রবিবার , ১২ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ || ২৯শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ - গ্রীষ্মকাল || ৩রা জিলকদ, ১৪৪৫ হিজরি

দুর্বিষহ মানবেতর জীবন যাপন করেছেন চিনি বিবি

প্রকাশিত হয়েছে -

 


স্বামী-সন্তান কেউই নেই চিনি বিবির। জীবনের পড়ন্ত বেলায় এখন তার ভরসা মহান সৃষ্টিকর্তা। কোথায় থাকবেন, সেই ঠিকানা আজও নিশ্চিত হয়নি চিনি বিবির। সৎ বোনের পরিত্যক্ত একটি ভাঙা ঘরে আশ্রয় নিলেও দুর্বিষহ মানবেতর জীবন যাপন করেছেন এ বৃদ্ধা।

দীর্ঘ দিন ধরে ভাঙা পা নিয়েই বসে বসে সামান্য চলাচল করলেও কাজকর্ম করতে পারেন না। বাইরে বের হতে পারলেও শরীর চলে না। নিজের ছেলে-মেয়ে, বাবা-মা না থাকায় ছেষট্টি বছর বয়সী এ গৃহহীন বৃদ্ধার একেকটি দিন যেন চরম দুঃখ-কষ্টে ভরা। তার ভাগ্যে মেলেনি কোনো সরকারি সুবিধা। কখনও খেয়ে বা না খেয়ে এ নারীর জীবন কাটছে।

সম্প্রতি শেরপুর সদর উপজেলার চরশেরপুর ইউনিয়নের যোগিনীমুড়া নামা পাড়া গ্রামে দেখা হয় চিনি বিবির সঙ্গে। তিনি সেখানকার মৃত বয়জ উদ্দিনের মেয়ে। ৩৫ বছর আগে বিয়ে হয় ঝিনাইগাতী উপজেলার বাকাকুড়া গ্রামে। সংসারে আসে পরপর দু’সন্তান। কিন্তু পরে তারা মারা যান। এ কারণে চিনি বিবির স্বামী তাকে তালাক দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেন।

Advertisements

এরপর ৩০ বছর ধরে নিজ গ্রাম লামাপাড়াতেই অন্যের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে দিন কাটাচ্ছিলেন স্বামী পরিত্যক্তা এ নারী। কিন্তু হঠাৎ বছর দুয়েক আগে পড়ে গিয়ে একটি পা ভেঙে যায় আর কোমরে প্রচুর আঘাত পান তিনি। তখন থেকেই আর উঠে দাঁড়াতে পারেন না। সহোদর ভাই মিয়ার উদ্দিন আট বছর আগে মারা যান। তখন থেকেই তার খোঁজ নেয় না কোনো স্বজন। মিয়ার উদ্দিনের দু’ছেলে আ. জলিল আর আ. খলিল দিনমজুরের কাজ করেন। নিদারুণ কষ্টে থাকা এই বৃদ্ধার সঙ্গী বলতে কেউ নেই এখন।

স্থানীয় বাসিন্দা রিকশাচালক খলিল মিয়া বলেন, পা ভাঙার পর হতে ছেচুর পেড়ে (বসে বসে) ঘরের বাইরে বের হয় চিনি বিবি। সৎ বোনের একটি ভাঙা ঘরে থাকলেও মাঝেমধ্যে বকা-ঝকা করেন তারা। এক সময় মানুষের বাড়িতে কাজকর্ম করলেও এখন সে নিজেই চলতে পারে না। তার কোনো আত্মীয়ও খোঁজ-খবর নেয় না। তবে চিনি বিবি কারও কাছে হাত পাতে না, কেউ ইচ্ছে করে দিলে খাওয়া জোটে – তা না হলে উপোস থাকেন। এই রোজার মাসেও তিনি না খেয়ে রোজা রাখছেন। আমি নিজেই রিকশা চালাই, তবুও তার জন্য ওষুধ কিনে দেই। গ্রামের ধনী মানুষেরা আরেক ধনী মানুষের খোঁজ নেয়, গরীবের না।

কান্না করে ভাঙা কণ্ঠে তিনি আরও বলেন, ‘বাবারে দুনিয়ায় আমার কেউ নাই (নেই)। মা, বাপ, ভাই সবাই মারা গেছেন। পাডাও (পা) ভাইঙা গেছে। এখন এ পাও ভাঁজ হয় না। পা, কোমড়ের বেদনায় (ব্যাথা) জীবনডা বাইর (বের) হয়ে যাইগা। আর কপালে ভাতই জোটে না, আবার (ডক্তার) ডাক্তারের কাছে কেডায় (কে) নিয়ে যাইবো। খাবার না জোটলে অমনিই রোজা রাখি। ঘর নাই, বিছন্যা (বিছানা) নাই, কিচ্ছুই নাই আমার। বাবারে, মেম্বার-চেয়ারম্যান কেউ খোঁজ নেয় না। আমি মইরা গেলেই এই কষ্ট থেকে বাঁচি।’

স্থানীয় বাসিন্দা ভুট্টো মিয়া জানান, ৩০ বছর ধরে চিনি বিবি এ এলাকায় আছেন। তার ছেলে, মেয়ে, মা, বাবা, ভাই সবাই মারা গেছেন। সৎ বোনের একটি ভাঙা ঘরে আশ্রয় নিলেও অসুস্থ চিনি বিবির খাবার জোটে না। মাঝে-মধ্যে কেউ খাবার দিলে তবেই খেতে পান। আমি রিকশা চালাই, তবুও মাঝেমধ্যে সাহায্য করার চেষ্টা করি। চিনি বিবির পায়ের চিকিৎসা, একটি হুইল চেয়ার আর ভাতের ব্যবস্থা করা দরকার।

স্থানীয় যুবক সুমন বলেন, চিনি বিবিকে দেখলে চোখে পানি এসে যায়। এ মুহূর্তে তার ভাঙা পায়ের চিকিৎসা, হুইল চেয়ার, খাবারের ব্যবস্থা এবং মাথা গোঁজার একটা ঘরের প্রয়োজন।

সাবেক ইউপি সদস্য নাঈম আহম্মেদ মনি বলেন, আমার সময়ে (ইউপি সদস্য থাকাকালীন) আমি নিয়মিত খোঁজ নিয়েছি। যতটুকু পেরেছি ব্যক্তিগতভাবে সহযোগিতা করেছি। দুনিয়ায় আপন বলতে তার এখন কেউ নেই। দুই ভাতিজা আছে, তাদেরই নুন আনতে পানতা ফুরায়। তবে চিনি বিবিকে বিধবা বা বয়স্ক ভাতার আওতায় এনে একটি সরকারি ঘরের ব্যবস্থা করে দিলে তার বাকি জীবনটা অন্তত সুখে কাটবে।

মানবাধিকার সংস্থা সৃষ্টি হিউম্যান রাইটস সোসাইটির শেরপুর জেলা সভাপতি আলমগীর আল আমিন হারুন বলেন, আমি ব্যক্তিগতভাবে বিভিন্ন রিকশাওয়ালাদের কাছে তার জন্য ওষুধ পাঠিয়ে দিই। এ রমজানে তার কাছে গিয়েছিলাম খোঁজ নিতে, তার কষ্ট দেখে কেউ চোখে পানি আটকাতে পারবে না। দীর্ঘ দিন ধরে তার পা ভাঙা থাকায় আর সেটি বাঁকানো যায় না। তাই সে বসে বসে ঘর থেকে বের হয়। তার সৎ বোনের পরিত্যক্ত ঘরে থাকছে, কিন্তু তারাও কয়েকবার সেখান থেকে বের করে দিয়েছিল। স্থানীয় কয়েকজন বলে বুঝিয়ে আবার সেখানে তুলে দিয়েছে। তার বাবার রেখে যাওয়া সামান্য ভিটাটারও কোনো হদিস নেই। ছেলে, মেয়ে, মা, বাবা, ভাই কেউ বেঁচে নেই, দুই ভাতিজাও (দিনমজুরের কাজ করে) দেখাশুনা করে না। আমাকে চিনি বিবি জানিয়েছে, সরকারি কোনো সহায়তা জোটেনি তার। খেয়ে, না খেয়ে দিন কাটে তার। চরম দুর্দশাগ্রস্ত এ বৃদ্ধার জন্য সরকার বা সমাজের বিত্তবানদের সহায়তা জরুরি।

সদর ইউএনও মিজাবে রহমত বলেন, দ্রুত চিনি বিবির খোঁজ-খবর নিয়ে তাকে সহায়তা করা হবে।