ওরা বেশ কয়েকজন গলা ছেড়ে স্লোগান দিচ্ছিল- ‘আমার ভাই কবরে/খুনি কেন বাহিরে?’ তাদের হাতেও ছিল প্রশ্নবোধক চিহ্নের এ প্ল্যাকার্ড। গতকাল বুধবার দিনভর মানিক মিয়া এভিনিউ অবরোধ করে রেখেছিল বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। একটু দূরেই আরেকজনের হাতে প্ল্যাকার্ড- ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি/যেথায় মানুষ মরে বাসের চাপায়, হাসে মন্ত্রীমণি।’ পাশেই আরেক শিক্ষার্থীর গলায় ঝুলছিল পোস্টার- ‘বাড়ি ফেরার নিশ্চয়তা কি আছে?/ইয়েস অর নো?’ শুধু মানিক মিয়া এভিনিউয়ের অবরোধে থাকা ছাত্রীদেরই নয়; এটি এখন হয়ে উঠেছে পুরো আন্দোলনেরই স্লোগান। বাসচাপায় দুই শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার প্রতিবাদ বুধবারও রাজধানী ছিল উত্তাল। বিভিন্ন এলাকায় শিক্ষার্থীদের রাস্তা অবরোধের কারণে পুরো ঢাকাই ছিল অচল।
‘যদি তুমি ভয় পাও/তবে তুমি শেষ, যদি তুমি রুখে দাঁড়াও/তবে তুমি বাংলাদেশ।’ রাজধানীর উত্তরার বিমানবন্দর সড়কে এক আন্দোলনকারী দাঁড়িয়ে ছিল এ ছন্দময় প্ল্যাকার্ড নিয়ে। রাজপথের এ প্ল্যাকার্ড এখন ঠাঁই নিয়েছে ফেসবুকের অসংখ্য দেয়াল, প্রোফাইল পিক ও স্ট্যাটাসে। নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনরত কিশোর-কিশোরী শিক্ষার্থীদের ব্যবহূত এমন অনেক স্লোগান প্ল্যাকার্ড, ব্যানার ও ফেস্টুনে ব্যাপকভাবে আলোচিত হচ্ছে কয়েকদিন ধরে।
অতীতেও বিভিন্ন আন্দোলনে আন্দোলনকারীরা তাদের হাতে নানা প্ল্যাকার্ড, ব্যানার ও ফেস্টুন বহন করেছেন। সেসব স্লোগানে উত্তাপ ছড়িয়েছে, মিছিল মুখরিত হয়েছে, উত্তাল হয়েছে রাজপথ। তবে কিশোর-কিশোরীদের নিষ্পাপ আদর্শবোধে প্রতিজ্ঞ এসব প্ল্যাকার্ড নতুন এক আবেদন বয়ে এনেছে বলে মনে করছেন অনেকেই। কেননা, কিশোর-কিশোরীদের এসব প্ল্যাকার্ড এ কথাই বলছে- ‘৫২, ‘৬৯ ও ‘৭১ তাদের শিখিয়েছে- রুখে না দাঁড়ালে কিছুই আদায় হয় না; নিরাপদ থাকা যায় না। অবশ্য ‘অবুঝ’ এ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের লক্ষ্য শুধু নিরাপদ সড়কের জন্য। যা শুরু হয়েছে গত রোববার বিমানবন্দর সড়কে বাসের চাপায় দুই শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার পর।
কোনো সংগঠনের ডাকে নয়- ৯ দফা দাবি আদায়ে রাজপথে নেমে এসেছে স্কুল-কলেজের এ শিক্ষার্থীরা। আন্দোলনের তিন দিনের মাথায় তাদের একটা প্ল্যাটফর্ম পাওয়া গেছে, যার নাম ‘সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধ ছাত্র আন্দোলন।’ রাজধানীর সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকায় গতকাল শিক্ষার্থীদের কাছে এমন নামযুক্ত কিছু প্ল্যাকার্ড দেখা গেলেও এর সংগঠক কারা বা আদৌ আছে কি-না, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে ওই সংগঠনের ব্যানারে আজ বৃহস্পতিবার সকাল ১১টায় সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সামনে মানববন্ধন কর্মসূচির আহ্বান জানানো হয়েছে।
অবশ্য এরই মধ্যে বিমানবন্দর সড়কের সেই ঘাতক বাসের চালক-হেলপার গ্রেফতার হয়েছে। রুট পারমিটও বাতিল হয়েছে দুর্ঘটনায় দায়ী জাবালে নূর পরিবহনের দুটি বাসের। গ্রেফতার হয়েছেন বাস মালিকও। তবে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা চাইছে নৌপরিবহনমন্ত্রীর পদত্যাগ। তারা বলছে, মন্ত্রীর পদত্যাগ ছাড়া তারা সড়ক ছাড়বে না।
বাসের চাপায় দুই শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার পর ওই দিনই নৌপরিবহনমন্ত্রী ও শ্রমিক নেতা শাজাহান খান সাংবাদিকদের সঙ্গে এ সম্পর্কে কথা বলার সময় হাসছিলেন। পাশাপাশি তিনি প্রতিবেশী রাষ্ট্রের একটি উদাহরণ দিয়ে দাবি করেছিলেন, অন্য কোথাও সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে এমন আলোচনা হয় না। মন্ত্রীর এমন আচরণে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয় এবং পরদিন শিক্ষার্থীরা রাজপথে নেমে আসে। গতকালও শিক্ষার্থীদের ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ‘সার্থক জনম মা গো, জন্মেছি এই দেশে/গাড়িচাপায় মানুষ মরে, মন্ত্রী সাহেব হাসে!!!’ প্ল্যাকার্ড বহন করে স্লোগান দিতে দেখা গেছে।
গতকাল সকালে যাত্রাবাড়ী এলাকায় আন্দোলনরত কয়েক শিক্ষার্থীর হাতের প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল- ‘মা, তুমি আমার জন্য আর অপেক্ষা করো না, আমি আর ঘরে ফিরবো না।’ এমন বক্তব্যের অর্থ ও কারণ জানতে চাইলে দনিয়া কলেজের ছাত্র শিহাব নূর বলছিলেন, প্রতিদিনই গাড়ির নিচে ছাত্রছাত্রী মারা যাচ্ছে। এটা কিছুতেই থামছে না। তারা নিজেরাও জানেন না, আদৌ সুস্থভাবে ঘরে ফিরতে পারবেন কি-না। এ অনিশ্চয়তা থেকেই তারা প্ল্যাকার্ডে এমন ভাষা ব্যবহার করেছেন।
একই স্থানে যাত্রাবাড়ী আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের এক শিক্ষার্থী দাবি করেন, আজ এখানে (শনির আখড়া) অসংখ্য মানুষের সামনেই তাদের ওপর একটা চলন্ত ট্রাক উঠিয়ে দেওয়া হয়। এতে এক ছাত্রের পা পিষ্ট হয়েছে। কখন যে তাদের ওপর গাড়ি উঠবে, তা তো তারা কেউই জানেন না!
ছাত্ররা যেমন ঘাতক বাসের চালকদের ফাঁসি দাবি করছে, তেমনি এ নিয়ে নানা স্লোগানও দিচ্ছে। তারা স্লোগান দিচ্ছিল- ‘ফাঁসি ফাঁসি ফাঁসি চাই/ফাঁসি ছাড়া গতি নাই।’ রামপুরা এলাকায় এক ছাত্রীর গলায় পোস্টার ঝুলছিল- ‘ফোর জি স্পিড নেটওয়ার্ক নয়/ ফোর জি স্পিড বিচার ব্যবস্থা চাই’; ‘অনিশ্চিত জীবন চাই না’। ‘সড়কে হত্যাকাণ্ড বন্ধ হোক’সহ নানা দাবি সংবলিত ফেস্টুন ঝুলিয়ে স্লোগান দেয় তারা। এরই মধ্যে মতিঝিল এলাকায় দেখা গেল, সাদা ইউনিফর্ম পরা এক ছাত্র তার পেছনে কালি দিয়ে লিখেছে- ‘আমার ভাই ও বোনের হত্যার সুষ্ঠু বিচার চাই।’ প্ল্যাকার্ডে শিক্ষার্থীদের আহ্বান ছিল- ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার আগে নিরাপদ বাংলাদেশ গড়ূন।’
গতকাল শিক্ষার্থীরা ঢাকার বিভিন্ন সড়কে মন্ত্রী, পুলিশ কর্মকর্তাসহ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন ব্যক্তির গাড়ি আটকেও প্রতিবাদ করেছেন। তারা জনপ্রতিনিধিদের গণপরিবহনে চলাচল করার দাবিও জানিয়েছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া একটি ছবিতে দেখা যায়, এক ছাত্রের বুকে প্ল্যাকার্ড ঝুলছে- ‘জনপ্রতিনিধিদের সপ্তাহে অন্তত তিন দিন গণপরিবহনে যাতায়াত করতে হবে।’
সূত্র: সমকাল
শে/টা/বা/জ