি জন্ম নেয় ঠিক সেই অংশেই কিন্তু ইন্টারনেট বা গেমের প্রতি আসক্তি জন্মায়। তাই একে হালকা করে দেখার সুযোগ নেই।
অনলাইন গেমের কবলে পড়ে শিশু কিশোরদের বই পড়ার আগ্রহ কমেছে, নতুন কিছু চিন্তার করার মানসিকতা বাঁধাগ্রস্থ হচ্ছে। সামাজিক মূল্যবোধ নষ্ট হচ্ছে। পারিবারিক জীবন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বাবা-মাসহ পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হতে শুরু করেছে। সামাজিক দক্ষতা কমে যাচ্ছে। সামাজিক অনুষ্ঠান বর্জন করার কারণে নিজেকে প্রস্ফুটিত করার প্রবণতাও কমে যাচ্ছে। ব্যক্তিগত জীবনও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
আমাদের উচিৎ খুব দ্রুতই আমাদের সন্তানদের অনলাইন গেমিং এর কবল থেকে মুক্ত করা। নতুবা চোখের সামনে প্রিয়জন ধ্বংস হয়ে গেলেও কিচ্ছু করার থাকবে না। প্রিয়জন হারিয়ে যাবার আগেই, প্রিয়জনকে বোঝাতে হবে। এখনই সময়, নতুবা সময় গেলে সাধন হবে না।
লেখক : ইমরান হাসান রাব্বী,
সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টার, শেরপুর টাইমস,
জেলা প্রতিনিধি, ডিবিসি নিউজ ও দৈনিক দেশ রুপান্তর।
মেইল : emranhasan.rabbi@gmail.com
শেরপুর টাইমস ডট কম-এর মতামত পাতায় প্রকাশিত লেখার দায়ভার লেখকের নিজের। এর দায় শেরপুর টাইমস কর্তৃপক্ষ গ্রহণ করবে না। সমসাময়িক বিষয় নিয়ে শেরপুর টাইমসের মতামত পাতায় আপনিও আপনার মতামত জানাতে পারেন sherpurtimesdesk@gmail.com এই মেইলে।