মঙ্গলবার , ২১শে মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ || ৭ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ - গ্রীষ্মকাল || ১২ই জিলকদ, ১৪৪৫ হিজরি

সাংবাদিক নাদিম হত্যার ২মাস: মৃত্যুর আগে ছেলে হত্যার বিচার দেখে যেতে চান মা

প্রকাশিত হয়েছে -


চলতি বছরের ১৪জুন রাতে পেশাগত দায়িত্ব পালন শেষে বাড়ি ফেরার পথে জামালপুরের বকশিগঞ্জের পাটহাটি এলাকায় হামলার শিকার হন বাংলা নিউজ টোয়েন্টিফোরের জেলা প্রতিনিধি ও একাত্তর টিভির সাংবাদিক গোলাম রব্বানী নাদিম। ১৫জুন ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যাবার পর ১৬ জুন সাংবাদিক নাদিমকে দাফন করা হয় পারিবারিক কবরস্থানে।

বিজ্ঞাপন :  যেকোনো চাকরির প্রস্তুতি ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রস্তুতি নিতে প্রিয় শিক্ষালয় অ্যাপ ডাউনলোড করতে ক্লিক করুন :

১৭ জুন বকশিগঞ্জ থানায় ইউপি চেয়ারম্যান মাহমুদুল আলম বাবুসহ ২২ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরও ২০ থেকে ২৫ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করেন সাংবাদিক নাদিমের স্ত্রী মনিরা বেগম। সেই মামলায় এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার রয়েছেন ১৭ জন। আর আদালতে স্বীকারোক্তি মূলক জবানবন্দি দিয়েছেন প্রধান আসামী বকশিগঞ্জের সাধুরপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের বহিস্কৃত চেয়ারম্যান বাবুসহ তিন জন আসামি। ইতিমধ্যে জামালপুর চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে তিনবার জামিনেরও আবেদন করেছে প্রধান আসামী বাবুসহ কয়েকজন। তাদের জামিন না মঞ্জুর হওয়ায় কারাগারেই রয়েছে ১৭ আসামী। তবে সম্প্রতি উচ্চ আদালত থেকে জামিনে এসেছেন এজাহারভুক্ত চার আসামী। এজাহারভুক্ত ২২ আসামির মধ্যে বিভিন্ন সময়ে র‌্যাব ও পুলিশ ৫জনকে গ্রেফতার করে। বাকি অধরা ১৭ আসামির মধ্যে ৪জন জামিনে এসছেন। বেশিরভাগ আসামি এখনো অধরা থাকায় এবং চার আসামী জামিনে আসায় নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন সাংবাদিক পরিবারটি, এ কথা জানিয়েছেন নাদিমের অনার্স পড়–য়া মেয়ে রাব্বিলাতুল জান্নাত ও তার স্ত্রী মনিরা।

সাংবাদিক রব্বানী মারা যাবার ৬০ দিনে সবাই অনেকটা ভুলে গেলেও এখনো শোক কাটিয়ে উঠতে পারেনি সাংবাদিক রব্বানীর সন্তানেরা। পিতার অভাব বোধ করেন প্রতিটি মুহুর্তে। সাংবাদিক নাদিম হত্যার দুই মাস পার হলেও এখনো ধরা ছোঁয়ার বাইরে প্রধান আসামী বাবুর ছেলে রিফাত, রাকিবিল্লাহ রাকিব, লিপন মিয়া, স্বপন মন্ডলসহ এজাহারভুক্ত বেশিরভাগ আসামী। এরই মধ্যে উচ্চ আদালত থেকে চারজন জামিন নিয়ে আসায় প্রাণ ভয়ে আছেন নিহত নাদিমের পরিবার। এছাড়াও প্রশাসনের দ্বারে দ্বারে ঘুরে শুধু আশ^াস পাচ্ছেন, বলছেন নাদিমের সন্তান ও স্ত্রী।

Advertisements

নিহত সাংবাদিক রব্বানীর মেয়ে রাব্বিলাতুল জান্নাত ১৬ আগষ্ট বাবার স্মৃতিচারণ করে কান্নাজড়িত কন্ঠে বলেন ‘আব্বুর রুমে আসলে সবসময় আব্বুর কথা মনে পড়ে। আমাদের বাসার সব জিনিসের মধ্যে আব্বুর স্মৃতি জড়িত। টিভির ফ্রেমে কোনো খবর, বকশিগঞ্জের কোনো নিউজ বা বকশিগঞ্জে কোনো অতিথি আসে ওই ছবিগুলো ফেসবুকে বা বিভিন্ন মাধ্যমে দেখি। তখন বার বার মনে হয়, আমার আব্বু বেচে থাকলে এই জায়গায় যেতো। আমার আব্বুও এই জায়গার নিউজ কাভার করতো। বন্যার সময় দূর্গত মানুষদের চিত্র তুরে ধরতো।’

বাবা হত্যার ৬০ দিন প্রসঙ্গে জান্নাত বলেন, ‘সময় যত চলে যাচ্ছে সব কিছুর পরিস্থিতি যেনো স্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছে। বিষয়টি প্রথম দিকে যেমন সবার মুখে মুখে ছিলো। আসামী গ্রেপ্তারের দাবিতে সাংবাদিকরা কয়েক সপ্তাহ বিচারের দাবিতে আন্দোলন করেছে। এখন আর ওরকম নাই, অনেকটাই নিভৃত্ব হয়ে যাচ্ছে। আত্মীয় স্বজন, আর দু একজন সাংবাদিক আছে; যারাা মাঝে মাঝে আসে ও খোঁজখবর নেয়। এর বাইরে কেউ আসে না। খোঁজ খবরও নেই না। আমার আব্বুর ঘটনা প্রায় ভুলেই যাচ্ছে। আস্তে আস্তে সবাই ভুলে যাবে এবং এই ঘটনা ধামাচাপা পড়ে যাবে বিভিন্ন ঘটনার মতো। এমনটা হওয়ার কথা নয়, কিন্তু বাস্তবতা এমনটাই। আর এজহারভুক্ত ২২ জনের মধ্যে ৫জনকে গ্রেফতার করলেও অধরা ১৭জনের মধ্যে চারজন জামিনে এসছেন। বেশিরভাগ আসামি এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে, খুনিরা বাইরে থাকলে আমাদের জীবন ত অনিরাপত্তাতেই থাকবে আর এটাই স্বাভাবিক। সন্ত্রাসী বাবুর ছেলে অস্ত্রধারী রিফাতসহ রাকিবিল্লাহ রাকিব, লিপন মিয়া, স্বপন মন্ডল ও অন্যান্য খুনিয়া অধরা থাকায় আমাদের জীবনের নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। তাই দ্রæত বাকি আসামিদের গ্রেফতারের দাবি জানাচ্ছি। আর বাবার জন্য সারাদেশের সাংবাদিকদের আরও সহযোহিতা চাচ্ছি।’

বিজ্ঞাপন :  যেকোনো চাকরির প্রস্তুতি ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রস্তুতি নিতে প্রিয় শিক্ষালয় অ্যাপ ডাউনলোড করতে ক্লিক করুন :

নিহত নাদিমের ছেলে আব্দুল্লাহ আল মামুন রিফাত বলেন ‘আমাদের প্রতি মুহুর্তে বাবার কথা মনে পড়ে। আমরা প্রতি মুহুর্তে বাবার অভাব বোধ করি। কিন্তু দুঃখের বিষয় দুই মাস হয়ে গেলো আমাদের কেউ কোনো খোঁজ খবর নেই না। আমাদের কেউ কোনো সাহায্য করে না। আমার বাবা হত্যার ঘটনা দিনদিন ধামাচাপা পড়ছে।’

নিহত নাদিমের স্ত্রী মনিরা বেগম বলেন-“আমি মামলা করার আগ পর্যন্ত পাঁচজন আসামী ধরা হয়েছিলো। মামলার করার পরে এখন পর্যন্ত এজাহারভুক্ত কোনো আসামী ধরা হয় নাই। আমি এসপি স্যারের কাছে গিয়েছি। মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে গিয়েছি তারা সবাই বলেছে যে, এজাহারভুক্ত আসামী ধরা হবে। তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। আমাকে প্রশাসন বার বার বলছে যে, আপনি আমাদের উপর আস্থা রাখেন,ভরসা রাখেন। আমার এখন পর্যন্ত প্রশাসনের উপর আস্থা, ভরসা দুটোই ছিলো। কিন্তু এখন পর্যন্ত আর কোনো আসামী ধরা হয় নাই। চেয়ারম্যানের ছেলেও না। এমনকি আর কোনো এজাহারভুক্ত আসামীও ধরা হয় নাই। এর মধ্যে চার জন আসামী হাইকোর্ট থেকে জামিনে এসেছে। তাহলে আমি এখন আর কোন আশায় থাকবো। আসতে আসতে সব আসামী জামিনে আসতে পারে। কেউ ধরা পরাতছে না। তাই প্রশাসনের কাছে অনুরোধ, এজাহারভুক্ত আসামীগুলো যাতে তাড়াতাড়ি গ্রেপ্তার করা হয়। তারা যাতে জামিনে না আসতে পারে। তারা জামিনে আসায় আমরা অনিরাপত্তা বোধ করছি।’

কান্না জড়িত কণ্ঠে নিহত নাদিমের মা আলেয়া বেগম বলেন, ‘আমার সোনার টুকরা বাবা গোলাম রব্বানী নাদিম। ওকে মাইরা ফেলেছে দুই মাস হলো। এখন পর্যন্ত আসামী ধরা হলো না। অনেক আসামী বাকি আছে। হাইকোর্ট থেকে জামিন এনে ওরা আমাদের হুমকি ধামকি দেখাচ্ছে। আমাদের পরিবার এখন অনেক আতঙ্কে আছি। আমরা এখন কোথায় যাবো। পুলিশ ত বাকি আসামিদের ধরতে পারছে না। তারা ত আর দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়নি। প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমার আকুল আবেদন। তাড়াতাড়ি যেনো আসামীগুলো গ্রেপ্তার হয়। আর মরার আগে ছেলে হত্যার বিচার যেন দেখে যেতে পারি।’

সাংবাদিক নাদিম হত্যা মামলার এজাহারভুক্ত আসামী গ্রেপ্তার করতে না পাড়ায় ক্ষুব্ধ জেলার সাংবাদিকরা। দ্রæত সকল আসামীকে আইনের আওতায় আনার দাবি তাদের।

জামালপুর অনলাইন জার্নালিস্ট নেটওয়ার্কের সভাপতি জাহাঙ্গীর সেলিম বলেন ‘যেহেতু পাঁচ জন আসামী হাইকোর্ট থেকে জামিন নিয়েছে। তাহলে সকল আসামী পলাতকরা এই দেশেই আছে। পুলিশ কেনো গ্রেপ্তার করতে পারছে না এটা জনমনে প্রশ্ন। আমরা জোড় দাবি জানাচ্ছি। অনতিবিলম্বে এজাহারভুক্ত সকল আসামীকে গ্রেপ্তারের আওতায় এনে তাদেরকে রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ করে তথ্য উদঘাটন করা এবং আইনমন্ত্রীর বক্তব্য অনুযায়ি মামলাটি দ্রæত বিচার আইনে দেয়ার জোড় দাবি জানাচ্ছি।’


বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি মনজুরুল আহসান বুলবুল সাংবাদিক নাদিমের পরিবারের নিরাপত্তার ব্যাপারে বলেন, ‘এখনো বেশিরভাগ আসামি অধরা। তাদেরকে দ্রæত গ্রেফতারের দাবি জানিয়েছেন। আর সাংবাদিক নাদিমের পরিবারের নিরাপত্তার ভার স্থানীয় উপজেলা চেয়ারম্যান, স্থানীয় প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেতাদের নিতে হবে। আর বিচারের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাংবাদিক নেতাদের নিয়ে কথা বলার ব্যাপারেও জানান এ জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক।’

জানতে চাইলে জামালপুরের পুলিশ সুপার মো: কামরুজ্জামান বলেন ‘এই মামলার প্রতিটি আসামীকে গ্রেপ্তার করেই আমরা এই মামলার তদন্ত কাজ শেষ করবো। আমাদের কার্যক্রম চলমান আছে। যত তাড়াতাড়ি এই মামলা শেষ করা যাই, সেটির ব্যবস্থা আমরা নিবো।’