রবিবার , ১৯শে মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ || ৫ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ - গ্রীষ্মকাল || ১০ই জিলকদ, ১৪৪৫ হিজরি

কুরআন ও হাদিসের আলোকে শবে বরাত

প্রকাশিত হয়েছে -

শবে বরাত বা লায়লাতুল বরাত বলতে শাবান মাসের ১৫ তারিখের রাতকে বুঝানো হয়। ইদানিং কেউ কেউ ধারণা করে থাকে যে, ইসলামে শবে বরাত বলতে কিছু নেই।অথচ শবে বরাতের প্রামাণিকতা,ফীলত ও আমল সম্বন্ধে বেশ কয়েকটি হাদিস রয়েছে । যেমন হযরত আ’লা ইবনুল হারিছ রাহ. থেকে বর্ণিত, উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়েশা রা. বলেন, একবার রাসূলুল্লাহ (সা.) রাতে নামাজে দাঁড়ালেন এবং এত দীর্ঘ সেজদা করলেন যে, আমার আশঙ্কা হলো, তাঁর হয়তো ইন্তেকাল হয়ে গেছে। আমি তখন উঠে তাঁর বৃদ্ধাঙ্গুলি নাড়া দিলাম, তাঁর বৃদ্ধাঙ্গুলি নড়ল। যখন তিনি সেজদা থেকে উঠলেন এবং নামাজ শেষ করলেন তখন আমাকে লক্ষ করে বললেন, হে আয়েশা! অথবা বলেছেন, ও হুমায়রা! তোমার কি এই আশঙ্কা হয়েছে যে, আল্লাহর রাসূল তোমার হক নষ্ট করবেন?
আমি উত্তরে বললাম, না, ইয়া রাসূলুল্লাহ। আপনার দীর্ঘ সেজদা থেকে আমার আশঙ্কা হয়েছিল, আপনি মৃত্যুবরণ করেছেন কি না। নবীজী জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি জান এটা কোন রাত? আমি বললাম, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই ভালো জানেন। তিনি তখন বললেন, এটা হলো অর্ধ শা’বানের রাত। (শা’বানের চৌদ্দ তারিখের দিবাগত রাত)। আল্লাহ তাআলা অর্ধ শা’বানের রাতে তাঁর বান্দাদের প্রতি রহমতের দৃষ্টি প্রদান করেন, ক্ষমা প্রার্থনাকারীদের ক্ষমা করেন এবং অনুগ্রহপ্রার্থীদের প্রতি অনুগ্রহ করেন। আর বিদ্বেষ পোষণকারীদের ছেড়ে দেন তাদের অবস্থাতেই। (শুআবুল ঈমান, বায়হাকী ৩/৩৮২,৩৮৩)।
সহীহ ইবনে হিব্বান ও তাবরানীতে বর্ণিত একটি সহীহ হাদিসে আছে যে, এ রাতে আল্লাহ তায়ালা মুশরিক ও বিদ্বেষ পোষণকারী ব্যতীত সকলকে ক্ষমা করে দেন। মুসনাদে আহমদ, সুনানে। তিরমিযী ও ইবনে মাযাহতে অপর এক হাদিসে উল্লেখ আছে যে, আয়েশা (রাঃ) বলেন, এক রাতে আমি,রাসুলুল্লাহ (সাঃ) কে বিছানায় না পেয়ে খুঁজতে বের হলাম, বাকী নামক কবরস্থানে তাঁকে পেলাম।তখন (আমার অবস্থাদৃষ্টে) রাসুল বললেন, তুমি কি মনে কর আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সাঃ) তোমার উপর জুলুম করবেন? আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল আমি ধারণা করেছিলাম আপনি অন্য কোন স্ত্রীর ঘরে (কারণবশত )তাশরীফ নিয়েছেন । তখন রাসুল (সাঃ) ইরশাদ করলেন, আল্লাহ তায়ালা অর্ধ শাবানের রাতে দুনিয়ার আসমানে অবতরণ করেন এবং “কালব গোত্রের ভাগলসমূহের পশমের চেয়েও অধিক সংখ্যক গুনাহগারকে ক্ষমা করে দেন।
তোমরা শবে বারাআতের রজনীতে জাগ্রত থেকে ইবাদত করবে এবং দিনের বেলায় রোযা রাখবে।”( মিশকাত)হযরত আলী বিন আবু তালীব রা. থেকে বর্ণিত। রাসূল সাঃ ইরশাদ করেছেন-যখন শাবান মাসের অর্ধেকের রজনী আসে [শবে বরাত] তখন তোমরা রাতে নামায পড়, আর দিনের বেলা রোযা রাখ। নিশ্চয়ই আল্লাহ এ রাতে সূর্য ডুবার সাথে সাথে পৃথিবীর আসমানে এসে বলেন-কোন গোনাহগার ক্ষমাপ্রার্থী আছে কি আমার কাছে? আমি তাকে ক্ষমা করে দিব। কোন রিজিকপ্রার্থী আছে কি? আমি তাকে রিজিক দিব। কোন বিপদগ্রস্থ মুক্তি পেতে চাও কি? আমি তাকে বিপদমুক্ত করে দিব। আছে কি এমন, আছে কি তেমন? এমন বলতে থাকেন ফযর পর্যন্ত। (সূনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস নং-১৩৮৮, শুয়াবুল ঈমান, হাদিস নং-৩৮২২)

তাছাড়া ফিকহে হানাফীর ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে আলী আল হাসকাফী দুররুল মুখতার গ্রন্থে, আল্লামা ইবনে আবেদীন আশ-শামী রদ্দুল মুহতারে, আল্লামা ইবনে নুজাইম আল-মিসরী আল-বাহরুর রায়েক, আল্লামা হাসান আশ-শারামুলালি মারাকীল ফালাহতে, শায়েখ আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী মা ছাবাতা বিস-সুন্নাহতে, আল্লামা আব্দুল হাই লখনৰী আল-আসারুল মারফু আয়, ইমাম শাফেয়ী ‘আলউম” কিতাবে, আল্লামা ইবনুল হজ্জ মালেকী আল-মাদখালে এবং শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া হাম্বলী সহ আরো অনেকে এ রাতে জাগ্রত থেকে ইবাদত করাকে মুস্তাহাব বলেছেন এমনকি আহলে হাদিস আলেম মাওলানা আব্দুর রহমান ও উবায়দুল্লাহ মুবারকপুরী উভয়ে বলেন بمجموعها حجة على من زعم انه لم يثبت في فضيلة اليلة النصف من شعبان شيئ تحفة الأحوذي ۲۲۲/۳. مراة المفاتيح ٢/ ٣٢٥

শবে বরাত সম্পর্কীয় হাদিসসমূহ সমষ্ঠিগতভাবে ঐ ব্যক্তির বিরূদ্ধে দলীল, যে মনে করে শরীয়তে শবে বরাতের কোন ভিত্তি নেই ।

Advertisements

মোটকথা : শবে বরাতের ইবাদত ও ফযীলত সহীহ হাদিস ও ফেকহের নির্ভরযোগ্য কিতাব থেকে প্রমাণিত ।উল্লেখ্য শরীয়কে ছাড়াছাড়ির যেমন সুযোগ নেই, তেমনি বাড়াবাড়িরও গ্রহণযোগ্যতা নেই, এ দুয়ের মাঝেই হল শরীয়ত । তাই এরাতের করণীয় বিষয়গুলো হল : একাকী রাত্র জেগে নফল ইবাদত করা। যেমন, নফল নামাজ, কুরআন তেলাওয়াত, তাওবা, তাসবীহ, যিকির-আযকার, দান-সদকা ও দোয়া করা ইত্যাদি। সে রাতে কবর জিয়ারত করা এবং পরের দিন রোযা রাখা ইত্যাদি নিঃসন্দেহে এগুলো আমলযোগ্য। আর বর্জনীয় বিষয়গুলো হল :- এ রাতে ইবাদতের উদ্দেশ্যে মসজিদে পূর্বের চেয়ে অতিরিক্ত আলোকসজ্জা করা। সাওয়াবের আশায় হালুয়া রুটি তৈরি ও বিতরণ করা। গুরুত্ব সহকারে সংঘবন্ধ হয়ে উচ্চস্বরে যিকির করা জামাতের সাথে বা রাক’আত নির্ধারণ করে নামাজ পড়া মাজারে মাজারে ঘোরা-ফেরা করা। আর এ রাতে ঘোষনা বা ডাকাডাকী করে ইবাদতের জন্য মসজিদে একত্রিত হওয়া মাকরূহ। সুতরাং এ সকল গর্হিত কাজ থেকে বেঁচে থাকা সকল মুসলমানের জন্য জরুরী।

আল্লাহ আমাদের কে সহিহ বুঝ এবং আমল করার তাওফিক দান করুন।