চলছে ঈদের আনন্দ। ঈদকে ঘিরে খুশির বাঁধ ভেঙে গেছে যেমন অনেকের, তেমনি ঈদের ছুটিতে প্রিয় মানুষকে কাছে পেয়ে আনন্দে মাতোয়ারা প্রায় সবাই। এমন আনন্দ এখন ঘরে ঘরে হলেও কিছু মানুষের নেই কোনো ফুরসত। ঈদ উৎসবেও কিছু পেশার মানুষের জীবনে নেই না অবসর। মেলে না ছুটি। পেশাগত দায়িত্ব পালনেই তৎপর থাকতে হয়।
পরিবার-পরিজন, বন্ধু-বান্ধব সবাই যখন ঈদের খুশি ভাগাভাগিতে ব্যস্ত, পেশাগত কারণে দায়িত্বের বোঝা মাথায় নিয়ে কিছু মানুষ থাকে উৎসব-আনন্দের ঊর্ধ্বে। শেরপুরের বেশকিছু সরকারী-বেসরকারী দপ্তরের কর্মকর্তা কর্মচারীদের দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়েই চলছে তাদের ঈদ আনন্দ।
ঈদের সময় বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও শহরের পরিচ্ছন্নতাকর্মী, পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস কর্মী, এম্বুলেন্স ড্রাইভার, কারাগারের দায়িত্বপ্রাপ্তরা, পরিবহনকর্মী, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে দায়িত্বরত বেসরকারী নিরাপত্তাকর্মীসহ বেশ কিছু পেশার কর্মজীবীদের ঈদের দিনেও কাজ করতে হয়।
ঈদ মানে আনন্দ, ঈদ মানে খুশি। পরিবার-পরিজন, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজনদের নিয়ে আনন্দ ভাগাভাগির মাধ্যমে ঈদ উদযাপন করে সবাই। কিন্তু কিছু মানুষ ঈদকে এভাবে ভাবতে পারে না। দায়িত্ব তাদের এভাবে ভাবতে দেয় না। ঈদও তাদের জন্য অন্য দিনগুলোর মতোই কর্মমুখর একটি দিন।
তাদের কারণে শহর থাকে সচল। সড়কে চলে বাস, ঘুড়ে শিশুপার্কের রাইড। ঈদের দিনে নিরাপত্তা প্রদান, বাসায় বিদ্যুৎ, কলে পানি আর চুলায় গ্যাস, সচল ছিল টেলিফোন; শহর থাকবে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। এর পেছনে রয়েছে এসব সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের কিছু মানুষের কর্মকুশলতা। ঈদের দিনে ঘর নয়, তাদের জায়গা কর্মস্থল।
ঈদের দিনও কর্মক্ষেত্রে যারা দায়িত্ব পালনে ব্যস্ত তাদের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, পৌরসভার পরিচ্ছন্নতাকর্মী, বিভিন্ন অফিসের নিরাপত্তা কর্মী, চিকিৎসক, নার্স, আয়া ও সাংবাদিকসহ আর অনেকে এ দিনে প্রতিদিনের মতোই দায়িত্ব পালনে ব্যস্ত। ঈদে সবাই নাড়ীর টানে বাড়ীর পানে ছুটে গেলেও এসব পেশায় কর্মজীবীদের ছুটি নেই।
জরুরি সেবা কর্মীরা কাজ করে যাবে ঈদের দিনও। বিপদগ্রস্থ মানুষ বা শৃঙ্খলা রক্ষায় আর-দশটি দিনের মতোই কাজ কর্মব্যস্ত থাকবে তারা। এ ভূমিকার তেমন প্রচার না থাকলেও ব্রত যখন জনসেবা, তখন খুব বেশি আক্ষেপ নেই তাদের।
ঈদের ছুটিতে শহর ফাঁকা হলেও যান চলাচল নিয়ন্ত্রণে কাজ করতে হবে ট্রাফিক পুলিশকে। অন্যের জীবন সহজ করতে এই মানুষদের কাজ শুরু সেই ভোর থেকে। স্বজনদের কাছ থেকে দূরে থাকার বেদনা ভুলেছেন তারা অন্যের সুখ দেখে।
ট্রাফিক সার্জেন্ট মির্জা বাসেত মিয়া শেরপুর টাইসকে বলেন, “জরুরি সেবা দেয়, এমন মানুষদের পক্ষে কাজ ফেলে ঈদ উদযাপনে যাওয়ার সুযোগ কোথায়? কর্মব্যস্ত ঈদের দিনে সবার সুখেই আমাদের সুখ।”
দূর্ঘটনাকবলিত ও অসুস্থ্য মানুষের সেবায় ঈদের দিনও সক্রিয় থাকতে হয় চিকিৎসা কর্মীদেরও। সিভিল সার্জন কার্যালয়ের মেডিকেল অফিসার মোবারক হোসেন বলেন, প্রান্তিক জেলা হিসেবে আমাদের চিকিৎসক এমনিতেই কম। তাই পুরো হাসপাতালের রোগীর বাড়তি চাপ জরুরী বিভাগের চিকিৎসকদের সামলাতে হবে। তাই তাদের ঈদও কর্মস্থলেই কাটবে।”
প্রাকৃতিক দুযোগ বা দুর্ঘটনায় পড়া মানুষের পাশে দাড়াতে তৈরি আছে ফায়ার সার্ভিসও। বিপদগ্রস্থ একটি মানুষের জীবন বাঁচানোর আনন্দ তাদের কাছে ঈদ উদযাপনের চেয়ে কম নয় কোনভাবেই। ফায়ার সার্ভিস ইউনিটের সুবল চন্দ্র দেবনাথ বলেন, ঈদের দিন জেলাজুড়ে দূর্ঘটনা কবলিত মানুষের জন্য আমরা সদা প্রস্তুত। পরিবারের সদস্যদের সাথে ঈদ উদযাপন করতে না পারার কষ্ট থাকলেও অন্যের সেবা করে সে আনন্দ পাওয়ার চেষ্টা করি।”
শেরপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) আমিনুল ইসলাম শেরপুর টাইমসকে বলেন, “দায়িত্ব পালনের জন্য জনগণের স্বার্থে প্রতি ঈদে ছুটিতে যাওয়া সম্ভব হয় না। তারপরেও কর্মস্থলে সবার সাথে ঈদ আনন্দ ভাগাভাগি করেই ঈদ উদযাপন করি।”
যদিও জরুরি সেবাদানকারী সংস্থাগুলোতে বছরের দুটি ঈদে ছুটির একটি আলাদা ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। এক ঈদে ছুটি পায় কর্মীদের একাংশ, অন্য ঈদে পায় বাকিরা। তবুও প্রিয়জন ছেড়ে অপরের মঙ্গল কামনায় কাটে এদের ঈদ।
কিন্তু কিছু বাড়তি পয়সা আয়ের জন্য ঈদের দিনেও গাড়ি চালান ইজিবাইক চালক ও রিক্সা চালকেরা। সিএনজি চালক জোবায়ের শেরপুর টাইমসকে বলেন, পরিবারের সন্তানদের নিয়ে ঘুরতে মনে চাইলেও দিন এনে দিন খাওয়া পরিবারে সে সুখ জোটে না। আজ কামাই না হলে, কালকের দিন চলবে না। তাই ঈদের দিনেও বের হতে হয়।”
একই কথা বললেন ষাটোর্ধ্ব রিকশাচালক আব্বাস আলী। রমজান মাসে অসুস্থ থাকায় ঠিকমতো রিকশা চালাতে পারি নাই। তাই বাড়তি আয়ের আশায় তিনি ঈদের দিনেও রিকশা নিয়ে বের হওয়া লগবো।”
এদিকে ঈদের নামাজের পর থেকেই শহরের বিনোদনকেন্দ্রগুলোতে দর্শনার্থীদের উপচে পড়া ভিড় শুরু হবে। এসব জায়গায় কর্মীদের ব্যস্ততা বাড়বে। শহরের পৌর শিশু পার্ক, সিনেমা হল, গজনী অবকাশ ও মধুটিলা ইকোপার্কের কর্মীদের যেন দম ফেলার সময় থাকবে না ঈদের দিনে।
এদিকে সারা দেশ যখন ঈদ আনন্দে ভাসবে তখন গণমাধ্যম কর্মীরা ছুটবেন সংবাদ সংগ্রহের পিছনে। ঈদ আনন্দের খবর পাঠকের কাছে পৌঁছে দিতেই তারা নিজেদের ঈদ আনন্দ উপভোগকে ত্যাগ করে ছুটবেন শহরের সর্বত্র। এই খবর পাঠকদের কাছে পৌঁছে দেয়াতেই যেন তাদের আনন্দ।
একটি গণমাধ্যমের সাংবাদিক নাইম ইসলাম। কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি শেরপুর টাইমসকে বলেন, ‘সবাই যখন ঈদ আনন্দ মেতে উঠেন তখন আমরা ছুটি সংবাদের পেছনে। পেশাগত কারণে আমাদেরকে ঈদের দিনও কর্মক্ষেত্রে দায়িত্ব পালন করতে হয়। পরিববার পরিজনকে ছাড়া ঈদ করলে আর যাই হোক সেই ঈদ আনন্দের মাঝে কোনও পূর্ণতা আসে না। কিন্তু সবাই যদি পরিবারের সঙ্গে ঈদ করতে চলে যান তবে পাঠকের কাছে সংবাদ পৌঁছে দেবে কে? তাই কাউকে কাউকে তো সেকরিফাইস করতেই হবে।’
সবকিছুর পরেও ঈদ সবার ভালো কাটুক। ঈদের খুশি পৌঁছে যাক পুরো বিশ্বের প্রতিটি ঘরে। ভালো থাকুক প্রিয় মানুষগুলো, ভালো থাকুক কর্মব্যস্ত প্রিয় জনের অপেক্ষায় পথ চেয়ে থাকা প্রিয় মুখগুলোও।