:হাফেজ মিনহাজ উদ্দিন :
নিউ মার্কেটে এক চা’য়ের দোকানে বসে আমি, মহিউদ্দিন সোহেল ভাই, ইমরান হাসান রাবিব ভাই ‘চা’ খাচ্চিলাম। পাপ্পু ভাই এসে আমাদের কে সালাম দিলেন। সালাম অর্থ আপনার উপর শান্তি বর্ষিত হোক। কিন্তু পাপ্পু ভাই এমন আধুনিক স্টাইলে সালাম দিলেন যা শান্তির পরিবর্তে আমাদের উপর অশান্তি কামনা করে। ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী একেক ধর্মে একেক রকমের অভিবাদন প্রচলিত আছে। হিন্দু ধর্মালম্বীরা আদাব বা নমস্কার দিয়ে কথা শুরু করে। এটা তাদের ধর্মীয় রীতি। পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা হিসেবে ইসলাম আমাদেরকে এমন একটি অভিবাদন শিক্ষা দিয়েছে, সেটি যদি কোনো মুসলমান অপর মুসলমানের সাথে দেখা হলে প্রয়োগ করতে পারে, তাহলে অনেক ছওয়াব হাসিল হবে।
ইসলামী অভিবাদন হলো اسلام عليكم বলা। বাংলা উচ্চারণ হলো “আসসালামু ‘আলাইকুম”। এর অর্থ “আপনার উপর শান্তি বর্ষিত হোক।”
আমরা প্রতিদিন অনেককেই এভাবে সালাম দিতে শুনি যে, স্লামালাইকুম, সালামালাইকুম, আস্লামালাইকুম ,সেলামালাইকুম, আস্লামো আলাই, আসসামালাইকুম স্লামাইকুম স্যার ইত্যাদি। যা খুবই অন্যায় এবং গর্হিত কাজ। কেননা এতে আরবীর সঠিক উচচারণ হয়না এবং তা অর্থ পরিবর্তন হয়ে যায়।
আবার উত্তর দেয়ার সময়ও শোনা যায় ভুল শব্দের ব্যবহার। যেমন, অলাইকুম সালাম; অলাইকুম আস-সালাম অলাইকুম ইত্যাদি।
সালামের সঠিক উচ্চারণ হলো
السَّلَامُ عَلَيْكُمْ وَرَحْمَةُ اللهِ وَبَرَكَاتُهُ আস-সালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহি, ওয়া বার-কাতুহ্।
وَعَلَيْكُمُ السَّلَامُ وَرَحْمَةُ اللهِ وَبَرَكَاتُهُ‘ ওয়া আলাইকুমুস-সালাম, ওয়া রহমাতুল্লাহি, ওয়া বার-কাতুহ্।
(আরবী উচ্চারণ একটু কঠিন তাই জানা কারো কাছ থেকে শিখে নিলে ভালো হয়)
আমরা অনেক সময়ই সালামের পূর্ণ জবাব দিতে কার্পণ্য করে থাকি। পুরো উত্তর বলি না, অথবা ভুল উত্তর দেই। অথচ আল্লাহ তাআলা কুরআনেই শিখিয়েছেন; কেউ সালাম দিলে তার চেয়ে উত্তম শব্দে উত্তর দিতে।
*আর যখন তোমাদেরকে সালাম দেয়া হবে তখন তোমরা তার চেয়ে উত্তম সালাম দেবে। অথবা জবাবে তাই দেবে। নিশ্চয় আল্লাহ সব বিষয়ে পূর্ণ হিসাবকারী।* -(আন-নিসা; ৪:৮৬)
সহীহ হাদীছে এসেছে,
ইমরান ইবনু হুসাইন (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, *একদিন একব্যক্তি নাবী সা: এর কাছে এসে বললেন, আসসলামু আলাইকুম। নবী সাঃ তার সালামের জবাব দিলে সে ব্যক্তি বসে পড়ে। তখন নাবী সা: বলেন, সে দশটি নেকী পেয়েছে। এর পর একব্যক্তি এসে বলে, আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ। তিনি তার সালামের জবাব দিলে, সে ব্যক্তি বসে পড়ে। তখন নাবী সা: বলেন, সে বিশটি নেকী পেয়েছে। এপর এক ব্যক্তি এসে বলে আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাক‘আতুহু। নাবী সা: তার সালামের জবাব দিলে সে বসে পড়ে। তখন তিনি বলেন, সে ত্রিশটি নেকী পেয়েছে*।
-(আবূ দাঊদ-৫১৯৫)
সালাম হলো ঈমানের অঙ্গ এবং জান্নাতে প্রবেশের একটি রাস্তা।
আবু হুরায়রা (রাঃ) বর্ণনা করেন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, “সেই সত্ত্বার কসম যার হাতে আমার প্রাণ! তোমরা ঈমান না আনা পর্যন্ত জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। আর তোমরা ততক্ষণ (পূর্ণাঙ্গ) ঈমানদার হতে পারবে না যতক্ষণ না একে অপরকে ভালোবাসো। আমি কি তোমাদের এমন কিছু বলে দেবো যা করলে তোমরা একে অপরকে ভালোবাসবে? নিজেদের মাঝে সালামের প্রসার ঘটাও।” (সাহীহ মুসলিম, ১ম খণ্ড)
সালাম হলো মুসলিমদের মাঝে ভালোবাসা ছড়িয়ে দেওয়ার মূল। সালাম প্রদানের দায়িত্ব অর্পণ করে আমাদের সম্মানিত করা হয়েছে। তাই আমাদের উচিত এই দায়িত্বের হক আদায় করা ও এর পবিত্রতা রক্ষা করা। ইসলামী এই অভিবাদনের নিয়ম-কানুন আমাদের জানা থাকা উচিত।
নিচে কিছু সালাম আদান-প্রদানের নিয়ম আলোচিত হলো:
১। উত্তম অথবা একইরকম জবাব দেওয়া
আল্লাহ আমাদের আদেশ করেছেন অভিবাদনের জবাব যেন তার চেয়ে সুন্দরভাবে অথবা সমান পরিমাণে দেই। তিনি বলেন,
“যখন তোমাদেরকে অভিবাদন করা হয়, তোমরাও অভিবাদন জানাও তারচেয়ে উত্তমভাবে অথবা তারই মতো করে ফিরিয়ে দাও।” [সূরা নিসা (৪):৮৬]
বেশিরভাগ আলেমগণের মতে “আসসালামু ‘আলাইকুম” এর জবাবে বলা উচিত “ওয়া’আলাইকুমুসসালাম ওয়া রহমাতুল্লাহ”। “আসসালামু ‘আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহ”র জবাবে বলতে হবে “ওয়া’আলাইকুমুসসালাম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু”। “আসসালামু ‘আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু”র জবাবে এর চেয়ে উচ্চস্বরে ও আনন্দিত স্বরে বলতে হবে “ওয়া’আলাইকুমুসসালাম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু”।
নিম্নের হাদীস থেকে বোঝা যায় সালামের সাওয়াব বৃদ্ধি পায়।
ইমরান বিন হুসাইন বর্ণনা করেন, “এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহর (সাঃ) কাছে এসে বললো আসসালামু ‘আলাইকুম। তিনি (সাঃ) বললেন, ‘দশ।’ আরেক ব্যক্তি এসে বললো আসসালামু ‘আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহ। তিনি (সাঃ) বললেন, ‘বিশ।’ আরেক ব্যক্তি এসে বললো আসসালামু ‘আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু। তিনি বললেন, ‘ত্রিশ।’” (জামে তিরমিযী)
২। সঠিক উচ্চারণ
বিশেষ করে অনারবদের উচিত এই বিষয়টা খেয়াল রাখা। “আলাইকুম” এর প্রথম অক্ষরটি হলো ع। সালাম বলা ও লেখার ক্ষেত্রে আমাদের উচিত উচ্চারণ ও বানানের প্রতি খেয়াল রাখা। “স্লামালেকুম”, “আস্লামালেকুম” সহ যতরকম ভুলভাল উচ্চারণ প্রচলিত আছে, তা সজ্ঞানে বর্জন করা উচিত।
৩। তোতাপাখির মতো না আউড়ে অনুভব করে বলা
আরব-অনারব নির্বিশেষে সকল মুসলিমই আরবিতে সালাম দেয়। সালাম একটি দু’আ। আমরা যাকে সালাম দিচ্ছি, তার জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে শান্তি বর্ষণের জন্য দু’আ করছি। কিন্তু সালামের অর্থ না বুঝে সালাম দেওয়ার কারণে এর মধ্যকার আবেগটা হারিয়ে যায়। অনেকেই এটাকে হাই-হ্যালোর একটি বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করে। সালাম তার আবেদন হারিয়ে এভাবেই কালচারের অংশ হয়ে গেছে।
“আসসালামু ‘আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু”র অর্থ “আপনার উপর শান্তি, আল্লাহর রহমত ও বরকত বর্ষিত হোক।” পরেরবার থেকে যখন কাউকে সালাম দেবেন, এর অর্থ অন্তরে অনুভব করে দেবেন।
৪। পরিচিত ও অপরিচিত সকল মুসলিমকে সালাম দেওয়া
সালাম আমাদের দ্বীনের শ্রেষ্ঠ জিনিসগুলোর একটি। আব্দুল্লাহ ইবনে উমার (রাঃ) বর্ণনা করেন, “রাসুলকে (সাঃ) এক লোক জিজ্ঞাসা করলো, ‘ইসলামের কোন কাজটি সর্বশ্রেষ্ঠ?’ তিনি (সাঃ) বললেন, ‘মানুষকে আহার করানো এবং পরিচিত ও অপরিচিত সকলকে সালাম দেওয়া।’” (সাহীহ বুখারি)
৫। সালাম দেওয়ার সময় মুসাফাহা করা
বারা ইবনে আযিব (রাঃ) থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, “দুজন মুসলিম সাক্ষাৎ করে মুসাফাহা করলে তারা পৃথক হওয়ার আগেই তাদের গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়।” (সুনান ইবনে মাজাহ)
উপরের হাদীস থেকে দলীল দিয়ে আলেমগণ বলেন সালাম দেওয়ার সাথে সাথে (সমলিঙ্গের) মুসলিমের সাথে হাত মেলানো একটি গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাহ।
৬। অতিরিক্ত কিছু আদব:
আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, “বাহনে আরোহী ব্যক্তি আগে পদচারী ব্যক্তিকে সালাম দেবে, হাঁটা ব্যক্তি বসা ব্যক্তিকে আগে সালাম দেবে, ছোট দল আগে বড় দলকে সালাম দেবে।” (সাহীহ বুখারি)
সর্বোপরি অপর মুসলিম ভাইকে সালাম দেওয়া আমাদের দায়িত্ব আর সালামের জবাব দেওয়া আমাদের উপর তাদের অধিকার।
আবু হুরায়রা (রাঃ) বর্ণনা করেন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “এক মুসলিমের প্রতি অপর মুসলিমের পাঁচটি অধিকার রয়েছে। সালামের জবাব দেওয়া, অসুস্থকে দেখতে যাওয়া, জানাযার সাথে শরিক হওয়া, দাওয়াত কবুল করা ও হাঁচি দিলে আলহামদুলিল্লাহ বলা।” (রিয়াদ্বুস সলিহীন, ৭ম খণ্ড)
সারকথা হলো, সালাম এমন একটি আমল যা সমাজে প্রচলন থাকলে একে অপরের সাথে ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় থাকে।
আল্লাহপাক আমাদের সবাইকে সঠিক বুঝ দান করুন। আমিন
লেখক: হাফেজ মিনহাজ উদ্দিন, শিক্ষক, জামিয়া সিদ্দীকিয়া তেরাবাজার মাদ্রাসা,শেরপুর ।