ব্যক্তিগত পারফর্মেন্সের ভিত্তিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মন্ত্রিপরিষদ পুনর্বিন্যাস করতে পারেন। সরকার ও দলের নীতিনীর্ধারকরা মনে করেন, প্রধানমন্ত্রী দল এবং সরকারকে পৃথক রাখবেন। সে টার্গেট নিয়ে সদ্য অনুষ্ঠিত দলের জাতীয় সম্মেলনের এবার মন্ত্রিসভা পুনর্বিন্যাস করতে যাচ্ছেন তিনি। নতুন বছরের শুরুতেই এই পুনর্বিন্যাস হতে পারে। গত ৭ জানুয়ারির পর মন্ত্রিসভার এক বছর যারা ভালো পারফর্মেন্স দেখাতে পারেননি তাদের দায়িত্ব পুনর্বণ্টন হতে পারে।
আওয়ামী লীগের মধ্যে ত্যাগী, পরীক্ষিত ও পরিচ্ছন্ন অনেক নেতাকর্মী রয়েছেন যারা দলের সঙ্কট সময়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন, কিন্তু কাউন্সিলে মূল্যায়ন করা হয়নি, এ রকম কয়েকজনকে মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করা বা পদোন্নতি দেয়া হতে পারে। এমন ধরনের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। আর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের নতুন বছরে সরকারের মন্ত্রিসভা পুনর্বিন্যাস হতে পারে বলে জানিয়েছেন। তিনি বলেন, মন্ত্রিসভা পুনর্বিন্যাস একটি রুটিনওয়ার্ক। নতুন বছরে এটা হতে পারে।
এদিকে সরকারের ৪৭ জন মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীর মধ্যে দলীয় পদে রাখা হয়েছে শুধু ৪ জনকে। তারা হলেন, সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক, শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি ও তথ্যমন্ত্রী হাসান মাহমদু। বাকিদের দলে পদ-পদবিতে রাখা হয়নি। এর মধ্যে ৭ জন বাদ পড়েছেন।
তারা হলেন, বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুন্সি (অর্থ ও পরিকল্পনা বিষয়ক সম্পাদক), ধর্মমন্ত্রী শেখ মো. আব্দুল্লাহ (ধর্ম বিষয়ক সম্পাদক) নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী (সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক), পানি সম্পাদক উপমন্ত্রী এনামুল হক শামীম (সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক), শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল (সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক), গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম (সাবেক আইন বিষয়ক সম্পাতক), মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ফজিলাতুন নেসা ইন্দিরা (সাবেক মহিলাবিষয়ক সম্পাদক)।
সরকারের নীতি-নীর্ধারণী পর্যায়ের ব্যক্তিরা জানিয়েছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চাচ্ছেন সরকার ও দলের মধ্যে যোগসূত্র রাখতে। সেজন্যদল ও সরকারকে শতভাগ পৃথক করবেন না। যদি মন্ত্রিপরিষদ পুনর্বিন্যাস করা হয় তাহলে বর্তমানে মন্ত্রিপরিষদে থাকা দুই থেকে ৪ জনকে পদোন্নিত দেয়া হতে পারে। এক্ষেত্রে তালিকা থাকতে পারেন নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরীসহ আরো কয়েজন। তবে অনেকের নামে নিজস্ব আখের গোচানোর অভিযোগও প্রধানমন্ত্রীর কাছে রয়েছে বলে একটি নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে। এদের বাদ দিয়ে দলের একনিস্ট পরীক্ষিত, দীর্ঘদিনের ত্যাগী ২৩০ এমপির মধ্যে বেশ কয়েকজনকে নতুন মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করতে পারেন। এসব কিছু নির্ভর করবে প্রধানমন্ত্রীর ওপর।
সরকারের নির্ভরযোগ্য সূত্রের খবর, দলীয় সম্মেলনের পর কয়েকজন সিনিয়র সাবেক মন্ত্রীকে মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করার সম্ভাবনা রয়েছে। বিশেষ করে সম্প্রতি কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের ব্যর্থতায় বিব্রত সরকার। এ জন্য কয়েকজন মন্ত্রীকে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে অন্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হতে পারে। সূত্রমতে, গত এক বছরের মূল্যায়নে মন্ত্রিসভার কয়েকজন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর মন্ত্রণালয় পরিচালনায় দুর্বলতার বিষয়টি সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে দৃশ্যমান হয়েছে। পেঁয়াজসহ নিত্যপণ্যের বাজারে অস্থিরতা নিয়ে আওয়ামী লীগের ভেতরেও সমালোচনার ঝড় বইছে।
রেল মন্ত্রণালয়েও কাজের সমন্বয়হীনতা রয়েছে বলে মূল্যায়নে উঠে এসেছে। এ ছাড়া গত এক বছরে রোহিঙ্গা ইস্যুসহ কয়েকটি বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পদক্ষেপ কাজে আসেনি। চালের দাম নিয়ন্ত্রণে খাদ্য মন্ত্রণালয় ব্যর্থ হয়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা সরকারের এক বছরে মন্ত্রণালয় পরিচালনায় নানা অব্যবস্থাপনা ও অদক্ষতার কথা বলে আসছিলেন। অনেকে বর্তমান মন্ত্রিসভাকে অনভিজ্ঞ বলেও মন্তব্য করেছেন।
বিশেষ করে, কয়েকজন সিনিয়র নেতাকে মন্ত্রী না করায় আওয়ামী লীগ ও এর শরিক দলগুলোর ভেতরেই নানা সমালোচনা হচ্ছে। এ ছাড়া ১৪ দলের শরিকদের মধ্যে মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্তি নিয়েও অসন্তোষ রয়েছে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলের মতে, গত এক বছর আওয়ামী লীগ সরকার ভালো সময় পার করেনি। বিশেষ করে, ক্যাসিনো কেলেঙ্কারির সঙ্গে সরকার সংশ্লিষ্টদের সম্পৃক্ততা, পেঁয়াজের দামে রেকর্ড, শেয়ারবাজারে ধস, গণপিটুনিতে মানুষ হত্যা, রিফাত, নুসরাত ও বুয়েটে আবরার ফাহাদ হত্যার ঘটনায়, ও ভিপি নূরের ওপর হামলা সরকার বেশ বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে।
একজন প্রভাবশালী মন্ত্রী জানান, সরকার গঠনের এক বছর পূর্তি হবে আগামী ৭ জানুয়ারি। মন্ত্রিসভার সদস্যদের গত বছরের পারফর্মেন্স প্রধানমন্ত্রীর কাছে আছে। যারা ইতোমধ্যে জনগুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে অযোগ্যতার প্রমাণ দিয়েছে তাদের হয়তো কম গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে বদলি করা হবে। আর পারফর্মেন্সের ভিত্তিতে দু-একজন উপমন্ত্রী থেকে প্রতিমন্ত্রী হবেন। সরকারের ভাবমূর্তি ফেরাতে সাবেক দু-একজন মন্ত্রীকে পুনরায় মন্ত্রী করার বিষয়েও ইঙ্গিত দিয়েছেন তারা।
সূত্র জানায়, বর্তমান মন্ত্রিপরিষদের একজন প্রতিমন্ত্রী পদোন্নতি পেয়ে মন্ত্রী এবং দুজন উপমন্ত্রী থেকে প্রতিমন্ত্রী হচ্ছেন। আর রদবদলের অংশ হিসেবে কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাককে খাদ্য মন্ত্রণালয়ে নিয়োগ দেয়া হতে পারে। সে ক্ষেত্রে বর্তমান খাদ্যমন্ত্রী সাধনচন্দ্র মজুমদার পেতে পারেন অন্য কোনো মন্ত্রণালয়। বাণিজ্যমন্ত্রীকেও সরিয়ে দেয়ার জোর গুঞ্জন রয়েছে।
গুঞ্জন রয়েছে, জানুয়ারিতে মন্ত্রিসভায় রদবদল করে টিপু মুনশিকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে সেখানে সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য তোফায়েল আহমেদকে দায়িত্ব দেয়া হতে পারে। তিনি বর্তমানে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি। তোফায়েলের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে বাজার স্থিতিশীল করতে চান প্রধানমন্ত্রী। মন্ত্রিসভার সিনিয়র কয়েকজন সদস্য নিয়ন্ত্রণহীন বাজারের জন্য মূলত বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কেই দুষছেন।
তারা বলছেন, বাণিজ্যমন্ত্রীর কঠোর পদক্ষেপ ও বাজার তদারকির (মনিটরিং) অভাবে সিন্ডিকেটগুলো ইচ্ছামতো দ্রব্যমূল্য বাড়িয়ে চলেছে। এতে দেশের সাধারণ মানুষ সরকারের ওপর চরম বিরক্ত। মানুষ মনে করে, সরকার অন্যান্য ক্ষেত্রে সফলতার স্বাক্ষর রাখলেও দ্রব্যমূল্যের নিয়ন্ত্রণহীন লাগাম টানতে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। এ প্রসঙ্গে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি সম্প্রতি রাজধানীর একটি হোটেলে মতবিনিময় সভায় বলেন, কেউ কেউ আমার পদত্যাগ দাবি করছেন। পদত্যাগ করলে যদি পেঁয়াজের দাম কমে যায়, এক সেকেন্ডও লাগবে না আমার মন্ত্রিত্ব ছাড়তে।
সূত্র জানায়, কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে ড. আবদুর রাজ্জাককে খাদ্য মন্ত্রণালয় দেয়া হতে পারে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে আবদুর রাজ্জাককে খাদ্যমন্ত্রী করা হয়। এখন আবদুর রাজ্জাককে কৃষি থেকে সরিয়ে খাদ্যে নিয়ে আসা হলে কৃষিতে আগের মন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরীকে ফের বসানো হতে পারে। কৃষিমন্ত্রী হিসেবে তিনি বেশ সফলতার পরিচয় দিয়েছেন বলে মনে করছেন মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে গুঞ্জন রয়েছে, স্থানীয় সরকার (এলজিআরডি) মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলামকে সরিয়ে সেখানে সাবেক এলজিআরডি মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেনকে দায়িত্ব দেয়ার পরিকল্পনা চলছে। আর তাজুল ইসলাম মন্ত্রিসভায় থাকলেও কোন দফতর পাবেন, তা নিশ্চিত নয়। সূত্র জানায়, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলীকে পদোন্নতি দিয়ে পূর্ণ মন্ত্রী করা হতে পারে। এ ছাড়া পানি সম্পদ উপমন্ত্রী একেএম এনামুল হক শামীম ও শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলকে পদোন্নতি দিয়ে প্রতিমন্ত্রী করার সম্ভাবনা রয়েছে। শামীমকে প্রতিমন্ত্রী করে পানিসম্পদে রাখা হবে, না-কি অন্য মন্ত্রণালয় দেয়া হবে তা নিশ্চিত নয়। কারণ পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে বর্তমান প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক দায়িত্ব পালন করছেন। নওফেল পদোন্নতি পাওয়ার পর একই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকার সম্ভাবনাই বেশি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ২৫ জন মন্ত্রী, ১৯ জন প্রতিমন্ত্রী ও ৩ জন উপমন্ত্রী নিয়ে বর্তমান সরকার চলতি বছরের ৭ জানুয়ারি পথচলা শুরু করে। দলের সাংগঠনিক দায়িত্বে ছিলেন কিন্তু সরকারেও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছেন এমন কয়েকজনকে আওয়ামী লীগের ঘোষিত আংশিক কমিটিতে রাখা হয়নি। এর মধ্যে নৌ-প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরীকে পদোন্নতি দিয়ে পূর্ণমন্ত্রী করা হচ্ছে বলে জোর আলোচনা রয়েছে। রাজধানীর চারপাশে নদী দখল উচ্ছেদ অভিযান সফলভাবে পরিচালনা করে তিনি নদীর জায়গা রক্ষা করেছেন। বিভিন্ন রুটে নতুন করে নৌযান চালু ও সদরঘাটকে আধুনিক করে সরকারের প্রতি জনগণের আস্থা ফিরিয়ে এনেছেন। এছাড়া পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক পদোন্নতি পেয়ে পূর্ণমন্ত্রী হতে পারেন।
সূত্রগুলো বলছে, আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যদি দল ও সরকার আলাদা করার নীতিতে অটল থাকেন তা হলে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনিসহ কয়েকজন মন্ত্রী মন্ত্রিত্ব ছাড়ার চাপে থাকবেন। কারণ দলে তাদের সাংগঠনিক কাজ অনেক। এছাড়া আগামী ১০ মার্চের আগে সারাদেশে আওয়ামী লীগের জেলা-উপজেলার সম্মেলন শেষ করার টার্গেট রয়েছে আওয়ামী লীগের।
এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক সাম্প্রতিক রাজাকার তালিকা নিয়ে সরকারকে বেশ বেকায়দায় ফেলে দিয়েছিলেন। ভুলে ভরা এই তালিকা নিয়ে খোদ সরকার প্রধান শেখ হাসিনাকে দুঃখ প্রকাশ করতে হয়েছে। এই মন্ত্রণালয়ে রদবদল না হলেও একজন প্রতিমন্ত্রী নিয়োগ করা হতে পারে। এছাড়া পদোন্নতি পেয়ে পূর্ণমন্ত্রী হতে পারেন বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু।