নওশাদ জামিল :
ছুটির দিন ছিল, গ্রন্থমেলার দ্বার খুলেছিল সকাল থেকেই। গতকাল শনিবারও ছিল উপচানো ভিড়। সকালটা মুখর ছিল বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিশু-কিশোরদের আনন্দময় উপস্থিতিতে। বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ছিল সব বয়সী মানুষের আনাগোনা। সব মিলিয়ে গতকাল মেলা প্রাঙ্গণে ছিল উৎসবের আমেজ। তবে ভিড় যত বেশি, বিক্রি তত নয়। প্রকাশকরা বলেন, আশানুরূপ বিক্রি হচ্ছে না।
প্রকাশকরা বলছেন, গ্রন্থমেলায় যারা আসে, সবাই প্রকৃত পাঠক ও ক্রেতা নয়। প্রচুর দর্শনার্থী আসে মেলায় ঘুরতে। শুধু ঘোরাঘুরি মুখ্য উদ্দেশ্য। কদাচিৎ বই কেনে, বই পড়ে তারা। দর্শনার্থীদের উদ্দেশে এক প্রকাশকের অনুরোধ—‘অন্তত একটি বই কিনুন। ’
অনেক পাঠকও জানায়, মেলায় আগতদের বেশির ভাগই দর্শনার্থী। সন্ধ্যার দিকে অসংখ্য উৎসবপ্রিয় মানুষের দিকে তাকিয়ে ধানমণ্ডির বাসিন্দা সাইদুল ইসলাম বলেন, ‘প্রচুর মানুষ এসেছে মেলায়। যত মানুষ এসেছে, সবাই যদি বই কিনত, তাহলে মেলার সব বই ফুরিয়ে যেত। ’
অনন্যা প্রকাশনীর কর্ণধার মনিরুল হক জানালেন একই কথা। আলাপচারিতায় তিনি বলেন, ‘গ্রন্থমেলায় প্রচুর দর্শনার্থী আসে, সেটা আসবেই। বইমেলায় ঘুরতে ঘুরতেই একদিন তারা বই কিনবে। বই পড়া শুরু করবে। প্রকৃত পাঠকের সঙ্গে দর্শনার্থীরাও মেলার প্রাণ। ’ সবাই বই কিনবে, বই পড়বে—তেমনটা হয় না বটে। আশার কথা, গ্রন্থমেলায় ঘুরতে ঘুরতে দর্শনার্থীদের বইয়ের প্রতি ভালোবাসা জন্মাবে। বই পড়তে আগ্রহী হবে। ফলে দর্শনার্থীদেরও মেলার প্রাণ মনে করেন ঐতিহ্য প্রকাশনীর প্রধান নির্বাহী আরিফুর রহমান নাইম। কথা প্রসঙ্গে তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পাঠক এক দিনে সৃষ্টির বিষয় নয়। তার জন্য সময় লাগবে। তবে এটা ঠিক, প্রচুর দর্শনার্থী আসে মেলায়। তারা যদি ভালো বইয়ের সান্নিধ্যে পায়, তাহলে দর্শনার্থীরাও ধীরে ধীরে হয়ে উঠবে প্রকৃত পাঠক। ’
বইমেলায় ছিলেন তরুণ কথাসাহিত্যিক মাহবুব ময়ূখ রিশাদ। আলাপচারিতায় তিনি বলেন, ‘সিরিয়াস পাঠক বরাবরই কম। সেটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে প্রতিবছরই বইমেলাকে কেন্দ্র করে নতুন নতুন পাঠক যুক্ত হচ্ছে, তাদের মধ্য থেকে উঠে আসছে সিরিয়াস পাঠক, এটা কম কথা নয়। ’ রিশাদ জানান, এবার গ্রন্থমেলায় প্রকাশিত হয়েছে তাঁর গল্পগ্রন্থ ‘ক্রশপথে নিখোঁজ গল্প’। বইটি প্রকাশ করেছে অনিন্দ্য প্রকাশ।
অনন্যা প্রকাশনীর সামনে একদল ভক্তের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছিলেন অভিনেত্রী শানারেই দেবী শানু। কবি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন তিনি। লাজুক ভঙ্গিতে শানু জানালেন, গ্রন্থমেলায় বেরিয়েছে তাঁর প্রথম কবিতার বই ‘নীল ফড়িং কাব্য’। বইটি প্রকাশ করেছে অনন্যা। কবিতা লেখা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘কবিতা ভালোবাসি, কবিতা ধারণ করি; কিন্তু আমার শব্দগুচ্ছই কবিতা-রূপ পাবে, তা ভাবিনি। বাবার (মনিপুরী কবি ও লেখক এ কে শেরাম) উৎসাহে লিখেছি কবিতাগুলো। আশা করি, পাঠকদের ভালো লাগবে। ’
জমজমাট শিশু প্রহর : লেখক-পাঠক আর প্রকাশকদের সম্মিলিত এ উৎসবযাত্রার গতকাল ছিল চতুর্থ দিন। ছিল দ্বিতীয় শিশু প্রহর। সকালবেলাটা ছিল শিশুদের উচ্ছ্বাস। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ইউনিফর্ম পরা অসংখ্য শিশু-কিশোর গতকাল ঘুরে বেড়ায় মেলা প্রাঙ্গণে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের এক কোনায় এবার তৈরি করা হয়েছে শিশুরাজ্য। তাতে থরে থরে সাজানো শিশু-কিশোরদের মজাদার সব বই। প্রথম শিশু প্রহরের মতো গতকালও ছিল প্রচুরসংখ্যক শিশুর উপস্থিতি। অভিভাবকদের হাত ধরে তারা ঘুরে বেড়ায় মেলা চত্বর।
শিশু-কিশোরদের বইয়ের প্রকাশকরা জানান, এবার শিশুদের স্টলগুলো এক কোনায় পড়েছে। এ ছাড়া স্টলগুলোর মাঝে পর্যাপ্ত ফাঁকা জায়গা নেই। ঘিঞ্জি পরিবেশ। শিশু-কিশোরদের বইয়ের জন্য বিখ্যাত আদিগন্ত প্রকাশন। প্রতিষ্ঠানটির উপদেষ্টা ফারজানা কাইয়ুম জানান, অন্যান্য জায়গায় ইট বিছানো রাস্তা তৈরি করা হলেও শিশু চত্বর বেশ অবহেলিত। চত্বরটাও অত্যন্ত ঘিঞ্জি। শিশু-কিশোররাই আগামীর পাঠক, দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ কর্ণধার। তাদের জন্য পর্যাপ্ত জায়গা দেওয়া উচিত ছিল। মেলায় তা নেই।
শেষ হলো আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলন : চারটি ভিন্ন বিষয়ের ওপর অধিবেশনের মধ্য দিয়ে শেষ হলো ‘সম্প্রীতির জন্য সাহিত্য’ শীর্ষক আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলন। বাংলা একাডেমি আয়োজিত চার দিনের সাহিত্য সম্মেলনে সাত দেশের ২৭ জন প্রখ্যাত কবি-সাহিত্যিক অংশ নেন। গত ১ ফেব্রুয়ারি অমর একুশে গ্রন্থমেলার উদ্বোধনী মঞ্চে এ সম্মেলনের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
গতকাল সম্মেলনে সমাপনী দিনের প্রথম অধিবেশনে একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে ‘অনুবাদ সাহিত্য’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। এতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন অনুবাদক অধ্যাপক খালিকুজ্জামান ইলিয়াস। আলোচনায় অংশ নেন আবদুস সেলিম। সভাপতিত্ব করেন কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা।
বিকেলে গ্রন্থমেলার মূল মঞ্চে ‘শিশু-কিশোর সাহিত্য’ বিষয়ে আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন শিশুসাহিত্যিক রাশেদ রউফ। আলোচনায় অংশ নেন আলী ইমাম, রফিকুর রশীদ ও লুত্ফর রহমান রিটন। সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক হায়াৎ মামুদ। একই মঞ্চে ‘বাংলা নাট্যসাহিত্য’ বিষয়ে আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন নাট্যজন সাজেদুল আউয়াল। আলোচনায় অংশ নেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নাট্যজন চন্দন সেন ও সুদীপ চক্রবর্তী। সভাপতিত্ব করেন নাট্যজন নাসির উদ্দীন ইউসুফ।
সব শেষে সন্ধ্যায় গ্রন্থমেলার মূল মঞ্চে ছিল বাংলা ভাষার স্বরচিত কবিতা পাঠ। অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন বাংলাদেশের কবিরাসহ আমন্ত্রিত সুইডিশ কবি ক্রিস্টিয়ান কার্লসন। সভাপতিত্ব করেন জাতীয় কবিতা পরিষদের সভাপতি অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ সামাদ।
গ্রন্থমেলায় আসা চারটি গুরুত্বপূর্ণ বইয়ের পরিচিতি মাটির সম্ভার : কবি মহাদেব সাহার কাব্যগ্রন্থ। প্রকাশ করেছে অনন্যা। কানাডাপ্রবাসী কবি দূরদেশে বসে লিখেছেন মাতৃভূমি ও দেশের মানুষের জন্য অপূর্ব কিছু পঙিক্ত। তাতে রয়েছে স্মৃতিতাড়িত ব্যথিত কবির অশ্রুবেদনার স্বাক্ষর, রয়েছে মাতৃভূমির প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসার প্রতিচ্ছবি। বইটির প্রচ্ছদ করেছেন ধ্রুব এষ। দাম ১২০ টাকা।
সাত কিশোরের অভিযান : বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলনের কিশোর উপন্যাস। মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে লেখা। মহান মুক্তিযুদ্ধে দেশমাতৃকার ডাকে সাড়া দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সাত কিশোর মুক্তিযোদ্ধা। তাদের রোমাঞ্চকর অভিযান, দেশের প্রতি অপরিমেয় ভালোবাসা নিখুঁতভাবে উঠে এসেছে এ রচনায়। বইটি প্রকাশ করেছে আদিগন্ত প্রকাশন। প্রচ্ছদ করেছেন ধ্রুব এষ। দাম ২০০ টাকা।
পুষ্পিত ফরাশ ও বেগুনি জ্যোত্স্না : বিশিষ্ট সাহিত্যিক মইনুস সুলতানের ভ্রমণকাহিনি। পৃথিবীর নানা দেশ ঘুরে বেড়ানো তাঁর শখ, পেশাও। ঘোরাঘুরি শুধু নয়, সেসব দেশ নিয়ে তিনি লেখেন মজার সব ভ্রমণ আখ্যান। এ বইটিও এর ব্যতিক্রম নয়। বেলজিয়াম, ফ্রান্সসহ ইউরোপের বহু বর্ণিল শহর ও মানুষের কথা তিনি লিখেছেন তাঁর জাদুকরী ভাষায়। পাশাপাশি তুলে ধরেছেন নানা অনুষঙ্গ। বইটি প্রকাশ করেছে বেঙ্গল পাবলিকেশনস। দাম ৫৫০ টাকা।
মায়া মেঘ নির্জনতা : কবি ও সাংবাদিক মুস্তাফিজ শফির কবিতার বই। সাংবাদিকতার পাশাপাশি কবিতা লিখছেন অনেক দিন ধরেই। তাঁর কবিতার মূল বিষয় প্রেম, বিরহ, যাপিত জীবনের নানা অনুষঙ্গ। দৃশ্য ও চিত্রকল্পের মধ্য দিয়ে কবিতায় তিনি তৈরি করেন নানা আখ্যান, তৈরি করেন নির্জনতার ভেতর মৌনমুখর আনন্দ-বেদনার স্বরলিপি। তাঁর কাব্যভাষা সহজ ও উজ্জ্বল। বইটি প্রকাশ করেছে অন্যপ্রকাশ। দাম ১০০ টাকা।
মেলায় আসা অন্যান্য নতুন বই : অমর একুশে গ্রন্থমেলার তথ্যকেন্দ্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, গতকাল মেলার চতুর্থ দিনে নতুন ১৩৯টি বই এসেছে। এর মধ্যে গল্প ২৯, উপন্যাস ১৮, প্রবন্ধ ৭, কবিতা ২৮, গবেষণা ২, ছড়া ৩, শিশুসাহিত্য ৪, জীবনী ১, রচনাবলি ২, মুক্তিযুদ্ধ ৬, নাটক ২, বিজ্ঞান ১, ভ্রমণ ৬, ইতিহাস ১, রাজনীতি ২, চিকিৎসা/স্বাস্থ্য ১, কম্পিউটার ১, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি ২ এবং অন্যান্য বিষয়ের ওপর বই এসেছে আরো ২৩টি বই।
গ্রন্থমেলায় অনন্যা এনেছে জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক মোস্তফা কামালের উপন্যাস ‘প্রিয় উইলিয়ামের আংটির খোঁজে’ ও রম্যরচনা ‘কিছু হাসি কিছু রম্য’। অনন্যা এনেছে কবি হোসনে আরা জাহানের কবিতার বই ‘নিশিন্দা পাতার ঘ্রাণ’। অনিন্দ্য প্রকাশ এনেছে আজহারুল হক ফরাজীর শিশু-কিশোর উপযোগী রবীন্দ্রজীবনী ‘আমার রবীন্দ্রনাথ’। দ্য রয়েল পাবলিশার্স এনেছে সৈয়দ ইকবালের ‘দ্বিতীয় পুরুষ’, অন্বেষা এনেছে পলাশ মাহবুবের ‘টোটো কোম্পানি ও বীর প্রতীকের মডেল’, বাংলা প্রকাশ এনেছে হুমায়ূন কবির ঢালির ‘হাতির ওজন কত’ ইত্যাদি।