মানব ইতিহাসের ন্যায় কোরবানীর ইতিহাস অনেক প্রাচীন। প্রাগ ঐতিহাসিক কাল থেকে কোরবানির ঐতিহ্যগত প্রথা চলে আসছে। হযরত আদম (আ.) হতে শুরু করে যুগে যুগে আল্লাহর প্রেমের নিদর্শন স্বরুপ কোরবানির প্রথা চলে আসছে। বস্তুতঃ কোরবানির ইতিহাসের মূল দর্শন হচ্ছে ত্যাগের ইতিহাস। আল্লাহর সান্নিধ্য অর্জনের জন্য যে ত্যাগের প্রয়োজন হয়, কোরবানি হলো তারই একটি বিশেষ প্রশিক্ষণ। এ প্রশিক্ষণ কাজটি যেমন অতীত যুগেও ছিল তেমনি বর্তমানেও রয়েছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। আল্লাহপাক তার কালামে ইরশাদ করেন ‘আমি প্রত্যেক উম্মতের জন্য কোরবানির প্রচলন জারি রেখেছি’ (সুরা হজ্জ-৩৪)। মানব ইতিহাসের ন্যায় কোরবানীর ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
কোরবানির পশু:
ছাগল, ভেড়া, দুম্বা, গরু, মহিষ ও উট এই ছয় ধরনের পশু দ্বারা কোরবানি দেয়া যায়। এর বাইরে অন্য কোনো পশু দ্বারা কোরবানি বৈধ নয়। ছাগল, ভেড়া, দুম্বা কমপক্ষে এক বছর বয়সের হতে হবে। গরু ও মহিষের বয়স কমপক্ষে দুই বছর হতে হবে। উটের বয়স কমপক্ষে পাঁচ বছর হতে হবে। কোরবানির পশু ভালো এবং হৃষ্টপুষ্ট হওয়াই উত্তম। কোরবানির পশুতে কোনো খুঁত থাকা যাবে না।
শরিকানা কোরবানি:
ছাগল, ভেড়া, দুম্বায় একজনের বেশি শরিক হয়ে কোরবানি করা যায় না। এগুলো একটি একজনের নামেই কোরবানি দিতে হবে। গরু, মহিষ, উটে সর্বোচ্চ সাতজন শরিক হতে পারেন। তবে কারও অংশ সাত ভাগের এক ভাগের চেয়ে কম হলে তা হবে না। মৃত্যের নামেও কোরবানি হতে পারে। যার ওপর কোরবানি ওয়াজিব তার নামেই কোরবানি দিতে হবে। নিজের নামে দেওয়ার পর আত্মীয়-স্বজনের নাম যোগ করা যাবে। তবে নিজের নাম না দিয়ে অন্যের নামে কোরবানি করা ঠিক হবে না। শরিকানা কোরবানিতে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করা চাই। কারণ কারও উদ্দেশ্যে সামান্য ভেজাল থাকলে সবার কোরবানি নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। এজন্য পুরোপুরি জানাশোনা আছে এমন লোকদের শরিক করা উচিত।
জবাই করার নিয়ম:
নিজের কোরবানির পশু নিজে জবাই করা সবচেয়ে উত্তম। রাসুল সা. নিজের পশু নিজে জবাই করতেন। তবে অন্য কাউকে দিয়ে জবাই করানোরও সুযোগ আছে। একটি পশুতে কতজন শরিক সেটা জবাইয়ের আগেই নির্ধারণ করে নিতে হবে। জবাইয়ের সময় পশুর মাথা দক্ষিণ দিকে এবং পা পশ্চিম দিকে রেখে অর্থাৎ কেবলামুখী করে শোয়ায়ে পূর্ব দিক থেকে চেপে ধরতে হবে, তারপর ছুরি চালাতে হবে। জবাইয়ের ছুরি যেন খুব ধারালো হয়, পশুর যেন কষ্ট কম হয় সে দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। আর কোরবানি করার সময় খেয়াল রাখতে হবে সীনার উপরিভাগ এবং কণ্ঠনালীর মাঝামাঝি স্থানে যেন জবাই করা হয়। জবাইয়ের সময় আরবি নিয়ত জরুরি নয়। শুধু ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার’ বলাই যথেষ্ট। নিজের পশু কোরবানির সময় পাশে থাকা উচিত।
কোরবানির গোশত:
কোরবানির গোশত তিন ভাগে ভাগ করা উত্তম। এক ভাগ নিজের জন্য, এক ভাগ গরিবদের জন্য, আর এক ভাগ আত্মীয়-স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীদের জন্য। তবে এ ধরনের বন্টন করা ওয়াজিব নয়, মুস্তাহাব।
পশুর চামড়া:
কোরবানির পশুর চামড়া ব্যবহারের উপযুক্ত করে কোরবানিদাতা নিজেও ব্যবহার করতে পারবেন। তবে বিক্রি করলে পুরো মূল্য সদকা করা জরুরি। সদকার ক্ষেত্রে গরিব আত্মীয়-স্বজনকে প্রাধান্য দেওয়া উত্তম।
জবাইকারী ও কসাইয়ের পারিশ্রমিক:
কোরবানির পশু জবাইকারী ও কসাইয়ের পারিশ্রমিক আলাদাভাবে পরিশোধ করতে হবে। কোনোক্রমেই তা কোরবানি চামড়া বা গোশত দিয়ে পরিশোধ করা জায়েজ নেই। অনেকে জবাইকারীকে চামড়াটি দিয়ে দেন এবং যারা কসাইয়ের কাজ করে তাদের গোশত দিয়ে দেন। এতে কোরবানি ত্রুটিপূর্ণ থেকে যায়। সামান্য কিছু অর্থের জন্য কোরবানি নষ্ট করা ঠিক নয়। তবে জবাইকারী ও কসাইকে ন্যায্য পারিশ্রমিক পরিশোধ করার পর গোশত, চামড়া দেয়া যেতে পারে। গরিব হলে চামড়া বিক্রির টাকা দান করা যেতে পারে।
ঈদের দিনের কয়েকটি আমল:
শরিয়তের সীমার মধ্যে থেকে যথাসাধ্য সুসজ্জিত হওয়া, গোসল করা, মিসওয়াক করা, যথাসম্ভব উত্তম কাপড় পরিধান করা, খোশবু লাগানো, খুব সকালে ঘুম থেকে ওঠা, ফজরের নামাজের পরই ভোরে ঈদগাহে যাওয়া, ঈদগাহে যাওয়ার আগে খুরমা অথবা অন্য কোনো মিষ্টি দ্রব্য খাওয়া, ঈদগাহে যাওয়ার আগে সদকায়ে ফিতরা আদায় করা, ঈদের নামাজ ঈদগাহে আদায় করা (ওজর ছাড়া মসজিদে ঈদের নামাজ আদায় না করা), ঈদগাহে এক রাস্তায় যাওয়া ও অন্য রাস্তায় ফিরে আসা, ঈদগাহে পায়ে হেঁটে যাওয়া, ঈদের চাঁদ দেখার পর থেকে তাকবীর পাঠ করা । তাকবীর পাঠ করার মাধ্যমে আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ করা হয়। তাকবীর হলো ‘আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার ওয়া লিল্লাহিল হামদ’।