‘আগে আমরা বিনা আহারে দিন কাডাইতাম। ওহন বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধার ভাতা পাইয়া নাতি-পুতি লইয়া ভালাই চলতাছি। সরকার আমগোরে থাহার লাইগা ঘর বানাইয়া দিছে। ওহন আমরা সুখেই আছি। তবে আমগর আবাদি জমি নাই। অহন বয়স অইছে, কবে যে মইরা যাই। তাই সরকারের কাছে আমগোর আর কোনো দাবি নাই।’ কথাগুলো শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার বিধবাপল্লী-খ্যাত সোহাগপুরের বীরাঙ্গনা হাফিজা বেগমের। মঙ্গলবার সোহাগপুর বিধবাপল্লীতে শেরপুর টাইমসকে এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন। তিনি আরো বলেন, আগে বুহের (বুকের) ভিতর দু:খ চাপা ছিলো, এহন (এখন) বুহের ভিতর থেইক্কা (থেকে) পাথর হইরা (সরে) গেছে। শুধু হাফিজা বেগম নন, এই পল্লীর যে ১২ বিধবা বীরাঙ্গনাকে সরকার মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দিয়েছে, তাদের সবাই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন সরকারের প্রতি।
আজ ২৫ জুলাই, সোহাগপুর গণহত্যা দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে সোহাগপুর বেনুপাড়া গ্রামে পাকসেনারা তাদের দোসর রাজাকার-আলবদরদের সহায়তায় চালায় নারকীয় হত্যাযজ্ঞ। গ্রামের ১৭৮ জন নিরীহ বাঙালি পুরুষকে গুলি করে ও বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে হানাদাররা। প্রায় সব পুরুষ হত্যাযজ্ঞের শিকার হওয়ায় গ্রামের নারীরা হন বিধবা। অনেককে হারাতে হয় সম্ভ্রম। মুক্তিযুদ্ধে স্বামীরা শহীদ হওয়ায় গ্রামটির নামকরণ হয় ‘বিধবাপল্লী’।
মহান মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদান ছিল সোহাগপুরের বিধবাদের। এই পল্লীতে বসবাসকারী ৩৭ বিধবার মধ্যে মারা গেছেন ১৩ জন। বেঁচে আছেন ২৪ জন। তাদের মধ্যে ১২ জনকে সরকার বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। তারা হলেন-জোবেদা বেগম (৭৬), জোবেদা খাতুন (৭৪), আছিরন নেছা (৭৯), হাসেন ভানু (৬২), সমলা বেগম (৭২), হাফিজা বেগম (৬৮), মহিরণ বেওয়া (৭০), আছিরন নেছা (৬৯), জরিতন বেওয়া (মরণোত্তর), হাসনে আরা বেগম (৬৫), হাজেরা খাতুন (৬৬) ও হাজেরা বেগম (৬৭)। তারা প্রত্যেকে এখন মাসে ১২ হাজার ৯শ টাকা করে নিয়মিত ভাতা পাচ্ছেন।
সোহাগপুর শহীদ পরিবার কল্যাণ সমিতির সভাপতি জালাল উদ্দিন (৫০) জানান, বর্তমান মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার বৃহত্তম ময়মনসিংহের কুখ্যাত আলবদর কমান্ডার কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকর করায় সোহাগপুরের বিধবারা সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তারা সরকারকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। তিনি আরও বলেন, স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে এই বিধবাদের কষ্টের সীমা ছিল না। তাদের ভাগ্যোন্নয়নে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে সরকার। এছাড়া বিধবাপল্লীর ২৯টি পরিবার থাকার জন্য একটি করে ঘর পাচ্ছে। প্রতিটি ঘরের নির্মাণব্যয় ৯ লাখ ৪০ হাজার টাকা। সোহাগপুরে যাওয়ার এক কিলোমিটার কাঁচা রাস্তাও পাকাকরণের কাজ প্রক্রিয়াধীন আছে।
এ ব্যাপারে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ শেরপুর জেলা ইউনিটের সাবেক কমান্ডার নুরুল ইসলাম হিরু বলেন, দুদফায় সোহাগপুর বিধবাপল্লীর ১২ জন বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধার সম্মাননা ভাতার জন্য গেজেটভুক্ত হয়েছেন। আরও কয়েকজনের নাম অপেক্ষমাণ তালিকায় রয়েছে।