শনিবার , ১৮ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ || ৪ঠা জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ - গ্রীষ্মকাল || ৯ই জিলকদ, ১৪৪৫ হিজরি

গরিব মানুষের পাতে টান

প্রকাশিত হয়েছে -

:চিররঞ্জন সরকার:

টাকার দাম কমছে। এর পাশাপাশি বাজারে জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। কিছুদিন আগেও একটি নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা নিয়ে বাজারে গেলে যতটা চাল-ডাল, তেল-মসলা, আনাজ, ফলমূল, মাছ-মাংস কেনা যেত এখন তার থেকে কম পরিমাণে কেনা যাচ্ছে। একটি ছোট্ট হিসাব দেওয়া যাক। আট-নয় মাস আগেও ভোজ্যতেলের দাম প্রতিলিটার ১০০ থেকে ১৩০ টাকার মধ্যে ছিল। গত কয়েক মাসে তা বেড়ে লিটারপ্রতি প্রায় ২০০ টাকায় পৌঁছেছে। গত বছরের তুলনায় চাল, ডাল, মাছ, মাংস, ডিম, তরিতরকারির দাম বেড়েছে। পরিবহন ভাড়া বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। আর জ্বালানি? বাড়তে বাড়তে পেট্রল-ডিজেল এখন লিটারপ্রতি ১২৫ টাকার কাছাকাছি। গ্যাসের দাম সিলিন্ডারপ্রতি এক হাজার টাকা ছাড়িয়ে গেছে। সবকিছুর দাম বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। অনেক কিছুর দাম বাড়ছে তেমন কোনো কার্যকারণ ছাড়াই। এর প্রভাব পড়ছে সাধারণ মানুষের ওপর। প্রতিনিয়ত তাদের জীবনযাত্রার ব্যয় সংকুচিত করতে হচ্ছে। ফলে ছেঁটে ফেলতে হচ্ছে চাহিদা। গরিব ও মধ্যবিত্তদের পাত থেকে আমিষও দিন দিন উধাও হয়ে যাচ্ছে।

মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়লেও আয় বাড়ছে না। যতটুকু যা বাড়ছে, সেটি জিনিসপত্রের বাড়তি দাম খেয়ে নিচ্ছে। সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ হিসাবে গত মে মাসে দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ। আর ওই মাসে মজুরি বেড়েছে ৭ দশমিক ৩২ শতাংশ। অর্থাৎ বাজারে জিনিসপত্রের দাম যে হারে বাড়ছে, দেশের বিভিন্ন খাতের দিনমজুর ও শ্রমিকদের মজুরি ওই হারে বাড়ছে না।

Advertisements

সাধারণত সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মজুরিও বাড়ে। মজুরি বেশি বৃদ্ধি পেলে মূল্যস্ফীতির আঁচ টের পান না তারা। কিন্তু সমান হলে দুশ্চিন্তা বাড়ে আর কম হলে সংকটে পড়ে যান। তখন খাওয়া-পরা-কেনা কমিয়ে দেন। মে মাসে মজুরি বৃদ্ধির হার ছিল ৭ দশমিক ৩২ শতাংশ। এর মানে, মজুরি বৃদ্ধির বাড়তি টাকা পুরোটা খরচ করেও মানুষ সংসারের খরচ মেটাতে পারেনি; সঞ্চয় করা বা জীবনযাত্রার বাড়তি চাহিদা মেটানোর তো প্রশ্নই আসে না।

ক্রমাগত মূল্যবৃদ্ধির কারণে মানুষ অনেক দিন ধরেই নাস্তানাবুদ হচ্ছে। দুই বছরের করোনা মহামারীর ধাক্কা সামলে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যসহ পুরো অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিল। ব্যবসা-বাণিজ্য চাঙ্গা করার এই প্রক্রিয়ায় মজুরিও বাড়তে থাকে। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে মূল্যস্ফীতির পারদও বাড়তে থাকে। গত বছরের আগস্টে এক লাফে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশ ছাড়িয়ে ৯ দশমিক ৫২ শতাংশে উঠে যায়। তা ছিল এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। এর পর কমতে কমতে এপ্রিলে ৯ দশমিক ২৪ শতাংশে নেমে আসে। কিন্তু মে মাসে তা ফের বেড়ে এক লাফে প্রায় দুই অঙ্কের (ডাবল ডিজিট) ঘরে ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশে পৌঁছেছে।

সাধারণত মজুরি বৃদ্ধির হার মূল্যস্ফীতির কিছুটা বেশি থাকে। কিন্তু ওই চিরায়ত প্রবণতায় এখন টান পড়েছে। এক বছরের বেশি ধরে মজুরি বৃদ্ধির হার মূল্যস্ফীতির চেয়ে কম। বাড়তি মজুরির টাকা খেয়ে ফেলছে নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি। খুব সহসা মূল্যস্ফীতি লাগামের মধ্যে আসবে বলে মনে হচ্ছে না।

কেন এমন হচ্ছে? এ প্রশ্নের দুই-তিন রকম ব্যাখ্যা হতে পারে। পণ্ডিতরা বলতে পারেন, বাজার অর্থনীতির ওপর নির্ভরশীল দেশে মূল্যবৃদ্ধিতে সরকারের ওই অর্থে নিয়ন্ত্রণ থাকে না। কোনো কোনো পণ্যের ক্ষেত্রে সরকার খানিকটা রেগুলেট করতে পারে হয়তো। বস্তুত ওই রেগুলেট করার সুযোগটাও যথাযথভাবে কাজে লাগাচ্ছে না। তাই মূল্যবৃদ্ধি বন্ধ করা যাচ্ছে না।

দিন যত যাচ্ছে, আমাদের বাজার কেন্দ্রীভূত হচ্ছে কতিপয় নির্দিষ্ট শিল্পপতির হাতে। জ্বালানি তেল থেকে লবণ ও পান্তা- প্রায় পুরো পাইকারি বাজারই এখন তাদের হাতে। মজার বিষয় হলো, অধিকাংশ সংবাদমাধ্যমও এখন নিয়ন্ত্রণ করছে বড় করপোরেট। আরও স্পষ্ট করে বলতে গেলে, নির্দিষ্ট কয়েকটি করপোরেটের হাতেই এখন দেশের অধিকাংশ মূল স্রোতের সংবাদমাধ্যম। ফলে শুধু বাজার নয়, বাজার নিয়ে কথা বলবে যে সংবাদমাধ্যম তাদেরও নিয়ন্ত্রণ করছে কয়েকটি করপোরেট সংস্থা। বাজার হু হু করে চড়লেও, মধ্যবিত্তের নুন আনতে পান্তা ফুরালেও সংবাদমাধ্যমে ওই অর্থে তার কোনো প্রতিফলন নেই।

মূল্যবৃদ্ধির কারণে মানুষের নাভিশ্বাস দশা হলেও এ ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোর রুটিনমাফিক বক্তৃতা-বিবৃতির বাইরে কোনো বিশেষ উদ্যোগ নেই। আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির ওপর দায় চাপিয়ে সরকারও হাত গুটিয়ে বসে আছে। নতুন বাজেটে মূলস্ফীতি কমানো বা নিয়ন্ত্রণের কোনো অঙ্গীকার দেখা যায়নি। বড় পাইকাররা রাতারাতি পেঁয়াজের দাম বাড়িয়ে দিল। সরকার ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানির ঘোষণা দেওয়ার পর রাতারাতি তা ২৫-৩০ টাকা কমেও গেল। মাঝখান থেকে অসাধুচক্র কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিল। এই ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট কখনো পেঁয়াজ, কখনো চিনি, কখনো সয়াবিন, কখনো ডিম বা লবণ ইত্যাদির দাম বাড়িয়ে কোটি কোটি টাকা মুনাফা করছে। সরকার তাদের কিছুই করতে পারছে না।

ক্ষুব্ধ মানুষ ক্রমেই হতাশায় নিমজ্জিত হচ্ছে। তারা ধরে নিয়েছেন, মূল্যবৃদ্ধির এ নিয়মই বাস্তব। এ নিয়ে বেশি কথা বলে লাভ নেই। সরকারি হিসাবেই এখন মুদ্রাস্ফীতির পরিমাণ প্রায় ১০ শতাংশ। বাস্তবে তা বেশি বলেই বিশেষজ্ঞদের মত। মুদ্রাস্ফীতি চলতে থাকলে মূল্যবৃদ্ধি হবেই এটি অর্থনীতির সহজ পাঠ। কিন্তু রাজনীতিবিদরা দিচ্ছেন ভিন্ন পাঠ। তারা বুঝিয়ে দিচ্ছেন দিন আনা দিন খাওয়া মানুষকে ধর্ম নিয়ে ভাবতে হবে, প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলকে নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম পাঠ দিচ্ছে হিরো আলম-জাহেদ খানকে নিয়ে ভাবতে হবে, পরীমনি-বুবলীকে নিয়ে ভাবতে হবে, ক্রিকেট নিয়ে ভাবতে হবে, অন্য দেশে হওয়া যুদ্ধ নিয়ে ভাবতে হবে। মানুষ ভাবছেও সেটিই।

নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম কমানোর ব্যাপারে কোনো কার্যকর ভূমিকা পালনে সরকার শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ। কারণ দাম আপনাআপনি বাড়ে না, বৃদ্ধি করা হয়। বলা বাহুল্য, এ দাম বৃদ্ধি করা ক্ষেত্রে আমদানিকারক, ব্যবসায়ী, আড়তদার, চাঁদাবাজ, আন্তর্জাতিক বাজার ইত্যাদির ভূমিকা থাকলেও সরকারি নীতির ভূমিকাও উপেক্ষণীয় নয়। মানুষও সর্বংসহা হয়ে যাচ্ছে। আমাদের দেশের শাসকরা নানা কৌশলে মানুষের সহ্যশক্তি বাড়িয়ে দিয়েছে। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর ধরে যদি একটু একটু করে নির্যাতন ও আঘাত করা হয় তা হলে এক সময় তা সয়ে যায়। এর পর আঘাতের মাত্রা বৃদ্ধি করলেও খুব একটা ভাবান্তর হয় না। আমাদের দেশের মানুষকেও একটু একটু করে আঘাত ও নির্যাতন চালিয়ে সর্বংসহা বানিয়ে ফেলা হয়েছে।

আমরা অবশ্য এর পরও মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে মাথা ঘামাই। এটি নিয়ে আমাদের মাথা ঘামাতেই হয়। কারণ বাঁচার জন্য আমাদের খেতে হয়, জিনিসপত্র কিনতে হয়। কাজেই দাম যত বেশিই হোক, প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি আমাদের সংগ্রহ করতে হবে। কম হোক, বেশি হোক, ভাত হোক, আলু হোক, আমিষ হোক আর নিরামিষ হোক, সাপ-ব্যাঙ-কুকুরই হোক, মরা মুরগি-রাসায়নিক মিশ্রিত সবজিই হোক খেতে হবেই। না খেয়ে মানুষ বাঁচে না, বাঁচতে পারে না।

জিনিসপত্রের দাম ক্রমাগত কেন বাড়ছে, কী পরিমাণ বাড়ছে, এতে সরকারের ভূমিকা কতটুকু, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধির প্রভাব কতটুকু আর ব্যবসায়ী বা মধ্যস্বত্বভোগীদের কারসাজি কতটুকু, এই দাম বৃদ্ধির ফলে কারা ক্ষতিগ্রস্ত হলো, এর পরিণামই বা কী এসব বিষয় নিয়ে অনেক আলোচনা ও গবেষণা হয়েছে, এখনো হচ্ছে, আশা করা যায় ভবিষ্যতে আরও হবে। কিন্তু এতে পরিস্থিতি বদলায়নি, হয়তো বদলাবেও না। বাজারদর এখনো চড়া। চাল-ডাল, তরিতরকারি, চিনি-তেল, মাছ-মাংস, ডিম, দুধসহ প্রায় সব জিনিসের দামই বেশি।

এই দাম বেড়ে যাওয়া নিয়েও আছে পরস্পরবিরোধী মন্তব্য। সরকার দোষ দেয় ব্যবসায়ীদের। তাদের অতিমুনাফার লোভ আর মজুদদারি মানসিকতার কারণে দাম বাড়ে বলে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়। পক্ষান্তরে ব্যবসায়ীরা বলেন নানা কথা। তাদের মতে উৎপাদন কম হওয়া, পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধি, চাঁদাবাজি, আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি কারণেই মূল্যবৃদ্ধি ঘটে। দাম বৃদ্ধির জন্য ব্যবসায়ীরা ইদানীং ক্রেতাদের দোষ দেন। ক্রেতারা এক কেজি লাগলে পাঁচ কেজি কেনেন। এতে দাম বাড়ে বলে মন্তব্য করেছেন এক ব্যবসায়ী! পক্ষান্তরে ক্রেতাদের কেউ কেউ এমন কথাও বলেন আমাদের দেশের ব্যবসায়ীরা চুরি নয়, ডাকাতি শুরু করেছেন! এভাবে দাম বৃদ্ধি করার জন্য ব্যবসায়ী-সরকার-ক্রেতা একে অন্যকে দায়ী করছেন। কিন্তু এতে অবশ্য জিনিসের দাম কমছে না!

সরকার নানা উন্নয়ন করছে, জিডিপি বাড়ছে, মাথাপিছু আয় বাড়ছে, দেশ উন্নয়নশীল হয়ে যাচ্ছে; বড় বড় সেতু, টানেল, মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওসহ নানা প্রকল্প হচ্ছে। কিন্তু নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম যদি সাধারণ মানুষের আয়ত্তের মধ্যে না থাকে, তা হলে কোনো উন্নয়নেই তাদের পেট ভরবে না। চাল-ডাল, তেল-লবণ, বিদ্যুৎ না পেলে তারা ফুঁসে উঠতে পারেন। কাজেই উন্নয়নের পাশাপাশি চাল-ডাল, তেল-লবণ, বিদ্যুতের সরবরাহ ও দাম নিয়ন্ত্রণকে অগ্রাধিকারের তালিকায় এক নম্বরে রাখতে হবে। তা না হলে ভয়ঙ্কর কিছু ঘটে যেতে পারে।

চিররঞ্জন সরকার : কলাম লেখক।