রবিবার , ১৯শে মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ || ৫ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ - গ্রীষ্মকাল || ১০ই জিলকদ, ১৪৪৫ হিজরি

আর্ন এন্ড লিভ’র খাদ্যসামগ্রী উপহার পেল সেই চিনি বিবি

প্রকাশিত হয়েছে -

গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের পর চিনি বিবির দুর্বিষহ জীবনে নেমে এসেছে স্বস্তির হাওয়া। অসহায় এ নারীর বাড়িতে খাদ্যসামগ্রী পৌঁছে দিয়েছে ‘আর্ন এন্ড লিভ’ নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন।

এর আগে স্বামী-সন্তান হারা চিনি বিবিকে নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে ‘স্বামী সন্তানহারা চিনি বিবির মানবেতর জীবন’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশ করা হয়। এতে জানানো হয় যে স্বামী-সন্তান কেউই নেই তার। জীবনের পড়ন্ত বেলায় এখন তার ভরসা মহান সৃষ্টিকর্তা। কোথায় থাকবেন, সেই ঠিকানা আজও নিশ্চিত হয়নি চিনি বিবির। সৎ বোনের পরিত্যক্ত একটি ভাঙা ঘরে আশ্রয় নিলেও দুর্বিষহ মানবেতর জীবন যাপন করেছেন এ বৃদ্ধা।

দীর্ঘ দিন ধরে ভাঙা পা নিয়েই বসে বসে সামান্য চলাচল করলেও কাজ-কর্ম করতে পারেন না। বাইরে বের হতে পারলেও শরীর চলে না। নিজের ছেলে-মেয়ে, বাবা-মা না থাকায় ছেষট্টি বছর বয়সী এ গৃহহীন বৃদ্ধার একেকটি দিন যেন চরম দুঃখ-কষ্টে ভরা। তার ভাগ্যে মেলেনি কোনো সরকারি সুবিধা। কখনও খেয়ে বা না খেয়ে এ নারীর জীবন কাটছে।

সংবাদটি নজরে আসে আর্ন এন্ড লিভ এর প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ফরিদা ইয়াসমিন জেসির। এরপর তিনি সংগঠনের সদস্যদের মাধ্যমে খোঁ জ খবর নিন চিনি বিবির। পরে রমজান মাসের জন্য চাল, তেল, মুড়ি, আলু, পেয়াজসহ বিভিন্ন খাবার সামগ্রী বাড়িতে পৌঁছে দেন।

Advertisements

এসব উপহার পেয়ে খুশি হয়ে চিনি বিবি বলেন, খেয়ে না খেয়ে রোজা রাখছিলাম। আল্লাহ তুমাগোর (আর্ন এন্ড লিভ’র ভলান্টিয়ার) মাধ্যমে খাবার জোগাড় করে দিয়েছে। আল্লাহর কাছে তোমগোর জন্য দুয়া করি। এ বলেই কান্নায় ভেঙে পড়েন এ বৃদ্ধা।

সংগঠনটির পরিচালক ফরিদা ইয়াসমিন জেসি জানান, আমরা চিনি বিবির পাশে থেকে যতটুকু পারি সহযোগিতা করবো, ইনশাআল্লাহ। পাশাপাশি বিত্তবানরা এগিয়ে এলে চিনি বিবিদের এভাবে আর কষ্টে থাকতে হয় না। তাই সবাই সবার মতো করে আশেপাশের দুঃস্থদের সহযোগিতা করুন।

প্রসঙ্গত, এখনও কোনো সরকারি সুবিধা এ বৃদ্ধা নারীর ভাগ্যে জোটেনি। কান্না করে ভাঙা কণ্ঠে তিনি আরও বলেন, ‘বাবারে দুনিয়ায় আমার কেউ নাই (নেই)। মা, বাপ, ভাই সবাই মারা গেছেন। পাডাও (পা) ভাইঙা গেছে। এখন এ পাও ভাঁজ হয় না। পা, কোমড়ের বেদনায় (ব্যাথা) জীবনডা বাইর (বের) হয়ে যাইগা। আর কপালে ভাতই জোটে না, আবার (ডক্তার) ডাক্তারের কাছে কেডায় (কে) নিয়ে যাইবো। খাবার না জোটলে অমনিই রোজা রাখি। ঘর নাই, বিছন্যা (বিছানা) নাই, কিচ্ছুই নাই আমার। বাবারে, মেম্বার-চেয়ারম্যান কেউ খোঁজ নেয় না। আমি মইরা গেলেই এই কষ্ট থেকে বাঁচি।’

ওই নারীর সঙ্গে কথা হয় স্থানীয় প্রতিবেদকের। ওই সময় চিনি বিবি জানান, তার বাড়ি শেরপুর সদর উপজেলার চরশেরপুর ইউনিয়নের যোগিনীমুড়া নামা পাড়া গ্রামে। তিনি সেখানকার মৃত বয়জ উদ্দিনের মেয়ে। ৩৫ বছর আগে বিয়ে হয় ঝিনাইগাতী উপজেলার বাকাকুড়া গ্রামে। সংসারে আসে পরপর দু’সন্তান। কিন্তু পরে তারা মারা যান। এ কারণে চিনি বিবির স্বামী তাকে তালাক দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেন।

এরপর ৩০ বছর ধরে নিজ গ্রাম লামাপাড়াতেই অন্যের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে দিন কাটাচ্ছিলেন স্বামী পরিত্যক্তা এ নারী। কিন্তু হঠাৎ বছর দুয়েক আগে পড়ে গিয়ে একটি পা ভেঙে যায় আর কোমরে প্রচুর আঘাত পান তিনি। তখন থেকেই আর উঠে দাঁড়াতে পারেন না। সহোদর ভাই মিয়ার উদ্দিন আট বছর আগে মারা যান। তখন থেকেই তার খোঁজ নেয় না কোনো স্বজন। মিয়ার উদ্দিনের দু’ছেলে আ. জলিল আর আ. খলিল দিনমজুরের কাজ করেন। নিদারুণ কষ্টে থাকা এই বৃদ্ধার সঙ্গী বলতে কেউ নেই এখন।

স্থানীয় বাসিন্দা রিকশাচালক খলিল মিয়া বলেন, পা ভাঙার পর হতে ছেচুর পেড়ে (বসে বসে) ঘরের বাইরে বের হয় চিনি বিবি। সৎ বোনের একটি ভাঙা ঘরে থাকলেও মাঝেমধ্যে বকা-ঝকা করেন তারা। এক সময় মানুষের বাড়িতে কাজকর্ম করলেও এখন সে নিজেই চলতে পারে না। তার কোনো আত্মীয়ও খোঁজ-খবর নেয় না। তবে চিনি বিবি কারও কাছে হাত পাতে না, কেউ ইচ্ছে করে দিলে খাওয়া জোটে – তা না হলে উপোস থাকেন। এই রোজার মাসেও তিনি না খেয়ে রোজা রাখছেন। আমি নিজেই রিকশা চালাই, তবুও তার জন্য ওষুধ কিনে দেই। গ্রামের ধনী মানুষেরা আরেক ধনী মানুষের খোঁজ নেয়, গরীবের না।

কিন্তু এবার মানবাধিকার সংস্থা সৃষ্টি হিউম্যান রাইটস সোসাইটির হুইল চেয়ার পেয়ে চিনি বিবি বলেছেন, ‘বাবারে দুনিয়ায় আমার কেউ নাই। মা, বাপ, ভাই সবাই মারা গেছেন। পাডাও (পা) ভাইঙা গেছে। এখন এ পাও ভাঁজ হয় না। পা, কোমরের বেদনায় (ব্যাথা) জীবনডা বাইর (বের) হয়ে যাইগা। এহন (এখন) অন্তত চেয়ারে কইরা চলাফেরা করা যাইবো। আমি রোজা রেখে সবার জন্য দোয়া করবো।’

অপরদিকে চিনি বিবির সরকারি সুবিধা প্রাপ্তির বিষয়ে সদর ইউএনও মিজাবে রহমত বলেন, ‘দ্রুত চিনি বিবির খোঁজ-খবর নিয়ে তাকে সহায়তা করা হবে।’