রবিবার , ১২ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ || ২৯শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ - গ্রীষ্মকাল || ৩রা জিলকদ, ১৪৪৫ হিজরি

সাংবাদিক নাদিম হত্যাকাণ্ডের ৩ মাস

প্রকাশিত হয়েছে -


বাংলানিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম ও একাত্তর টিভির সাংবাদিক গোলাম রব্বানী নাদিম হত্যা মামলার ৩ মাস পেরিয়ে গেছে। তবে নেই মামলার তেমন কোনো অগ্রগতি। আর এরই মধ্যে উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়ে এসেছেন এজাহারভুক্ত কয়েক আসামি। জামিন পেয়েই তারা নিহত নাদিমের স্বজনদের বিভিন্নভাবে হুমকি দিচ্ছেন বলে জানান নাদিমের পরিবার। এতে আতঙ্কে দিন পার করছে নিহত নাদিমের পরিবার ও স্বজনরা।

যা ঘটেছিল সেদিন :
চলতি বছরের ১৪ জুন রাতে কাজ শেষে বাড়ি ফেরার পথে বকশিগঞ্জের পাটহাটি এলাকায় সন্ত্রাসী হামলার শিকার হন সাংবাদিক গোলাম রব্বানী নাদিম। ১৫ জুন ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যু হলে ১৬ জুন দুই দফা জানাযার পর বকশিগঞ্জের গুমেরচর পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয় তাকে।


মামলার হালচাল:
সাংবাদিক নাদিম নিহতের ঘটনায় ১৭ জুন বকশিগঞ্জ থানায় মাহমুদুল আলম বাবুসহ ২২ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাত আরও ২০ থেকে ২৫ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করেন তাঁর স্ত্রী মনিরা বেগম। এই মামলায় প্রধান আসামি বাবু উচ্চ আদালত থেকে জামিন পেলেও পরে ২০ নভেম্বর পর্যন্ত জামিন স্থগিত করা হয়। এ পর্যন্ত কারাগারে রয়েছে প্রধান আসামি বাবুসহ ১৭ জন। কারাগার থেকে জামিনে মুক্ত হয়েছেন ২ জন। উচ্চ আদালত থেকে অন্তর্বর্তীকালীন জামিন নিয়েছেন এজাহারভুক্ত ৭ আসামি এবং এখনো পলাতক রয়েছে বাবুর ছেলে রিফাতসহ ৫ আসামি। বকশিগঞ্জ থানা-পুলিশ থেকে জেলা গোয়েন্দা পুলিশের পর এখন মামলাটির তদন্ত করছে সিআইডি।

Advertisements

যা বলছে নাদিমের বাবা:
বকশীগঞ্জ থানার অদূরেই নাদিমের গ্রামের বাড়ি। একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে পাগলপ্রায় নাদিমের মা। এদিকে বাবা আব্দুল করিমের অবস্থা একই। বাড়ির উঠানে ছেলেকে চির নিদ্রায় শায়িত করে রেখেছেন। বাড়ি হতে কোথাও বের হলেই ছেলের কবর জিয়ারত করে বের হন বাবা। প্রতিদিনের বাংলাদেশকে তিনি বলেন, আমার ছেলেকে বাবু ও তার ছেলের নেতৃত্বে খুন করা হলো। কিন্তু যারা এ কিলিং মিশনে অংশ নিলো, তারা একে একে জামিনে আসতেছে। এটা আমাদের জন্য ভয়ের কারণ। তাছাড়া ইতোমধ্যে আসামিরা কয়েকজন বিভিন্নভাবে আমাদের হুমকিও দিচ্ছে। যেহেতু ঘটনা ঘটার পর হতে আজ পর্যন্ত পুলিশ কোন এজাহার ভুক্ত আসামিকে গ্রেফতার করতে পারেনি,তাহলে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠায় স্বাভাবিক। মরার আগে হলেও আমার বিচার যেন দেখে যেতে পারি।’

যা বলছে নাদিমের মা…..
নিহত সাংবাদিক নাদিমের মা আলেয়া বেগম বলেন, ‘বাবারে, আগে যারা পালিয়ে বাহিরে ছিল তারাও এখন হাইকোর্ট থেকে জামিন নিয়ে আইসে। জামিনে আইসাই এখন বুক ফুলায়ে লোক সমাজে ঘুরতাছে আর আমাদের হুমকি দিচ্ছে। যেভাবেই হোক তারা আমাদের হেস্তনেস্ত করবো। প্রাণের হুমকি দিতাছে। এখন আমরা কোথায় যাই? কোনো খানে আমরা বিচার পাইতাছি না। পুলিশও বাকি আসামি ধরতে পারেনাই, খুনিরা বাইরে ঘুরলে আমরা ত নিরাপত্তাহীনতায় থাকবো; এটাই স্বাভাবিক। তাই বাপু, খুব চিন্তায় আছি।’

যা বলছে নাদিমের ছেলে:
নিহত সাংবাদিক নাদিমের বড় ছেলে আব্দুল্লাহ আল মামুন রিফাত। বলেন, ‘এই ঘটনার ৩ মাস হয়ে গেল। আমরা খুব কঠিন সময় পার করছি। যত দিন যাচ্ছে আমাদের অবস্থা তত খারাপ হয়ে যাচ্ছে। আমাদের প্রতি মুহূর্তে বাবার কথা মনে পড়ে। কিন্তু আমরা কিছু করতে পারছি না এবং অনেক আসামি ইতিমধ্যে জামিনে এসেছে। আমরা ভয়ে আছি, আতঙ্কে আছি।

যা বলছে নাদিমের স্ত্রী….
নিহত সাংবাদিক নাদিমের স্ত্রী ও মামলার বাদী মনিরা বেগম প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘মামলা দ্রুত বিচার ট্রাইবুন্যালে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত মামলার চার্জশিটের কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। যতই দিন যাচ্ছে মামলার গতি হারিয়ে ফেলছি। পুলিশের প্রতি আমাদের আর কোনো আস্থা নেই। এখন মামলার এমন অবস্থা যে, উল্টো এজাহারভুক্ত পলাতক আসামিরা উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়ে আসছে। আর তারা জামিনে আসায় প্রাণভয়ে আমরা আছি।’

নাদিমের আইনজীবী যা বলছে…
বাদীপক্ষের আইনজীবী আ্যাডভোকেট ইউসূফ আলী বলেন, ‘মোকদ্দমার তদন্তকারী কর্মকর্তা আমাকে জানান- বাবু চেয়ারম্যান ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন এবং নিজের দোষ স্বীকার করে সব বলেছেন। কিন্তু পরবর্তীতে আমরা এই জবানবন্দী পর্যালোচনা করে দেখেছি এবং নিশ্চিত হয়েছি। বাবু চেয়ারম্যান নিজেকে জড়িয়ে একটি শব্দও বলে নাই। এটি মূলত ১৬৪ ধারা জবানবন্দি হয় না। আইনের দৃষ্টিতে বলা যায় না। আইও সাহেবের উচিত ছিল পুনরায় রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা এবং এই জবানবন্দি নেওয়ার চেষ্টা করা। কিন্তু তিনি তা করেন নাই। তিনি নির্ভেজাল একটি মিথ্যা কথা আমাদের বলেছেন’।

যা বলছে সাংবাদিক নেতারা……
জামালপুর অনলাইন জার্নালিস্ট নেটওয়ার্কের সভাপতি জাহাঙ্গীর সেলিম বলেন, ‘১৬৪ ধারার জবানবন্দি নিয়ে যে মিথ্যাচারটা সেটি আমাদের নানা শঙ্কা এবং সন্দেহের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। যে দপ্তরের কাছেই তদন্তভার থাক, আমরা অনতিবিলম্বে চার্জশিট দিয়ে প্রকৃত দোষীদের গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। এছাড়াও জামিনে বের হওয়ার পথ ক্রমশই সুগম হচ্ছে মূল আসামি বাবুর’।

যা বলছে মানবাধিকার কর্মীরা…
মানবাধিকার সংস্থা সৃষ্টি হিউম্যান রাইটস সোসাইটির চেয়ারম্যান আনোয়ার -ই-তাসলিমা প্রথা প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘এটি একটি চাঞ্চল্যকর ঘটনা। একজন সাংবাদিককে হত্যার মাধ্যমে স্বাধীন সাংবাদিকতাকে হুমকি দেওয়ার শামিল। সামান্য একজন মুদি দোকানি থেকে রাজনৈতিক আশ্রয় ও পুলিশের একজন উপরস্থ কর্মকর্তার আর্শিবাদপৃষ্ট হয়ে সে আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে গেছে। সেই মাহমুদুল হক বাবু ও তার সেইসব পৃষ্ঠপোষক এবং কিলিং মিশবে জড়িতদের দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তি চাই। পাশাপাশি বাবুর আশ্রয় দাতা ও কিলিং মিশনের মাস্টার মাইন্ড যারা তাদেরকেও খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনা হউক। তার পরিবারের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা রাষ্ট্র নিশ্চিত করবে; এটা রাষ্ট্রের দায়িত্ব।’

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যা বলছে…..
এসব বিষয়ে সিআইডির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার স্বাগত ভট্টাচার্য মোবাইল ফোনে বলেন, ‘আমরা সবেমাত্র এই মামলার তদন্ত হাতে নিয়েছি। আমরা প্রতিটি বিষয় ক্ষতিয়ে দেখছি। আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশ অনুযায়ী তদন্ত করে যাচ্ছি। তাই এখন তদন্তের স্বার্থে কিছু বলা যাচ্ছে না’।