প্রতিমা কারিগর মন্টু চন্দ্র পাল। বয়স কয়েক বছর আগেই একশ ছুঁয়ে ফেলেছে। প্রায় ৯০ বছর ধরে মনের মাধুরী দিয়ে প্রতিমা বানিয়ে আসছেন। ছোট বয়স থেকেই বাবার কাছ থেকে শিখেছেন কাজ। তবে এখন বয়সের ভারে আর আগের মতো কাজ করতে পারেন না।
সম্প্রতি শেরপুর শহরের পালপাড়া গিয়ে কথা হয় মন্টু চন্দ্র পালের সঙ্গে। পড়ন্ত বিকালে জীবনের শেষদিকে এসেও এ কারিগর শক্ত মাটি নরম করে দেবী দুর্গার সঙ্গে গড়ে তুলছেন কার্তিক, গণেশ, লক্ষ্মী আর সরস্বতীর মূর্তি। তিনি জানান, দশ থেকে পনেরো বছর বয়স হবে; সেসময় হতেই বাবার ও দাদার হাত ধরে এ কাজ শেখা। পরে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। এই বয়সে এসেও প্রতি পুজোয় ছেলে ও ভাতিজাদের প্রতিমা বানাতে সহযোগিতা করেন।
মন্টু চন্দ্র পাল বলেন, ‘এখন চোখেও কম দেখি আর শরীরও তেমন চলে না। বয়স তো একশ ডিঙিয়ে ফেলেছি। তবে এখন আর আগের মতো কাজও নেই। কাজ করলেও তেমন একটা লাভও থাকে না। তাই নাতিরা অন্যান্য কাজ করে।’
মন্টু চন্দ্র পালের বোন বেলা রানী হোড় ভাইয়ের কাজ করার দৃশ্য দেখেছেন। তিনি বলেন, ‘জন্মের পর হতেই দেখতেছি দাদা প্রতিমা বানায়। বাবার সঙ্গে সেই ছোট থেকেই প্রতিমা বানিয়ে আসছেন। তবে এ কাজে তেমন লাভ না থাকায় জীবনমানের তেমন একটা পরিবর্তন হয়নি।’
সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা। শেরপুর পৌর শহরের পালপাড়ায় তৈরি প্রতিমা বিক্রি করা হয় এবং অর্ডারও নেওয়া হয়; যা জেলার আর কোথাও নেই। এ গ্রামে নারী-পুরুষ-শিশুরাও এ কাজে বেশ দক্ষ। এখানকার কারিগররা শেষ মুহূর্তের কাজ করে মন্দিরে মন্দিরে প্রতিমা পৌঁছে দিচ্ছেন। এ বছর শেরপুরে ১৫৬টি মণ্ডপে অনুষ্ঠিত হবে দুর্গাপূজা। এবার ২০ অক্টোবর মহাষষ্ঠীর মধ্য দিয়ে দুর্গোৎসব শুরু হবে।
পালপাড়া ঘুরে জানা যায়, আকার ও নকশা ভেদে প্রতিটি প্রতিমা বিক্রি হয় ২৫ থেকে ৬০ হাজার টাকায়। এ বছর জেলার চাহিদা মিটিয়ে তিন শতাধিক প্রতিমা যাবে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। গেল কয়েক বছরের তুলনায় চাহিদা বেশি থাকলেও কাঁচামালের খরচ বাড়ার আক্ষেপ কারিগরদের মুখে। রয়েছে কাঙ্ক্ষিত মজুরি না পাওয়ার বিষয়টি। তাই অনেকেই ছেড়ে দিয়েছেন বাপ-দাদার এ পেশা।
পঁচাত্তর বছর বয়সি প্রতিমা কারিগর দয়াল চন্দ্র পাল বলেন, পারিবারিক ঐতিহ্য ধরে রাখতে ৬০ বছর ধরে কাজ করছি। ছেলেও প্রতিমা তৈরির কাজ করে। আমাদের তৈরি প্রতিমা পাশের জামালপুর, নেত্রকোণা, ময়মনসিংহ, গাজীপুর, টাঙ্গাইলসহ বিভিন্ন জেলায় যায়। যেভাবে জিনিসের দাম বাড়তেছে, এখন কাজ করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। এরপরও পূর্বপুরুষের কাজটা ধরে রাখার চেষ্টা করছি।’
গৌরী রানী পাল বলেন, এখানে বিয়ের পর কাজ শিখেছি আমি। পরিবারের পুরুষদের পাশাপাশি শেষ সময়ে আমরাও এখন কাজে হাত লাগাচ্ছি। কয়েক দিনের বৃষ্টিতে কাজে বেশ ভাটা পড়ছে।’
জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি সুব্রত কুমার দে বলেন, এ বছর জেলায় ১৫৬টি পূজা মণ্ডপে দুর্গাপূজার আয়োজন করা হয়েছে। পূজা উৎসবমুখর করতে পুলিশ, প্রশাসন, জনপ্রতিনিধিসহ সর্বস্তরের মানুষের সহযোগিতা কামনা করছি।
পুজোতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে চার স্তরের নিরাপত্তাব্যবস্থা থাকবে বলে জানিয়েছেন পুলিশ সুপার মোনালিসা বেগম । তিনি বলেন, পূজার আগ মুহূর্তে প্রতিমা তৈরি, পূজা চলাকালে, প্রতিমা বিসর্জন ও পূজা-পরবর্তী সময়ের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা রাখবে জেলা পুলিশ। এ ছাড়া শতভাগ মণ্ডপে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন ও আয়োজকদের সম্প্রীতি কমিটি করা হয়েছে। সবার সহযোগিতা ও সমন্বয়ে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ছাড়াই পূজা সম্পন্ন হবে বলে আশা করছি।’