ড. আবদুল আলীম তালুকদার:
মিয়ানমারের (বার্মা) রাখাইন (আরাকান) রাজ্যে বসবাসরত বর্তমান সময়ের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অবহেলিত, নির্যাতিত, নিপীড়িত, অধিকার বঞ্চিত, সহায়-সম্বলহীন ও নিজ মাতৃভূমি থেকে বিতাড়িত হতভাগ্য মুসলিম নৃ-গোষ্ঠীর নাম ‘রোহিঙ্গা’। আরাকানের সুপ্রাচীন ইতিহাস গ্রন্থ ‘রাজোয়াং’ সূত্রে জানা যায়, খ্রিস্টপূর্ব ২৬৫০ অব্দে আরাকানে স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠিত ছিল। প্রাচীন ও মধ্যযুগের অধিকাংশ সময় আরাকান ও চট্টগ্রাম অভিন্ন প্রশাসনিক ইউনিট হিসেবে শাসিত হয়। আরাকানি রাজ্যের রাজারা তাদের কর্তৃত্ব চট্টগ্রাম পেরিয়ে ত্রিপুরা ও ভূলুয়া (নোয়াখালী) পর্যন্ত বিস্তার লাভ করতে সক্ষম হন। ১৩৩৮ খ্রিস্টাব্দে বাংলার শাসক ফখরউদ্দিন মুবারক শাহ্ আরাকানিদের নিকট হতে চট্টগ্রাম জয় করেন এবং ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে আরাকানি রাজ্যের পতন ঘটে। পরবর্তীতে আরাকান অঞ্চলটি পার্শ্ববর্তী বার্মার রাজা বোধপায়ার দখলে চলে যায়। সে সময় থেকে আরাকান বার্মার একটি প্রদেশ হিসেবে শাসিত হতে থাকে।
নবী করীম (স.)’র জীবদ্দশায় বিশিষ্ট সাহাবী আবু ওয়াক্কাস ইবনে ওয়াইব (রা.)’র হাত ধরে ইসলামের পতাকা তলে সমবেত হয় আজকের আরাকানবাসী। দ্বিতীয় উমর হিসাবে খ্যাত আব্বাসীয় খলীফা হযরত উমর ইবনে আবদুল আযিয (রা.)’র শাসনামলে আরাকানের শাসকদের সাথে আরবীয় মুসলমানদের যোগাযোগের বিষয়টিও ইতিহাস থেকে প্রমাণিত। বর্তমান মিয়ানমারের রোহিং (আরাকানের পুরনো নাম) এলাকায় বসবাসকারীরা রোহিঙ্গা নামে পরিচিত। ‘রোহিঙ্গা’ শব্দের অর্থ হচ্ছে নৌকার মানুষ; যারা সমুদ্রজলে নৌকা ভাসিয়ে মৎস্য আহরণ করে জীবিকা অর্জন করেন।
ইতিহাসবিদদের মতে, আরবি শব্দ ‘রহম’ (দয়া করা) থেকে রোহিঙ্গা শব্দের উদ্ভব। খ্রিষ্টীয় অষ্টম শতাব্দীতে আরব বণিকদের বাণিজ্য তরী বার্মার রামব্রি দ্বীপের তীরবর্তী অঞ্চলে এক সংঘর্ষে ডুবে যায়। তখন সেই নৌযানের আরোহীরা ‘রহম-রহম’ বলে সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ্ তায়ালার কাছে দয়া ভিক্ষা করে এবং মহান আল্লাহ্ পাক তার অশেষ রহমতে সে যাত্রায় তাঁদের প্রাণ রক্ষা করেন। তখন থেকেই তারা রোহিঙ্গা নামে পরিচিতি লাভ করে।
১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা লাভের পর প্রকৃত গণতন্ত্রের পরিবর্তে মায়ানমার (ব্রহ্মদেশ) অবিচার ও বৈষম্যের লীলাভূমিতে পরিণত হয়। দেশটিতে বর্মন গোত্রীয় বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীর সংখ্যা ৮৯ শতাংশ এবং খ্রিষ্টান, মুসলমান ও হিন্দু এবং এনিমিস্ট ও সর্বপ্রাণবাদীদের সংখ্যা ১১ ভাগ। বার্মিজ জাতীয়তাবাদীদের মধ্যে বৌদ্ধ মৌলবাদ মাথাচাড়া দেয়। ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের ওপর চালানো হয় অবিশ্বাস্য ধরনের নিপীড়ন। তার ফলে কাচিন ইনডিপেনডেন্স আর্মি (কিয়া), কাচিন ইনডিপেনডেন্স অর্গানাইজেশন (কিও), রেস্টোরেশন কাউন্সিল অব শান স্টেট, শান স্টেট ন্যাশনাল আর্মি, কারেন ন্যাশনাল ইউনিয়ন, ডেমোক্রেটিক কারেন বুড্ডিস্ট আর্মি, ডেমোক্রেটিক কারেন বেনেভোলেস্ট আর্মি, নিউ মন স্টেট পার্টি, আরাকান লিবারেশন পার্টি, আরাকান ন্যাশনাল কাউন্সিল, রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন, আরাকান রোহিঙ্গা ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন, আরাকান চীন ন্যাশনাল ফ্রন্ট, ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট আর্মি, কাউন্সিল অব নাগাল্যান্ড খাপলাঙ প্রভৃতি বিচ্ছিন্নতাবাদী ও চরমপন্থী সংগঠন গড়ে ওঠে। এগুলোর মধ্যে কাচিন এবং কারেন স্বাধীনতা সংগ্রামীরাই মিয়ানমার সরকারকে সবচেয়ে নাজেহাল করে। তবে মিয়ানমারের উগ্র বুদ্ধবাদী সরকার শুধু মুসলমানদের ওপরই অত্যাচার করেই ক্ষান্ত হয়নি। বিভিন্ন সময় খ্রিস্টান ও হিন্দুরাও তাদের নির্যাতন থেকে রেহাই পায়নি। তারা ভারতীয় বংশোদ্ভূত হিন্দুদের বলে ‘কালা’ আর রোহিঙ্গা মুসলমানদের বলে ‘চাটগাইয়্যা’।
জাতিসংঘের অতি সাম্প্রতিক তথ্য মতে, বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে নির্যাতিত, রাষ্ট্রহীন জনগোষ্ঠীর নাম ‘রোহিঙ্গা’। বিশ্বখ্যাত সংবাদ মাধ্যম বিবিসির দেয়া সংবাদে বলা হয়েছে, গত কয়েক সপ্তাহে মিয়ানমারে প্রায় শতাধিক রোহিঙ্গা মুসলিমকে অন্যায়ভাবে হত্যা করেছে দেশটির সেনাবাহিনী এবং বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গার সংখ্যা এ পর্যন্ত ৩৫ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। নিরীহ রোহিঙ্গাদের ওপর তারা হেলিকপ্টার থেকেও নির্বিচারে গুলি ছুড়েছে। রাখাইন প্রদেশে সম্প্রতি শুরু হওয়া বিদ্রোহ দমনের অংশ হিসাবেই এই হামলা চালানো হয়েছে বলে দেশটির সেনাবাহিনী স্বীকার করেছে। যদিও রোহিঙ্গা মুসলিমরা কোনকালেই অযৌক্তিক ও অন্যায়ভাবে বিদ্রোহ করেছে বলে কোন প্রমাণ দেখাতে পারেনি দেশটির নিরাপত্তা বাহিনী।
মিয়ানমার বাহিনীর লোমহর্ষক অত্যাচারের বর্ণনা দিয়েছেন অনুপ্রবেশকারীরা। যারা সবাই আরাকান রাজ্যের চালিপ্রাং, জামবইন্যা, রাইঙ্গাদং, রাইম্যারবিল, কিয়ারীপ্রাং, বড় গউজবিল, ছোট গউজবিল, মগনামা, হাতিপাড়া প’খালীসহ বিভিন্ন গ্রামের বাসিন্দা। তারা জানান, আরাকান রাজ্যে মুসলমানদের গ্রামের পর গ্রাম পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। অনেককে পুড়িয়ে মারা হয়েছে। মহিলাদের ধর্ষণসহ বিভিন্নভাবে নির্যাতন করা হয়েছে। মিয়ানমার বাহিনীর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে প্রাণ বাঁচাতে অর্ধাহারে-অনাহারে বনে-জঙ্গলে দীর্ঘপথ ও সীমান্তবর্তী নাফ নদী পাড়ি দিয়ে টেকনাফের বিভিন্ন ঘাট দিয়ে গভীর রাতে তারা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছেন। বার্মা সরকারের নির্যাতনের কারণে এ যাবত দেশ ত্যাগে বাধ্য হয়ে ৫ লাখের বেশী রোহিঙ্গা বাংলাদেশে, ৪ লাখ সৌদি আরবে, ২ লাখ পাকিস্তানে, থাইল্যান্ডে ১ লাখসহ আরও অনেক দেশে আশ্রয় গ্রহণ করার একটি পরিসংখ্যান উইকিপিডিয়া তুলে ধরেছে। মূলত ধর্মীয় কারণেই তাদের ওপর নির্যাতন শুরু হয়েছে। সালাত আদায়ে বাঁধা দেওয়াসহ নির্বিচারে হত্যা ও নারীদের ধর্ষণের শিকার প্রতিনিয়ত হতে হচ্ছে। তাদের সম্পত্তি জোরপূর্বক কেড়ে নেওয়া হচ্ছে এবং শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না। তাদের জনসংখ্যা যাতে বাড়তে না পারে সে জন্য বিয়ে করার অনুমতিও নেই। মানবতাবাদের ধ্বজাধারী বৌদ্ধ রাখাইনদের টার্গেট হলো নিরস্ত্র রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠীকে নির্যাতনের মাধ্যমে চিরতরে নির্মূল করে ফেলা। সেই লক্ষ্যকে সামনে রেখেই স্থানীয় সরকার, কেন্দ্রীয় সরকার ও সেনাবাহিনী পরিকল্পিতভাবে রোহিঙ্গাদের সে দেশ থেকে বের করে দিতেই হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে। সম্প্রতি রোহিঙ্গাদের গ্রামগুলো যেন গণহত্যার কূপে পরিণত হয়েছে। বর্তমান ক্ষমতাসীন বার্মিজ সরকারপন্থি পত্রিকা ‘দ্য নিউ লাইট অব মায়ানমার’ সূত্রে জানা গেছে সেনাবাহিনীর সাম্প্রতিক অভিযানে ১৫টির অধিক মসজিদসহ রোহিঙ্গাদের ২ হাজারের অধিক ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। তবে ধারণা করা হচ্ছে, ইতোমধ্যে রোহিঙ্গাদের আনুমানিক ১০ হাজার বসত বাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে।
আরাকানে রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়ন নতুন কোন সংবাদ নয় এবং এর ইতিহাস দীর্ঘ। দশকের পর দশক ধরে মিয়ানমার রোহিঙ্গা নিধন চালিয়ে আসছে। ২০১২ সালের হত্যাকান্ডের সময় সে সময়কার মিয়ানমারের সামরিক এক নায়ক থেইন সেইন বলেছিলেন, ‘রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের জনগণ নয়, তাদের বিতাড়নই এ সমস্যার একমাত্র সমাধান।’ সুতরাং নির্দ্বিধায় বোঝা যায় রাখাইন তথা সাবেক আরাকান রোহিঙ্গা শূণ্য করা মিয়ামারের রাষ্ট্রীয় প্রকল্প। মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতাধন্য বৌদ্ধ উগ্রপন্থীরা রোহিঙ্গাদের ধ্বংস প্রত্যাশা করে। তথাকথিত গণতন্ত্রের মানসকন্যাখ্যাত, অহিংস জননেত্রী অং সান সুচিও রোহিঙ্গা বিতারণের পরোক্ষ সমর্থক।
রোহিঙ্গা মুসলমানদের অপরাধ দুটি : (১) তাদের ধর্ম ইসলাম আর (২) তাদের ভাষা বাংলা। যেহেতু তারা বাংলাভাষী মুসলমান, তাই তারা হয় ভারতীয় নাহলে ‘চাটগাইয়্যা’ বা বাংলাদেশী, যাদেরকে বৃটিশরা আরাকানে এনেছে। যদিও ঐতিহাসিকভাবে এটি প্রতিষ্ঠিত যে, ব্রিটিশরা বার্মায় শাসক হিসাবে আবির্ভাবের কয়েক শতাব্দী পূর্ব হতেই রোহিঙ্গারা আরাকানে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ জাতি হিসাবে বিকশিত হয়েছিল।
রোহিঙ্গা সমস্যা মিয়ানমারের নিজস্ব সমস্যা। কিন্তু তা এখন একটি কঠিন আঞ্চলিক সমস্যায় রূপ নিয়েছে। আঞ্চলিক সমস্যা আন্তর্জাতিক সমস্যাও বটে। গত মাসাধিককাল যাবত প্রায় প্রতিদিনই রোহিঙ্গাদের বসতভিটা, দোকান-পাট, স্কুল-মাদ্রাসা-মক্তব, মসজিদ জ্বালিয়ে দিয়ে, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে নৃশংসভাবে হত্যা করে তাদের বাংলাদেশের দিকে ঠেলে দিচ্ছে সরকারি-আধা সরকারি নিরাপত্তা বাহিনী। ইদানিং কালের বিশ্ব গণমাধ্যমের প্রধান খবরই হচ্ছে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নির্যাতন। বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী এদেশের দিকে ছুটে আসা অসহায় রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের ¯্রােত ঠেকিয়ে রাখতে অনেকটা হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে। মানবিক কারণে তাদের অনেককে আশ্রয় দিতেও হচ্ছে। বর্তমানে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত ও সীমান্তবর্তী উদ্বাস্তু শিবির গুলোতে যে চরম মানবিক সংকট বিরাজ করছে যা নিজ চোখে না দেখলে তা সঠিকভাবে অনুধাবন করা কঠিন।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মিয়ানমারের আরাকানে সেনা অভিযানে উদ্বেগ প্রকাশ করেই দায় মিটিয়েছে, যা সত্যিকার অর্থেই হতাশাব্যাঞ্জক আর দূর্ভাগ্যজনক তো বটেই। রোহিঙ্গাদের অস্তিত্ব রক্ষায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সক্রিয় হলে একদিকে যেমন মিয়ানমারের জাতিগত সংঘাতের ইতি ঘটানো সম্ভব, তেমনি বাংলাদেশও রক্ষা পাবে অনাকাঙ্খিত সমস্যা থেকে। রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সেনা অভিযান শুধু অমানবিকই নয়, অবিবেচনাপ্রসূত-অনৈতিক বললেও কম বলা হবে। আমরা রোহিঙ্গাদের এক ক্ষুদ্র অংশের জঙ্গিবাদ ও উগ্রবাদচর্চার বিরোধী, তবে সুনিশ্চিতভাবে বলা যায় সাধারণ রোহিঙ্গাদের অধিকাংশের সাথে তাদের দূরতম সম্পর্কও নেই। বিদ্রোহী ও উগ্রবাদীদের দমনের নামে সাধারণ রোহিঙ্গা মুসলমানদের জানমাল-সম্ভ্রমের ওপর হামলা মিয়ানমারের শান্তিবাদী ভাবমূর্তিতেও কলঙ্ক লেপন করছে। মিয়ানমারের জাতীয় ঐক্যের স্বার্থে এবং ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায় নির্বিশেষে রাষ্ট্রের সকল নাগরিকের জান-মাল-সম্ভ্রম রক্ষার্থে অনতিবিলম্বে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে কান্ডজ্ঞানহীন অভিযান, বসতভিটায় অগ্নিসংযোগ ও পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞের অবসান হওয়া উচিত বলে আমরা মনে করি।
লেখক: কবি, গবেষক, প্রাবন্ধিক ও সহকারী অধ্যাপক, সরকারি সোহরাওয়ার্দী কলেজ, পিরোজপুর