মানুষ সামাজিক জীব। মানুষের প্রয়োজনেই মানুুষ সমাজের পত্তন করেছে। সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব হিসেবে উন্নত ও সভ্য জীবন যাপনের কথা মানুষকে আবহমানকালের গোড়াতেই ভাবতে হয়েছে। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান ও শিক্ষা আর চিকিৎসা এগুলো মানুষের মৌলিক চাহিদা। এই চাহিদার যোগদানকল্পে তথা মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশ এবং তার উৎকর্ষ সাধনে কালে কালে নানা মণীষী-মহামণীষীর আবির্ভাব ঘটেছে।
যাদের অবিমিশ্র নীরব কর্তব্য পালন আর দেশ ও জাতির সেবার মাধ্যমে বর্তমান বিশ্ব এতদূর এগিয়ে এসেছে। তাদের কেউবা ছিলেন ধর্ম প্রবর্তক, সমাজ সংস্কারক, রাষ্ট্রনায়ক, সমর নায়ক, দার্শনিক, শিক্ষাবিদ, রাজনীতিবিদ আবার কেউবা ছিলেন বিজ্ঞানী, কবি, সাহিত্যিক ও সাংবাদিক। নানা প্রতিকুলতার ভিতর দিয়ে তারা গোটা মানব জাতির কল্যাণে তিলতিল করে বিলিয়ে দিয়েছেন নিজেদের। সৃষ্টি করে গেছেন ইতিহাসের এক একটি চমকপ্রদ অধ্যায়।
মণীষীদের এভাবে নিজেদের বিলিয়ে দেয়ার পেছনে যে শক্তিটি কাজ করেছে,তার নাম-‘প্রতিভা’। ‘প্রতিভা’ মানে- সৃজনপ্রয়াসী এক প্রকার যন্ত্রণা বিশেষ। এ যন্ত্রণা প্রসূতির প্রসব ব্যথার চেয়েও মারাত্মক, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের চেয়েও ভারী’। প্রতিভার এই যন্ত্রণা সময়মত স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় প্রশমিত না হলে সেই প্রতিভাবান ব্যক্তিটির মস্তিস্ক বিকৃতি ঘটতে পারে অথবা তিনি বিদ্রোহী হয়ে উঠতে পারেন কিম্বা অকালে ঝরে যেতে পারেন। এ যন্ত্রণা বিভিন্নভাবে অনুভূত ও বিকশিত হয়।
স্থান-কাল-পাত্র ভেদে আদিম ও বর্তমান পরিস্থিতির জটিলতা নিরসনকল্পে পরিত্রাণের পথ নির্দেশক হিসেবে প্রতিভার বিকাশ ঘটে থাকে। কথিত আছে যে, প্রতি এক শতাব্দীকাল অন্তর অন্তর বিশ্বমানবের মাঝে সংস্কারক বা মহামণীষীর আর্বিভাব ঘটে। আবার একই সময়ে একাধিক মহামণীষীরও আবির্ভাব ঘটে থাকে। তবে তাঁদের পথ ধরে প্রতি যুগে যুগেই নানা মণীষীর আবির্ভার ঘটে আসছে।
বাংলাদেশের আলো বাতাস মাটি ও পানির যে অপূর্ব সমন্বয়, তাতে এদেশের ঘরে ঘরে প্রতিভার জন্ম হয়। পরিবেশগত কারণে এবং প্রকৃত অভিভাবক ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে, অবহেলা আর অনাদরে বেড়ে উঠা এসব প্রতিভাবানদের মেধাশক্তি ছাইচাপা পড়ে থাকে। পৃথিবীর প্রতিটি শিশু সবধরণের প্রতিভা নিয়েই জন্ম গ্রহণ করে ; কিন্তু সঠিকভাবে একটি প্রতিভারও মূল্যায়ণ হয় না।
অজ পাড়াগাঁ’র সেই মেধাবী ছেলেটির সকল কাকুতি মিনতি উপেক্ষা করেও তার নীরেট মূর্খ পিতা তাকে যখন পড়ালেখা ছেড়ে মাঠে হালচাষ করার নির্দেশ দেয়; সে তখন বিদ্রোহী হয়ে উঠে। হিংসায় , ক্ষোভে আর ঘৃণায় সে তখন বিদ্রোহের নীরব কান্না কাঁদে! আত্মপ্রত্যয়ের উদ্ধাহু সৈনিক হয়ে। এ বিদ্রোহ তার নিজের নয়-তার প্রতিভার ; তার মেধার। এই বিদ্রোহাত্মক কান্নার বিকাশ ঘটাবার জন্যই অনেকে ঘর ছেড়ে পরবর্তীতে মানুষের মত মানুষ হয়ে বিশ্ববিখ্যাত হয়েছেন। সৃষ্টি করেছেন যুগান্তকারী ইতিহাস।
প্রতিভার ভর সকলে সইতে পারে না। এজন্য অনেকের মস্তিস্ক বিকৃতি দেখা দেয়। পারিপার্শ্বিক ও অথনৈতিক কারণেও এমনটি ঘটে থাকে। এ জন্য দায়িত্বজ্ঞানহীন উদাস অভিভাবকরাই দায়ী । আর তাদের পেছনে কাজ করে অজ্ঞানতা ও এক রুখামী। সচেতনতা বোধের জন্য তাই সকলের আগে প্রয়োজন শিক্ষা-দীক্ষার।
প্রতিভা বিকাশে নানা অন্তরায় ও প্রতিবন্ধকতার জটিল বোঝা মাথায় নিয়েই বিশ্বের অধিকাংশ মণীষী যুগস্রষ্টা হয়েছেন। তাঁরা তাঁদের অর্থনৈতিক সমস্যা, বৈরী পারিপার্শ্বিকতা, সামাজিক প্রতিকুলতা এবং কু-চক্রীমহলের অশুভ পাঁয়তারাকে আর্শীবাদ হিসাবেই গণ্য করেছেন। তাদের মাঝে উচূ-নীচু, পাত্র-পাত্রীর ব্যবধান তো ছিলই না বরং মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই নহে কিছু মহীয়ান ’-এই স্লোগান দিয়ে মানবপ্রীতি’র সেতু রচনা করতে গিয়ে সুবিধাবাদীদের কোপানলে পতিত হয়েছেন বার বার। এ জন্য কোন কোন মহামণীষীকে ‘পাগল’ আখ্যা পেয়ে লাঞ্ছিত ও তিরস্কৃত হতে হয়েছে প্রতি পদে পদে। আবার অনাহারে অর্ধাহারেও কাল কাটাতে হয়েছে অনেককে। কেবলমাত্র ধৈর্য ও অটল মনোবলের জোরেই নানা যাতনার ভিতর দিয়ে এঁদের প্রতিভার বিকাশ ঘটেছে।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, সেক্্রপীয়ার, কাজী নজরুল ইসলাম, মহাকবি ফেরদৌসী এবং শরৎচন্দ্রের মত অনেক মণীষীর প্রাথমিক জীবন কেটেছে নিদারুণ দৈন্যতার মধ্যে। মহাকবি ফেরদৌসী আর কাজী নজরুল ইসলামের দৈন্যতা ছিল জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত । অর্থাভাবে মাইকেল মধুসুদনকে বিনা চিকিৎসায় মরতে হয়েছে।
বিশ্ববিশ্র“ত মণীষীদের তালিকায় যে সব মণীষীর নাম রয়েছে, তাদের অধিকাংশই জন্মেছেন গ্রামে ও প্রান্তিক শহরে। উচ্চ শিক্ষা,জীবিকা নির্বাহ আর প্রতিভা বিকাশের তাগিদেই তাঁদেরকে যেতে হয়েছে বড় বড় শহরে বা রাজধানীর বুকে। বিজ্ঞানী এডিসন, মহাকবি শেখসাদী, ফেরদৌসী, সেক্্রপীয়ার, নজরুল, রবীন্দ্রনাথ,শেরেবাংলা, মাওলানা ভাসানী, বঙ্গবন্ধু, শরৎচন্দ্র ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, পল্লীকবি জসিম উদ্দিন, জীবনানন্দ দাস,কুদরত-এ-খোদা, প্রমূখ ব্যক্তিত্বের জন্ম হয়েছে গ্রামে ও প্রান্তিক শহরে।
আমাদের দেশে প্রতিভার কোন মূল্যায়ণ করা হয় না। সরকার তো দূরের কথা, অনেক অভিভাবকও মনে করেন, তাদের সন্তানটি বুঝি রসাতলে গেল। তারা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজর্নকেই যথেষ্ট মনে করেন । প্রতিভা বিকাশেÍ জন্যই যে আগে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজর্ন করেত হয় , এটা তারা জ্ঞানই করেন না । শুধু এ কারণে অনেক সম্ভাবনাময় প্রতিভা অকালে ঝরে যায়। এমনকি অনেক প্রতিভাবান ব্যক্তি অবহেলা আর অনাদরে বড় হতে গিয়ে অকালে মৃত্যুবরণও করে থাকেন।
যেমন সুকান্ত জীবননান্দ এবং আবুল হাসান । সামান্য একটু উৎসাহ আর পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে এমনি আরও অনেকে প্রতিভা নীরবে ঝরে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত । কথিত আছে যে,‘এবং তুমি তোমার সাধ্যমত অন্ততঃ একটি প্রতিভার মূল্যায়ণ কর । তাতেও তোমার জীবন ধন্য ও স্বার্থক হবে।’ আমরা মূল্যায়ণ করব তো দূরের কথা, কীভাবে একটি প্রতিভাকে চিরতরে ধ্বংস করে দেয়া যায়,সবার আগে আমরা সেই কৌশলটিই প্রয়োগ করে থাকি বৈকি।
অসির চেয়ে মসী যদি অধিক শক্তিশালী হয়- তা হলে, একজন কলম সৈনিকই এক ডিভিশন সৈন্যের চেয়ে বেশী শক্তিশালী। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামই তার জ্বলন্ত প্রমাণ। অথচ একজন সাধারণ সৈনিকের পেছনে যে পরিমান অর্থ ব্যয় কারা হয়, তার কিঞ্চিৎ এসব অবহেলিত কলম সৈনিকদের পেছনে ব্যয় করলে, জাতীয় অগ্রগতি আরও দ্রুত ত্বরান্বিত হতে পারত।
শিল্প,সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিকাশ সাধনে বিভিন্ন সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান জাতীয়ভাবে যে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে-সেটাও আবার রাজধানীকেন্দ্রীক। রাজধানীর বাইরে দু’একটি প্রতিষ্ঠানের কর্মকান্ড নামেমাত্র স¤প্রসারিত হলেও, তা এক শ্রেণীর সংস্কৃতিসেবীর পকেট প্রতিষ্ঠানে পরিনত। আমাদের জাতীয় প্রচার মাধ্যম ও পত্র পত্রিকাগুলোর ভূমিকা আরও লজ্জাকর! দুঃখজনক ! নবীন সাহিত্য ও সংস্কৃতিসেবীরা বছরের পর বছর এসব প্রতিষ্ঠানে ঘুরাঘুরি করলেও এঁদের কোন পাত্তা দেওয়া হয় না; এদের লেখা ছাপানো হয় না। আবার এসব অবহেলিত ভুক্তভোগীদের লেখা অন্যের নামে প্রকাশিত বা প্রচারিত হবার ঘটনাও তেমন বিচিত্র নয়।
একজন কবিকে ঘিরে শতজন অ-কবি ব্যাঙের ছাতার মত গঁজিয়ে উঠেছে রাজধানী ঢাকায়। তাইতো কবিরাই কবিদের নিয়ে ব্যঙ্গ কবিতা লিখছেন-‘ফসলের মাঠে আপাটে গোপাটে কিছূ হারমজাদা ঘাস জন্মেছে-ঘাস’। অথবা ‘সব শালাই কবি হবে।’আর এই সংখ্যাটি কেবল রাজধানীতেই বেশী। কিছু উঠতি রেজলা টাউট আর ব্যাঙাচি মনে করে- তাদের মাধ্যমেই শিল্প ও সাহিত্যের বিকাশ ঘটছে। এদের অধিকাংশই পরশ্রীকাতর, মূর্খ ও আহাম্মক। সময় এদের আস্তাকুঁড়েই নিক্ষেপ করবে। এরা টাকার জন্য লেখে-লেখার জন্য নয়। লেখার মাধ্যমে টু-পাইস কামিয়ে জীবিকা নির্বাহের এটাই যেন তাদের একমাত্র উপায় ও অবলম্বন । রাজধানীর বাইরের কর্মকান্ডকে এরা ‘পাগলামী’ বলে উপহাস করতেও ছাড়ে না । এদের অধিকাংশই বিদেশী দালাল। তাই এদের লেখায় কোন মৌলিকত্ব খুঁজে পাওয়াুু যায় না; এদের চাতুর্য্যপূর্ণ অপকৌশল আর নষ্ট রাজনীতির কাছে প্রকৃত প্রতিভার মৃত্যু ঘটছে। এইসব ময়ূরপুচ্ছধারীদের চিিহ্নত করা প্রয়োজন সবার আগে।
আমরা জানি, বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে শিল্প,সাহিত্য ও সংস্কৃতি এবং আরও অনেক জাতীয় কর্মকান্ডের মূলভিত্তি স্থাপিত হয়েছে রাজধানীর বাইরে অর্থাৎ তাদের ভাষায় ‘তথাকথিত মফস্বলে’। এমনকি ভারত-পাকিস্তানের মত অর্ধোন্নত দেশগুলোতেও এসবের মূলভিত্তি স্থাপিত হয়েছে রাজধানীর বাইরে। আর আমাদের দেশে এর সম্পূর্ণ উল্টো। সবকিছুই রাজধানীকেন্দ্রীক। যেন ঢাকা মানেই বাংলাদেশ,বাংলাদেশ মানেই ঢাকা। আর এই মন মানসিকতা নিয়েই সবকিছুর মুল্যায়ণ করা হচ্ছে ঢাকায়। দেশের ৮৫ ভাগ গ্রামীণ মানুষকে ধোঁকা দিয়ে বোকা বানিয়ে একচেটিয়া সুবিধাবাদী কারবার আর কতদিন চলবে?
কাকে দোষ দেবেন? এদের অধিকাংশই তো গ্রাম থেকে উঠে এসেছে-এসেছে রাজধানীর বাইরে থেকে। সারাদেশে যেখানে লক্ষ লক্ষ প্রতিভা একটু উৎসাহ আর পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে অকালে ঝরে যাচ্ছে-সেখানে পঞ্চাশ টাকার লোভে হ-য-ব-র-ল গল্প, প্রবন্ধ, কবিতা আর দায়সারা গোছের প্রতিবেদন লিখে পত্র-পত্রিকা আর ইলেক্ট্রনিক প্রচার মাধ্যম গুলোতে এসব বিকল্প বেকার নকলকৌশলী ভাসমান বুদ্ধিজীবীরা সুযোগের একচেটিয়া সদ্ব্যবহার করছে। সেই যে টাউটের কথা-লুটে পুটে চুটে খাও,যত পার পাপ কর, তবে কোথাও কোন ফাঁক রেখো না।
বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার নামে বিভিন্ন রাজনৈতিক দালাল আর সরকারের চামচা সেজেছে কতিপয় নাম-সর্বস্ব পত্রিকার সম্পাদক ও সাংবাদিক। তারা জানে না,রাজনীতি হলো পঁচা নর্দমার দুর্গন্ধযুক্ত আর্বজনা। তাকে শোধন করা না গেলে জাতির ভাগ্যে বিপর্যয় ঘটবেই। নৈরাশ্যবাদের আস্তকুড়ে বসে ভন্ড সাহিত্য ও সাংস্কৃতিসেবী নৈতিকতা বিসর্জনে হাবুডুবু খাচ্ছে। এ ছাড়া, সরকারী ছত্রচ্ছায়ায় নামসর্বস্ব (আন্ডার গ্রাউন্ড প্রেস) পত্রিকার মালিক সেজে রাতের আধাঁরে কালোটাকার পাহাড় গড়ে তুলছে কিছু জাতীয় শত্র“। হাস্যকর হলেও সত্য যে, এমন কিছু অবৈধ অর্থ উপার্জনকারী ব্যক্তি আছে, যাদের পত্রিকা সম্পাদনা ও প্রকাশনার কোনরূপ যোগ্যতা নেই। অথচ স্বত্বাধিকার সূত্রে পত্রিকার সম্পাদক, ব্যবস্থাপনা সম্পাদক সেজে সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার পরিবেশকে ঘোলাটে করে আসছে। এরা আমাদের জাতীয় শত্র“। পত্রিকা প্রকাশের আড়ালে এরা দুই নম্বরী ব্যবসা করে থাকে। এসব গবেটদের নামে পত্রিকা প্রকাশের অনুমতি দেয়াতে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের অযোগ্যতাই প্রমাণিত হয়।
আমাদের আবহমানকালের ঐতিহ্যে লালিত জাতীয় সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে মসীলিপ্ত করার অপ-প্রয়াসে একশ্রেণীর নামধারী বুদ্ধিজীবি টাউট উৎকট নর্ত্তণ কৃর্দণ চালিয়ে সৃজনশীল সাহিত্য ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে যৌনতার নিষিদ্ধ জানালা খুলে বিশ্রী আবহাওয়ায় আমাদের অসুচী করছে। এই অপসংস্কৃতি ও অনুপ্রবেশকৃত সংস্কৃতি আমরা নির্বিকার চিত্তে অবলোকন করছি। কোন প্রতিবাদ-প্রতিকার করছি না। চরম আকাঙ্খা পরম তৃপ্তিতে প্রশমন হলেই প্রকৃত সৃষ্টি বেরিয়ে আসে। সে আকাঙ্খার প্রকাশ উলঙ্গ মাতলামীতে নয়। কথাটি আমাদের মনে রাখা দরকার।
অর্থনৈতিক কারণে মফস্বলের অনেকেই রাজধানীতে এসে থাকতে পারেন না। সেই সাথে পারিবারিক ঝামেলাও নানা অন্তরায় সৃষ্টি করে রাখে। মফস্বলে প্রতিভা বিকাশের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না থাকায় এসব প্রতিভাবানদের অনেকেই নীরক্ষে হারিয়ে যান অতি সাধারণ জীবন যাপনে। যাদের সাংগঠনিক কর্মক্ষমতা রয়েছে তারা নিজেদের পাশাপাশি অন্যদের প্রতিভা বিকাশে সাধ্যমত চেষ্টা করে থাকেন। অর্থনৈতিক কারণে অনেক সময় এ প্রয়াসও দীর্ঘতর হয়না। আর যারা ধূর্ত, তারা দ্রুত পাড়ি জমান রাজধানীতে। এসেই বিভিন্ন সূত্রের মাধ্যমে সুযোগের সদ্বব্যবহার করেন নিজেদের আসন পাকাপোক্ত করার জন্য। তারপর বেমালুম ভুলে যান-ফেলে আসা স্মৃতির সাগর। এদের চিন্তা-চেতনা ও লেখায় সাহিত্যিক মূল্যবোধ না থাকলেও নামের বহরেই এদের পণ্যসামগ্রী দেদারছে বিক্রি হয়ে যায়। এদের মাঝে একটি মারাত্মক ব্যাধি কাজ করে থাকে, আর সেটা হলো পরশ্রীকাতরতা। অবশ্য মফস্বলের কোন কোন তরুণের মাঝেও এই দুষ্ট রিপুটি সক্রিয় আছে। আর এই পরশ্রীকাতরতা থেকেই ‘স্বভাব শত্র“’র সৃষ্টি।
কেউ নিজে নিজে বিকশিত হতে পারে, কাউকে আবার সুযোগ সৃষ্টি করে দিতে হয়। শুধু প্রতিভা থাকলেই চলে না, পাশাপাশি সাংগঠনিক কর্মদক্ষতাও থাকতে হয়। তবে সাংগঠনিক কর্মদক্ষতা সকলের থাকে না। এইটুকু ধারণা আমাদের সকলের নেই বলেই আমরা মফস্বল থেকে রাজধানীতে এসে মফস্বলের কথা বেমালুম ভুলে যাই। আসলে মানুষ ক্ষমতার নাগাল পেলে অতীতকে ভুলে যায়, যতটুকু মনে রাখে সেটুকুও আবার ফাঁসির রজ্জুতে ঝুলিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে। তাইতো বলি, ‘শয়তান তুমি বিধাতার মত দুষ্টুমী করো না, তোমার কার্যকলাপ সংক্রামক ব্যাধির চেয়েও মারাত্মক’। আহা! চরিত্রের এমন ছিরি নিয়ে কি করে যে আমরা সুন্দরের পুঁজারী হই-ভাবতেও অবাক লাগে।
পত্র-পত্রিকায় ‘সাইফালা’ যাকে নিয়ে আলোচনা লেখে আবার সেও ‘সাইফালা’কে নিয়ে সেভাবেই লেখে। আর এভাবেই জাতীয় খেতাবে ভূষিত হয়ে যাচ্ছি আমরা ‘সাইফালারা’। অথচ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের চেহারার প্রতি ভুলেও একবার তাকাই না। ভাবিনা, কতবড় ফাঁকিবাজ আমরা। আমাদের চেয়েও কত বড় বড় প্রতিভাবান যে মফস্বলে পড়ে আছেন-সেকথাও ভাবি না। আর তাইতো আমরা এভাবে বুর্জোয়া ধ্যাণ-ধারণার ধারক ও বাহক হয়ে কু-মন্ত্রণার ফেরী করে ফিরছি নগরে নগরে, রেডিও-টিভি আর পত্র-পত্রিকায়। আমরা এমন একটি সমাজে বসবাস করছি, যে সমাজে অকুল পাথারে যাত্রী বোঝাই মাঝিহীন নৌকার মত উত্তাল তরঙ্গে হাবুডুবু খাচ্ছে। এই অর্থ-সামাজিক ব্যবস্থায় শুধুমাত্র সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি আর বলিষ্ট নেতৃত্বের অভাবে প্রতিটি মুহুর্তে আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন ঘটছে। অথচ আমাদের মাঝে এমন একটি মুরুব্বী শ্রেণী আছেন এবং তাঁরা এমন একটি স্থানে দাঁড়িয়ে আছেন, সে স্থানটি প্রগতির পথে মারাত্মক অন্তরায়। এঁরা এতই আত্মকেন্দ্রীক যে, এঁদের কাছে ঢাকা মানেই বাংলাদেশ, বাংলাদেশ মানেই ঢাকা। রাজধানীর বাইরে সারাদেশটার গায়ে ‘মফস্বল’ শব্দটি সেঁটে দিয়ে তারা বুঝাতে চান, গাঁও গেরামে কোন প্রতিভার জন্ম হয় না-হতে পারে না। অথচ এদের অধিকাংশই গ্রাম থেকে উঠে এসেছেন।
প্রতিভাই জাতির মৌল সম্পদ। মানুষ জন্মের সাথে মেধাশক্তি ছাড়া আর কিছুই নিয়ে আসে না। সদ্য ভূমিষ্ঠ শিশুটির প্রথম যে আর্তনাদ তা সমাজের জন্য নয়, সংস্কৃতি জন্য। যেহেতু বাঁচার মত বাঁচা সুন্দর করে বাঁচার নাম-সংস্কৃতি। সাংস্কৃতিক বিপ্লবই সামাজিক বিপ্লবের মূলমন্ত্র। সুস্থ্য সুন্দর ও উন্নত সমাজ গঠনের লক্ষ্যে একটি সৃজনশীল সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলের প্রয়োজন রয়েছে। আর তার জন্য প্রয়োজন-সুস্থ্য সবল পরিশ্রমী ও সৎ কর্মীবাহিনীর। সম্রাট নেপোলিয়ন বলেছিলেন ‘আমাকে পাঁচজন সৈনিক দাও আমি পাঁচটি মহাদেশ দিব’। পরিস্থিতির কাছে আত্মসমর্পণ না করা তথা আদর্শ যেখানে তালগাছ মানুষ সেখানে কঁচুলতা; প্রতিটি কর্মীর মাঝে ক্ষেত্রবিশেষে এরূপ নির্মম মানসিকতা থাকতেই হবে। তবেই প্রতিভা বিকাশের অন্তরায়গুলো দূর করতে বলিষ্ঠ সংগঠন গড়ে তোলা যাবে। এই সার্বজনীন গুরুত্ব যত দ্রুত উপলব্ধি করা যাবে, ততই মঙ্গল। আপনার আঙ্গিনা কলুষমুক্ত থাকলে বাইরের কলুষতা আপনাকে স্পর্শই করতে পারেনা। আঙ্গিনাকে কলুষমুক্ত রাখতে সাহিত্য ও সংস্কৃতিসেবীদের আরও দৃঢ়ভাবে সংগঠিত হতে হবে। মনে রাখতে হবে, মেধাহীন জাতি পশুর সমান। ১৯৭১ সনের ১৪ ডিসেম্বর হানাদার বাহিনী এদেশের বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে জাতিকে মেধাশুন্য করার নীলনক্্রা বাস্তাবায়নে তৎপর হয়ে উঠেছিল। যার ক্ষতিকর প্রভাব জাতিকে আজও শিহরিত করে তোলে।
একবিংশ শতাব্দির সূচনালগ্নে গোটা বিশ্বই আজ বৈষম্যের শিকার। একদিকে ধনবাদী দেশগুলোর অবস্থান, অন্যদিকে অনুন্নত ও উন্নয়নকামী দেশগুলোর আত্মনির্ভরশীল হওয়ার প্রাণান্ত প্রয়াস। কিন্তু মুক্তবাজার অর্থনীতি আর বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার যাঁতাকলে নিষ্পিষ্ট এসব দেশের অর্থনীতির ও শিল্পের বিকাশ মুখ থুবড়ে পড়েছে। এই প্রতিকুল অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া খুবই দূরূহ বলেই পণ্যোপনীবেশে পরিনত হয়েছে বাংলাদেশের মত অসংখ্য দেশ। অপসংস্কৃতি ও অনুপ্রবেশকৃত সংস্কৃতির আগ্রাসনে জাতীয় সংস্কৃতির আবহমানকালের লালিত ঐতিহ্য আজ ভূলুন্ঠিত। এমতাবস্থায় সকল প্রতিভার অবাধ বিকাশ এবং সঠিক মূল্যায়ণের মাধ্যমেই এই জাতীয় দূর্যোগকে মোকাবেলা করা সম্ভব। সেজন্য সকল মহলের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার কোনই বিকল্প নেই। আমাদের মনে রাখতে হবে, প্রতিটি জটিল পরিস্থিতিকে মোকাবেলা করতে গিয়ে বিশেষ বিশেষ মূহুর্তে বিজ্ঞানের এক একটি উপায় উদ্ভাবিত ভাষার এক একটি শব্দের সৃষ্টি।
লেখক : কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট এবং প্রধান সহকারী সম্পাদক, দৈনিক ঢাকা রিপোর্ট।