শনিবার , ১৮ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ || ৪ঠা জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ - গ্রীষ্মকাল || ৯ই জিলকদ, ১৪৪৫ হিজরি

সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণ

প্রকাশিত হয়েছে -

:সৈয়দ ফারুক হোসেন:

সরকারের দিনবদলের সনদের মূল বিষয় ছিল ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত উন্নত বাংলাদেশ গড়ে তোলা- যার ভিত্তি হবে ডিজিটাল বাংলাদেশ। ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে এখন দেশ স্মার্ট বাংলাদেশের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ওই লক্ষ্য সামনে রেখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান সরকার বাংলাদেশে ব্যাপক উন্নয়ন সাধন করেছে। প্রধানমন্ত্রীর অঙ্গীকার অনুযায়ী সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালু করা হলো। দেশের চার শ্রেণির প্রায় ১০ কোটি মানুষের কথা বিবেচনায় রেখে চালু করা হয়েছে সর্বজনীন পেনশন স্কিম। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল সবার জন্য পেনশন স্কিম চালু করা। ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের বয়স্ক জনগোষ্ঠীকে একটি টেকসই ও সুসংগঠিত সামাজিক নিরাপত্তা কাঠামোর আওতায় এনে বৃদ্ধকালীন সুরক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে জাতীয়ভাবে সর্বজনীন পেনশনব্যবস্থা প্রবর্তনের অঙ্গীকার করেছিলেন। বিশাল জনগোষ্ঠীকে একটি টেকসই ও সুসংগঠিত সামাজিক নিরাপত্তা কাঠামোর আওতায় আনতে এবং নিম্ন আয় ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত সমাজের ৮৫ শতাংশ মানুষকে সুরক্ষা দেওয়ার সুযোগ তৈরি করতে দেশে প্রথমবারের মতো সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালু করল সরকার। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের হিসাব অনুযায়ী ২০২০ সালে ৬০ বছরের বেশি বয়সী মানুষের সংখ্যা ১ কোটি ২০ লাখ এবং ২০৪১ সালে তাদের সংখ্যা হবে ৩ কোটি ১০ লাখ। পেনশন স্কিমের মাধ্যমে ১৮ বছরের বেশি দেশে-বিদেশে থাকা ১০ কোটি মানুষকে সুরক্ষা দিল সরকার। মানুষের গড় আয়ু বাড়ছে। ধীরে ধীরে বাড়ছে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা এবং তাদের নিরাপত্তাহীনতা। আর এ কারণেই চালু করা হচ্ছে সর্বজনীন পেনশন স্কিম। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ পেনশন স্কিম উদ্বোধন করেছেন।

উদ্বোধনের পর দেশে-বিদেশে বসবাসরত ১৮ বছরের বেশি বয়সী যে কোনো বাংলাদেশি সর্বজনীন পেনশনব্যবস্থার আওতায় আসতে পারছেন। এ স্কিমের আওতায় সরকারি চাকরিজীবী ছাড়া দেশের সব নাগরিক পেনশন সুবিধার অন্তর্ভুক্ত হলেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্বোধনের পর এটির আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়েছে। স্কিম অনুযায়ী ব্যক্তির বয়স ৬০ বছর হলেই তিনি সরকার থেকে পেনশন পেতে শুরু করবেন। তাকে আর চাঁদা দিতে হবে না। কিন্তু কেউ যদি ৫৫ বছর বয়সে এসে স্কিমে অংশ নেন, তা হলে ৬৫ বছর বয়স থেকে তিনি পেনশন পেতে শুরু করবেন। সরকার মোট ৬টি স্কিমের কথা ঘোষণা করেছে। তবে আপাতত চালু হয়েছে চারটি স্কিম। এগুলোর নাম দেওয়া হয়েছে প্রবাস, প্রগতি, সুরক্ষা ও সমতা। প্রবাস এটি শুধু বিদেশে কর্মরত বা অবস্থানকারী বাংলাদেশি নাগরিকের জন্য। এর মাসিক চাঁদার হার ধরা হয়েছে ৫ হাজার, সাড়ে ৭ হাজার ও ১০ হাজার টাকা করে। ব্যক্তি চাইলে এই চাঁদার সমপরিমাণ অর্থ তিনি যে দেশে আছেন, সে দেশের মুদ্রায় দিতে পারবেন। আবার দেশে এসে দেশীয় মুদ্রাতেও দিতে পারবেন। এ ছাড়া প্রয়োজনে প্রবাস স্কিম পরিবর্তনেরও সুযোগ থাকছে। প্রগতি এই স্কিম বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের জন্য। এ ক্ষেত্রেও তিন ভাগে চাঁদার হার ভাগ করা হয়েছে। কেউ চাইলে মাসে ২ হাজার, ৩ হাজার বা ৫ হাজার টাকা করে দিয়ে এই স্কিমে অংশ নিতে পারবেন। আবার প্রতিষ্ঠান বা প্রতিষ্ঠানের মালিকও প্রগতি স্কিমে অংশগ্রহণ করতে পারবেন। সে ক্ষেত্রে মোট চাঁদার অর্ধেক কর্মচারী ও বাকি অর্ধেক প্রতিষ্ঠান বহন করবে। সুরক্ষা এ স্কিমটি স্বনির্ভর ব্যক্তির জন্য। অর্থাৎ কেউ কোথাও চাকরি করছেন না; কিন্তু নিজে উপার্জন করতে পারেন, তারা সুরক্ষা স্কিমে অংশ নিতে পারবেন। এর আওতায় পড়েন ফ্রিল্যান্সার, কৃষক, শ্রমিক ইত্যাদি পেশার লোকজন। এই স্কিমে চাঁদার হার চার রকম মাসে এক হাজার, দুই হাজার, তিন হাজার ও পাঁচ হাজার টাকা করে। সমতা এই স্কিমে চাঁদার হার একটিই, এক হাজার টাকা। তবে এ ক্ষেত্রে প্রতিমাসে ব্যক্তি দেবে পাঁচশ টাকা আর বাকি পাঁচশ দেবে সরকার। মূলত দারিদ্রসীমার নিচে বসবাসরত স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য এই স্কিম। এ ক্ষেত্রে দারিদ্রসীমা নির্ধারণ করবে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো। যেমন বর্তমানে বছরে যাদের আয় ৬০ হাজার টাকার মধ্যে, তারাই কেবল এই স্কিমের অন্তভুক্ত হবেন। পেনশনব্যবস্থার আওতায় আসতে গেলে অবশ্যই জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) থাকতে হবে। প্রবাসী বাংলাদেশি যাদের এনআইডি নেই, তারা পাসপোর্টের ভিত্তিতে পারবেন। তবে দ্রুততম সময়ের মধ্যে এনআইডি সংগ্রহ করে পেনশন কর্তৃপক্ষের কাছে তা জমা দিতে হবে। চলতি অর্থবছরের বাজেট বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বয়স্ক জনগোষ্ঠীকে একটি টেকসই ও সুসংগঠিত সামাজিক নিরাপত্তা কাঠামোর আওতায় বৃদ্ধকালীন সুরক্ষা নিশ্চিত করতে জাতীয়ভাবে একটি সর্বজনীন পেনশন পদ্ধতি প্রবর্তনের অঙ্গীকার করেছিলেন। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৫ সালে সরকার জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশলপত্র প্রণয়ন করে।

Advertisements

এতে দেশে একটি ব্যাপকভিত্তিক সমন্বিত অংশগ্রহণমূলক পেনশনব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রস্তাব করা হয়। ২০১৫ সালে প্রয়াত অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এ ব্যাপারে প্রথম উদ্যোগ নেন। ২০১৬ সালে ভারত ঘুরে এসে অর্থ বিভাগের একটি দল একটি ধারণাপত্র তৈরি করে। ২০২২ সালে সর্বশেষ আরেকটি ধারণাপত্র তৈরি করে অর্থ বিভাগ। এর পর এ বছরের ৩১ জানুয়ারি সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা আইন এবং আইনের আওতায় গত ১২ ফেব্রয়ারি জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ গঠন করা হয়। সর্বজনীন পেনশন স্কিমে অন্তর্ভুক্ত হতে গেলে পেনশন কর্তৃপক্ষের ওয়েবসাইটে গিয়ে নিবন্ধন করতে হবে। প্রথমেই একটি পাতা আসবে যেখানে লেখা থাকবে এ কথাগুলো, ‘প্রত্যয়ন করছি যে আমি সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত বা রাষ্ট্রায়ত্ত কোনো প্রতিষ্ঠানে কর্মরত নই। সর্বজনীন পেনশন স্কিমবহির্ভূত কোনো ধরনের সরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান থেকে সুবিধা গ্রহণ করি না। জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের ওয়েবসাইটে পেনশনব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বলা হয়েছে, প্রত্যেক চাঁদাদাতার জন্য একটি আলাদা পেনশন হিসাব থাকবে। চাঁদাদাতা ৬০ বছর বয়স থেকে পেনশন পাওয়া শুরু করবেন। ৭৫ বছর পূর্ণ হওয়ার আগে মারা গেলে তার নমিনি মূল পেনশনারের বয়স ৭৫ হওয়ার বাকি সময় মাসিক ভিত্তিতে পেনশন পাবেন। ১০ বছর চাঁদা দেওয়ার আগে কেউ মারা গেলে জমা হওয়া অর্থ মুনাফাসহ ফেরত পাবেন নমিনি। পেনশনের অর্থ বিনিয়োগ হিসেবে গণ্য হবে এবং মাসিক পেনশনের অর্থ আয়করমুক্ত থাকবে। চাঁদা পরিশোধের ধরনের মধ্যে মাসিক, ত্রৈমাসিক ও বার্ষিকÑ এ তিন অপশন রয়েছে। চারটি স্কিমের জন্য আলাদা চারটি হিসাব খোলা হয়েছে সোনালী ব্যাংকে। এ হিসাবগুলোয় চাঁদা জমা হবে। সোনালী ব্যাংক দিয়ে যাত্রা শুরু হলেও পরে অন্য ব্যাংকও যুক্ত হবে। নির্ধারিত ফরম পূরণ করে এ ব্যাংকের মাধ্যমে ১৮ বছরের বেশি বয়সী যে কেউ পেনশন স্কিমের চাঁদা দিতে পারবেন। নিম্ন আয়সীমার নিচের নাগরিকদের অথবা অসচ্ছল চাঁদাদাতার ক্ষেত্রে পেনশন তহবিলে মাসিক চাঁদার একটি অংশ সরকার অনুদান হিসেবে দিতে পারবে।

পেনশন তহবিলে জমা দেওয়া অর্থ কোনো পর্যায়ে এককালীন তোলার প্রয়োজন পড়লে চাঁদাদাতা আবেদন করলে জমা দেওয়া অর্থের সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ ঋণ হিসেবে তুলতে পারবেন যা ফিসহ পরিশোধ করতে হবে। বাংলাদেশে সরকারি চাকরিজীবীরা অবসরে যাওয়ার পর আমৃত্যু আর্থিক সুবিধা পান প্রতিমাসে। সেই চাকরিজীবী মারা গেলে তার স্ত্রী ও বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী সন্তান থাকলে তাকেও আমৃত্যু পেনশন দেওয়া হয়। কিন্তু বেসরকারি খাতে কর্মরতদের জন্য অবসরজীবনে ও তাদের সন্তানদের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক কোনো সুবিধা নেই। সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার অর্থাৎ বেকারত্ব, ব্যাধি বা পঙ্গুত্বজনিত কিংবা বৈধব্য, মাতা-পিতৃহীনতা অথবা বার্ধক্যজনিত বা অনুরূপ অন্যান্য পরিস্থিতিজনিত আয়ত্তাতীত কারণে অভাবগ্রস্ততার ক্ষেত্রে সরকারি সাহায্য লাভের অধিকারের কথা সংবিধানে বলা রয়েছে। এই আইনের আওতায় অর্থ বিভাগের অধীন একটি ‘সর্বজনীন পেনশন অথরিটি’ গঠন করা হয়েছে। পুরোপুরি আইটিভিত্তিক এ প্রতিষ্ঠান সারাদেশের মানুষের পেনশন ব্যবস্থাপনা করবে।

দেশের আপামর জনগণের জন্য বর্তমান সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারে প্রধানমন্ত্রী একটি সর্বজনীন পেনশনব্যবস্থা প্রবর্তনের যে অঙ্গীকার করেছিলেন, তার আলোকে এ কৌশলপত্র প্রণয়ন করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট ও অর্থনৈতিক সক্ষমতার আলোকে প্রণীত কৌশলপত্রটির ওপর প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন নির্দেশনা দিয়েছেন। এটি একটি অসাধারণ অর্জন বাঙালি জাতির জন্য। সর্বজনীন পেনশনব্যবস্থা প্রবর্তন হলো জাতির জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি উপহার। সামাজিক নিরাপত্তা প্রদান, বেকারত্ব, ব্যাধি, পঙ্গুত্ব বা বার্ধক্যজনিত কারণে নাগরিকদের সরকারি সাহায্য দেওয়া, বয়স্ক জনগোষ্ঠীকে আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে এ সর্বজনীন পেনশনব্যবস্থা চালু করা হয়েছে।

বিনিয়োগ থেকে যে মুনাফা আসবে, তাও পেনশনধারীদের মধ্যে বিতরণ করা হবে। সর্বজনীন পেনশনব্যবস্থা বাস্তবায়ন করতে বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ পদ্ধতিগুলো অনুসরণ করা হয়েছে। মৌলিকভাবে পেনশন একটি ইন্স্যুরেন্সব্যবস্থা যা বেতনভোগী কর্মজীবীদের কন্ট্রিবিউশনের ভিত্তিতে পরিচালিত হয়। কোনো কোনো দেশে কর্মচারীদের পাশাপাশি মালিক ও রাষ্ট্রও আংশিকভাবে ট্রিবিউন করে যা মূল তহবিলের সঙ্গে সংযুক্ত হয়। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা তার বাবার আদর্শকে ধারণ করে দেশে উন্নয়নের বিপ্লব ঘটিয়েছেন। তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে আজ বাংলাদেশ এশিয়ান টাইগার বা উন্নয়নের রোল মডেলে পরিণত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী অন্যান্য ব্যতিক্রমী উদ্যোগের মতো সর্বজনীন পেনশন কার্যক্রম চালু করে ভবিষ্যতে জনগণের মধ্যে এক ধরনের নিরাপত্তা বোধের জন্ম দিয়েছেন। আজ বয়স্ক ব্যক্তিরা যেভাবে তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবেন, সেই ভাবনা তাদের মধ্যে আর থাকবে না। আর এ কারণেই বাঙালি জাতির কাছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জনবান্ধব রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে পরিচিত।

 

লেখক:- সৈয়দ ফারুক হোসেন : রেজিস্ট্রার, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, জামালপুর।