শনিবার , ৪ঠা মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ || ২১শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ - গ্রীষ্মকাল || ২৪শে শাওয়াল, ১৪৪৫ হিজরি

আর কতদূর পিয়ারপুর ! রেল লাইনের দাবীতে একাট্টা শেরপুরবাসী

প্রকাশিত হয়েছে -

শেরপুরে দির্ঘদিনের কাংক্ষিত রেলপথ নিয়ে সম্প্রতি রেল মন্ত্রির ঘোষনার পরও অদৃশ্য ছায়ায় ঢাকা পড়ে আছে পিয়ারপুর-শেরপুর রেলপথ নির্মান প্রকল্প। এদিকে শেরপুর জেলাসহ পাশ্ববর্তী জামালপুর ও কুড়িগ্রাম জেলার আরো ৪ টি উপজেলার প্রায় ২০ লাখ মানুষের এখন প্রাণের দাবী হয়ে উঠেছে জামালপুর জেলার পিয়ারপুর হতে শেরপুরের নকলা উপজেলার চন্দ্রকোনা হয়ে শেরপুর জেলা শহর পর্যন্ত রেলপথ নির্মানের প্রকল্পটি দ্রুত বাস্তবায়নের। তাই অনেকের মনে প্রশ্ন জেগে উঠেছে আর কতদুর পিয়ারপুর।

রেল লাইনের দাবীতে ইতিমধ্যে জেলা সদর এবং জেলার অন্যান্য উপজেলাতেও মানববন্ধন, সভা-সমাবেশ এবং প্রধান মন্ত্রী বরাবর স্মরকলিপি প্রদান করা হচ্ছে। সর্বশেষ রেল লাইনের দাবীতে ৩১ জানুয়ারী বুধবার সকালে জেলা শহরের শহীদ মিনার চত্বরে জমায়েত হয়ে শতপদে পদযাত্রা বের করে শহরের প্রধার প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করা হয়। পরে এ পদযাত্রা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে গিয়ে শেষ হয়। নাগরিক কমিটি জনউদ্দ্যোগের আয়োজনে এ মনববন্ধন কর্মসূচীতে জেলার সর্বস্তরের মানুষ শতস্ফুর্ত অংশ গ্রহন করে। মানববন্ধন শেষে মাননীয় প্রধান মন্ত্রী বরাবর শেরপুরের জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে স্মারকলিপি প্রদান করা হয়। এর আগে গত প্রায় ২ বছর ধরে শ্রীবদর্দী, ঝিনাইগাতি এবং নালিতাবাড়ি উপজেলাতে নানা কর্মসূচী পালন করা হয় রেল লাইন স্থাপনের জন্য। তবে ক্রমেই এ দাবী জেলারবাসীর কাছে সামাজিক আন্দোলনের রূপ নিচ্ছে। ইতিমধ্যে জেলায় রেল লইনের দাবীতে ব্যাক্তি এবং বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের পক্ষে ফেইসবুক স্ট্যাটার্সে ভাইরাল হয়ে উঠেছে।

জানাগেছে, গারো পাহাড়ের পাদদেশে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের সীমান্ত ঘেঁষা ইতিহাস সমৃদ্ধ শেরপুর জেলা আয়তনে ছোট হলেও দেশের চাল উৎপাদনকারী কয়েকটি জেলার মধ্যে এটি অন্যতম। এখানে এক সময় ছিল এক হাজারেরও বেশী চাল কল বা চাতাল। বর্তমানে উন্নত ও আধূনিক প্রযুক্তির অটোমেটিক হলার মিলের সংখ্যা হয়েছে প্রায় ২০ থেকে ২৫ টি। যা এ পরিমানের হলার মিল দেশের অন্য কোন জেলায় নেই। চালের পাশাপাশি রয়েছে জেলায় উৎপাদিত বিভিন্ন মওসুমের নানা কৃষি পন্য। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই জেলার অর্থনৈতিক মূল চালিকা শক্তি হচ্ছে এ চাল ও কৃষি পণ্য উৎপাদন এবং তা দেশ-বিদেশে রপ্তানি করা হয়।

Advertisements

কিন্তু কেবলমাত্র সড়ক পথ ছাড়া জেলার সাথে রাজধানী ঢাকাসহ অন্যান্য জেলার সাথে অন্যকোন যোগাযোগ ব্যবস্থা স্বাধিনতার ৪৭ বছর পরও গড়ে উঠেনি। যদিও ৬০ দশক সময় পর্যন্ত জেলার মূল যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল নৌপথ। কিন্তু সে নৌপথ ৭০ দশকের আগেই পানি প্রবাহ কমে যাওয়ায় বন্ধ হয়ে যায়। ফলে বর্তমানে জেলায় উৎপাদিত চালসহ বিভিন্ন কৃষি পণ্য ও সব্জী, খনিজ বালু, পাথর, বাঁশ, কাঠ ও কাঠের তৈরী বিভিন্ন ফার্নিচার সামগ্রী এবং জেলার নালিতাবাড়ি উপজেলার নাকুগাঁও স্থল বন্দর হয়ে ভারত থেকে আমদানী করা কয়লাসহ ৭১ টি পন্যেরসহ নানা সামগ্রী পরিবহনের এক মাত্র পথ সড়ক পথ।

এছাড়া ব্যবসা ও নানা কাজে রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় যাতায়াতের জন্য যাত্রী সাধারণকেও একই সড়ক পথের উপরই নির্ভর করতে হয়। পণ্য পরিবহন ও যাত্রী সাধারণ শুধু জেলারই নয় ভৌগলিকগত কারণে জেলাসহ পাশ্ববর্তী জামালপুর ও কুড়িগ্রাম জেলার ৪ উপজেলার মানুষের যাতায়াত এবং পণ্য পরিহনে শেরপুরের এ পথের বিকল্প নেই। ফলে শেরপুর-ময়মনসিংহ-ঢাকা, শেরপুর-জামালপুর-টাঙ্গাইল-ঢাকা এবং শেরপুর-জামালপুর-টাঙ্গাইল-সিরাজগঞ্জ হয়ে দেশের উত্তরবঙ্গে চলাচলে শেরপুর, জামালপুর ও কুড়িগ্রাম এলাকার প্রায় ২০ লাখ মানুষকে নির্ভর করতে হয় একমাত্র সড়ক পথের উপর। কোন কারণে সড়ক পথে ধর্মধট, বন্যা বা অন্য কোন কারণে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে গেলে জেলার সাধারণ মানুষের ভোক্তির শেষ থাকে না। এছাড়া পণ্যবাহি ট্রাক বা অন্যান্য যানবাহনেও অনুরূপ বন্ধে ব্যপক ক্ষতির সন্মুখে পড়ে সাধালণ ব্যবসায়ী ও আমদানী-রপ্তানিকারকরা।

শেরপুর রেলপথ স্থাপনের ব্যাপারে ব্রিটিশ সরকার ১৯৩০ সালে প্রথম পরিকল্পনা গ্রহন করেছিলেন। ব্রিটিশ আমলে ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন প্রদেশের সাথে পণ্য পরিবহণ ও যাত্রী সাধারণের যাতায়াতের সুবিধার জন্য জামালপুর রেলওয়ে জংশন থেকে ব্রহ্ম্রপুত্র নদেও উপর দিয়ে শেরপুর সদর হয়ে সীমান্তবর্তী ঝিনাইগাতি উপজেলার রাংটিয়া পর্যন্ত রেলপথ স্থাপনের প্রথমিক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল। পরবর্তিতে ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্থান বিভক্তির পর রেলপথ স্থাপনের বিষয়টি চাপা পড়ে যায়। বাংলাদেশ স্বাধিন হওয়ার পর ১৯৭০ সালে ত]কালীন বাংলাদেশ রেলওয়ে পুনরাই জামালপুর-রাংটিয়া ভায়া শেরপুর রেলপথ স্থাপনের সম্ভাব্যতা যাচাই শুরু করে। কিন্তু সেই সম্ভাব্যতা যাচাই এর কাজ আর আলোর মুখ দেখেনি।
এরপর ২০১৪ সালের ৮ জুন তৎকালের রেল মন্ত্রী মুজিবুল হক জামালপুরের পিয়ারপুর রেল স্টেশনে আন্তঃনগর তিস্তা ট্রেনের আনুষ্ঠানিক যাত্রাবিরতির উদ্বোধন শেষে মহারাজা শশীকান্ত স্কুল এন্ড কলেজ মাঠে আয়োজিত এক জনসভায় পিয়ারপুর থেকে শেরপুরে রেলপথ স্থাপনের ঘোষণা দেন। সেদিনের মন্ত্রীর এ ঘোষনা শেরপুর জেলাবাসীর মনে স্বাধিনার ৪৭ বছর পর আশার আলো জেগে উঠে।

মন্ত্রীর ঘোষনায় বলা হয়, বাংলাদেশ রেলওয়ের জামালপুর জেলার পিয়ারপুর রেলষ্টেশন থেকে ব্রহ্মপুত্র নদের উপর দিয়ে শেরপুর জেলার নকলা উপজেলার চন্দ্রকোনা হয়ে জেলা শহর পর্যন্ত ২৩ কিলোমিটার রেল লাইনের প্রাথমিক সম্ভাব্যতায় ৫৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে এই নতুন রেল সড়ক নির্মান করা হবে বলে এক সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। কিন্তু এরপর অদৃশ্য ছায়ায় ঢেকে যায় পিয়ারপুর-শেরপুর রেল পথ নির্মান কাজ।
অথচ কয়েক দফায় দেশের জাতীয় নির্বাহী পরিষদ একনেক এর বৈঠকে নতুন রেল পথ নির্মান ও সম্প্রসারণ এবং রেলের নানা উন্নয়নে বেশ কয়েকটি প্রকল্প অনুমোদন দেয়া হলেও পিয়ারপুর-শেরপুর রেল পথের কোন আলোচনায় উঠেনি।

বর্তমানে শেরপুর থেকে ময়মনসিংহ হয়ে ঢাকাসহ দেশে বিভিন্ন জেলায় একমাত্র সড়ক যোগাযোগের মাধ্যমে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকার বিভিন্ন পণ্য ও মালামাল পরিবহন করা হচ্ছে। এছাড়া সড়ক পথে প্রতিদিন শতাধিক যাত্রীবাহী বাস চলাচল করলেও মাত্র ২০০ কিলোমিটার দুরত্বের রাজধানী ঢাকা যেতে সময় লাগছে প্রায় ৬ থেকে ৭ ঘন্টা। অথচ দুরত্ব অনুযায়ী শেরপুর-ঢাকা সময় লাগার কথা মাত্র ৩ ঘন্টা। এই দীর্ঘ সময়ের জন্য যাত্রী সাধারণকে যেমন ভোগান্তি পোহাতে হয় তেমনি পণ্য পরিবহনেও নানা সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। তবে শেরপুরে রেল লাইন স্থাপন হলে সাধারণ মানুষের যেমন ভোগান্তি কমবে তেমনি পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রের সহজ লভ্য ও ব্যায় ভার অনেকাংশে কমে যাবে বলে শেরপুরের বিভিন্ন স্তরের যাত্রী, ব্যবসায়ী এবং বিভিন্ন ব্যাবসায়ী নেতারা জানিয়েছেন।