রবিবার , ৫ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ || ২২শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ - গ্রীষ্মকাল || ২৫শে শাওয়াল, ১৪৪৫ হিজরি

ঘুরে আসুন চেনা স্থানের অচেনা পরিবেশে…

প্রকাশিত হয়েছে -

রফিক মজিদ :
শেরপুরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বেষ্টিত গারো পাহাড়ের গজনি অবকাশ, মধুটিলা ইকোপার্ক, তাড়ানি পানিহাতা, রাজার পাহাড়, নেওয়াবাড়ি টিলা, হারিয়াকোনা, বালিঝুড়ি পাহাড়ের মতো দর্শনীয় স্থানগুলোর পাশপাশি আরো অনেক কৃত্রিম এবং প্রাকৃতিক পরিবেশের বেড়ানো বা আড্ডা দেয়ার মনমুগ্ধকর জায়গা রয়েছে। এসবের মধ্যে কিছু কিছু স্থান রয়েছে যা মওসুম কেন্দ্রীক। আবার কিছু কিছু স্থান রয়েছে বছর জুড়েই বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ ভিড় করেন। শহরের একঘেয়েমিপনা ছাড়াতে বা নানা চিন্তায় বিষিয়ে ওঠা মনকে ক্ষনিকের জন্য হলেও সতেজ করতে ছুটে যেতে পারেন এসব স্থানে। একা কিম্বা পরিবার-পরিজন নিয়ে অথবা বন্ধুদের সঙ্গে ব্যস্ত জীবনের ছুটাছুটি’র অলসতাকে ঝেড়ে ফেলতে প্রকৃতির নীরবতার ছোঁয়া নিতে ছুটে যেতে পারেন এসব স্থানে। খুব বেশী দুরে বা ব্যায় বহন করবে না শেরপুরের এসব স্থানগুলো ঘুরতে। আপনার বাড়ির পাশেই রয়েছে এসব চেনা স্থানের অচেনা পরিবেশ। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-
নকলা বাইপাস :
কে না ভালবাসে সবুজকে । প্রকৃতির নির্মল বাতাস আর ছায়াঘেরা সবুজের হাতছানি যে কোন প্রকৃতি প্রেমীর মনকে উদ্বেলিত করবে। তাই দেরি না করে ঘরের পাশেই সেই সবুজের সঙ্গে ক্ষনিকের জন্য মিতালি করে আসুন নকলা উপজেলার বাইপাস সড়কের পাশে। নকলা উপজেলা শহর থেকে মাত্র দুই কিলো অদুরে নকলা-ময়মনসিংহ সড়কের পাইসকা মোড় থেকে লাভা গ্রাম হয়ে গড়েরগাঁও মোড় পর্যন্ত সম্প্রতি নির্মিত বাইপাস সড়কটিতে যানবাহন খুব একটি না চলাচল করলেও বিকেলে ঢল নামে তরুন-তরুনী আর আড্ডাবাজ বন্ধুদের। বিশেষ করে ঈদের ছুটিতে এখন ওই সড়ক যানবাহনের নয় মানুষের দখলে চলে গেছে। উপচে পড়া ভিড়ে মনে হবে কোন এক পর্যটন স্থানে পরিনতি হয়েছে সড়ক এবং সড়কের উপর ব্রীজটি। ব্রীজের পশ্চিম এবং পূর্ব দিক দিয়ে নেমে গেছে মাটি’র রাস্তা। ওই রাস্তার দুই পাশের সারি সারি গাছের ছায়া আর প্রকৃতির নির্মল বাতাস নিমিশেই কান্ত দেহ জুড়িয়ে দিবে। বাইপাস ব্রীজ থেকে পূর্ব পাশের সড়কটি চলে গেছে পূর্ব লাভা গ্রামে। ছাড়া ঘেরা ওই সড়ক দিয়ে হেঁটে বেড়ানো ছাড়াও গাছের ছায়ায় বসে বসে আড্ডা বা চিনা বাদাম অথবা চানাচুর মুখে পুড়ে চিবুতে চিবুতে কখন যে সন্ধ্যা নেমে পশ্চিম আকাশে সূর্যের রক্তিম রঙ ধারন করবে বুঝতে পারবেন না। তাই আড্ডা ভেঙে সূর্যের সে রঙ দেখতে ছুটে যান ব্রীজের উপর। এরপর সন্ধ্যার হিমেল বাতাসের পরশ নিয়ে ফিরে আসুন ঘরে। দেখবেন রাতের ঘুম কেমন প্রশান্তির হয়। তাই দেরি না করে ঘুরে আসুন নকলা বাইপাসে।
এখানে নিজস্ব মোটরবাইক থাকলে তো কথায় নেই। নকলা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক ধরে সোজা ছুটে যান বাইপসের পাইসকা মোড়ে। তারপর হাতের বাদিক দিয়ে ঢুকে যান গড়েরগাঁও এর দিকে। কিছু দুর এগুলেই পেয়ে যাবেন বাইপাস ব্রীজ। ওই ব্রীজের পাশ দিয়েই নেমে গেছে শ্যামল ছায়ার কাঁচা সড়ক। যাদের নিজস্ব যান নেই তারা অটো করে চলে যেতে পারেন সরাসরি বাইপাস সড়কে। ভাড়া জনপ্রতি ১০ টাকা।
চন্দ্রকোনা ব্রীজ :
এখন বর্ষাকাল। নকলা উপজেলার চন্দ্রকোনা বাজার ঘেষে বয়ে চলে গেছে মৃগী নদী। এ নদীর এখন যৌবন কাল চলছে। পানিতে টইটম্বুর নদীর দুই তীর। চন্দ্রকোনা বাজারের পাশেই রয়েছে দীর্ঘ ব্রীজ। এ ব্রীজের উপর দাড়িয়ে দেখা যাবে দিগন্ত জুড়ে পানির ¯্রােত আর পুবালি বাতাসে মন ভরে যাবে। বিশেষ করে এ ব্রীজের উপর থেকে সাঁজ বেলার সূর্যকে দেখে বাড়ি ফিরতে মন চাইবে না।
তাহলে আর দেরি না করে নিজেই মোটরসাইকেল নিয়ে বেড়িয়ে যান অথবা বন্ধুদের নিয়ে। আর পরিবার পরিজন নিয়ে গেলেতো মজা আরো বেড়ে যাবে। ছোটখাটে একটি পিকনিক হয়ে যাবে। আর যদি কেউ নব বধূকে নিয়ে বেড়াতে যান তাহলে সঙ্গে ক্যামেরা বা এনড্রয়েড মোবাইল ফোন সঙ্গে নিতে ভূলবেন না কিন্তু। কারন, সাঁজ বেলার সূর্যাস্তের দৃশ্য ক্যামেরাবন্দি করতে অথবা সূর্যের সঙ্গে সেলফি তোলার সুযোগটা হাতছাড়া করবেন না।
ভোটকান্দি স্টীল ব্রীজ :

নকলা উপজেলার চন্দ্রকোনা ইউনিয়নের সেনের চর ভোটকান্দি গ্রামে দশানী নদীর উপর দীর্ঘ স্টীল ব্রীজটি স্থানীয় ও আশাপাশের বিনোদিন প্রিয় মানুষ একটু মুক্ত ও খোলা হাওয়া খেতে ছুটে আসেন ওই ব্রীজের উপর। বর্ষায় এর সৌন্দর্য অপরূপ হওয়ায় বর্ষা মওসুমেই লোকজন এখানে বেড়াতে আসে। শেরপুর জেলার মধ্যে ওই ব্রীজটি সবচেয়ে দীর্ঘ হওয়ায় দুরের প্রকৃতি আপনাকে হাতছানি দিয়ে ডাকবে। বর্ষা মওসুম ছাড়াও শীত মওসুমেও মানুষ আসে দিগন্ত জুড়ে সর্ষের হলুদ সমারোহ দেখতে।
যেভাবে যাবেন :

শেরপুর জেলা শহরের থানা মোড় থেকে চন্দ্রকোনা বাজারে সরাসরি ব্যাটারি চালিত ইজিবাইক চলাচল করে। এ ইজিবাইকে যেতে পারেন অথবা একটু আরাম করে যেতে চাইলে সিএনজি চালিত অটো রিক্সায় যেতে পারেন। আর যদি কারো নিজন্ব কার থাকে তবে তো কথাই নেই সোজা থানা মোড় হয়ে কানাসাখোলা বাজার হয়ে ভীমগঞ্জ বাজারের উপর দিয়ে সোজা চন্দ্রকোনা বাজার। বাজারের দক্ষিণ পশেই চন্দ্রকোনা ব্রীজ। ঢাকা অথবা ময়মনসিংহ থেকে কেউ যদি চন্দ্রকোনা যেতে চান তবে নকলা শহর হয়ে কায়দা হয়ে অথবা নকলা শহরের আগে গৌড়দা বাজার হয়ে নারায়নখোলা বাজার হয়ে সিএনজি অথবা ব্যাটারি চালিত অটোরিক্সায় চন্দ্রকোনা বাজারে পৌছতে পারেন। ভাড়া খুব বেশী হবে না। জনপ্রতি ১০০ টাকায় নকলা থেকে চন্দ্রকোনা ঘুরে আসতে পারবেন। শেরপুর শহর থেকেই একই খরচ পড়বে।
এছাড়া নকলা-নালিতাবাড়ি বাইপাস সড়কের নকলা উপজেলার পাইসকা ব্রীজেও বেড়িয়ে আসতে পারেন। যদিও এখানে বর্ষা মওসুমে ভালো লাগবে তবুও প্রকৃতির একটু ভিন্নতা পাবেন এ ব্রীজে। নালিতাবাড়ি শহরের উপকন্ঠে রাবার ড্যাম এলাকায়ও যেতে পারেন বিকেলে অথবা রাতে। তবে রাবার ফুলিয়ে যখন পানি আটকে রাখা হয় তখন দেখতে বেশ ভালো লাগে। এছাড়া নালিতাবড়ির সীমান্ত সড়কের বুরুঙ্গা ব্রীজেও বেরিয়ে আসতে পারেন।
পুলিশ লাইন :
শেরপুর জেলা শহরের অষ্টমীতলা টাঙ্গাইল বাস টার্মিনাল সংলগ্ন শেরপুর পুলিশ লাইনটি সম্প্রতি মনমুগ্ধকর করে সাজানো হয়েছে। বিশেষ করে প্রবেশদ্বারের গেইটটি নান্দনিক শৈল্পিক কারুকাজে দৃষ্টিনন্দন করা হয়েছে। রাতের আলোর ঝলকানি দেখে সহজেই অনুমেয় করা যাবে আপনি কোন বড় শহরে রয়েছেন। মনে হবে বিদেশের কোন সড়কের পাশে বসেছেন। গেইট থেকে ভিতরে এগুলে হাতের বায়ে রয়েছে দৃষ্টিনন্দন কারুকাজের মসজিদ এবং ডানে রয়েছে সুদৃশ্য কাঁচে ঘেরা বিশ্রামাগার। মূল ভবনের দিকে ছুটে চলা রাস্তার দু’ধার নানা রঙের পাথর দিয়ে সাজানো সড়কের ফুটপাত। সান বাঁধানো পুকুরও রয়েছে একটি। এখানে গরমের সময় বসে থাকলে প্রকৃতির বাতাস না থাকলেও গায়ে প্রশান্তি আসবে। বর্তমানে গেইটের পাশেই চা-কফি খাওয়ার ব্যাবস্থা থকালেও ভাবিষ্যতে মিনি ক্যাফেটরিয়াম করার চিন্তা ভাবনা করছে কর্তৃপক্ষ। এখানেই ক্যামেরা ছাড়া যাওয়া হবে বোকামী। তাই বন্ধুদের নিয়ে অথবা পরিবার পরিজন নিয়ে যে কোন সময় আপনার ব্যস্ততার ফাঁকে বেড়িয়ে আসুন পুলিশ লাইন গেইটে। শহরের থানা মোড় থেকে অষ্টমীতলা যেতে অটো রিক্সা ভাড়া মাত্র ৫ টাকা।
শেরী ব্রীজ :

Advertisements

পুলিশ লাইনের কাছেই মৃগি নদীর উপর নির্মিত ব্রীজে বিশেষ করে বর্ষা ও গীষ্ম কালে মানুষের ঢল নামে। শহরের নানা শব্দদুষন আর ঝঞ্জাট মুক্ত কিছুটা সময় কাটাতে শহরের নানা পেশার মানুষ আসে এখানে। কেউবা আসে বেড়াতে অবার কেউবা আসে আড্ডা দিতে। আপনিও আসতে পারেন বন্ধুদের নিয়ে আড্ডা দিতে অথবা প্রিয়জনকে নিয়ে বেড়াতে। এ ব্রীজ থেকে রাতের পূর্নিমার চাঁদ দেখতে বেশ মজা। বিশেষ করে শরতের আকাশ হলেতো কথাই নেই। আপনি যেন মেঘ চাঁদের খেলার সাথি বনে যাবেন। শহরের যে কোন স্থান থেকে ব্যাটারি চালিত অটো রিক্সা করে সেরী ব্রীজে আসতে পারেন। ভাড়া সর্বোচ্চ ১০ টাকা লাগবে। আর নিজের কার থাকলে তো কথাই নেই। সোজা ব্রীজে এসে গাঁ টা এলিয়ে দিয়ে ব্রীজ পাড় ছাড়ার সময় পাশের টং দোকানে এক কাপ চা খেয়ে নিলে মনটা আরো চাঙা হয়ে উঠবে।
ভাটারা ব্রীজ :

পুলিশ লাইনের একটু দক্ষিনে ভাটারা ঘাট সড়ক দিয়ে আধা কিলো পথ মড়ালেই একটি উচু ব্রীজ চোখে পড়বে। ব্রীজটির তেমন কোন বৈশিষ্ট নেই তবে ব্রীজটি একটু উচু হওয়ায় পরন্ত বিকেলে প্রাকৃতিক দৃশ্য মন শান্ত হয়ে যাবে। বিশেষ করে বর্ষায় পূর্নিমা রাতে এখানে এলে আপনি মোহিত হয়ে পরবেন। বর্ষায় ওই ব্রীজের চারপাশে পানিতে থৈ থৈ করে। ওই পানিতে পূর্নিমার চাঁদ যখন ঢেউ খেলবে আপনার মনও তখন নেচে উঠবে।
বহ্মপুত্র ব্রীজ :
শেরপুর সদর উপজেলার শেষ সীমানায় জামালপুর জেলার শহরের শুরুতে দুই জেলাকে একত্রিত করেছে পুরাতন বহ্মপুত্র নদের উপর নির্মিত বহ্মপুত্র ব্রীজ। এ ব্রীজে বর্ষা-গীষ্ম-শীত সব সময়ই মনমুগ্ধকর পরিবেশ বিরাজ করে। বিশেষ করে বিকেল এবং রাতে। ওই ব্রীজের উপর থেকে শুষ্ক মওসুমে নদীর বুক চিড়ে বিস্তৃর্ণ এলাকা বালুর স্তর পড়ায় দিগন্ত জড়ে ধু ধু বালুর চরের দৃশ্য সত্যি মনকে মুখোরিত করে দিবে। অপরদিকে বর্তমানের ভরা বর্ষায় উত্তাল নদীর বুকে থৈ থৈ পানি জোয়ার, ¯্রােত আর ঢেউ দেখতেও বেশ ভালো লাগবে। তবে বহ্মপুত্রের সেই দাপুটে অবস্থা এখন নেই। নেই পাল তোলা নৌকা, নদীর বুক চিড়ে জেলেদের জাল নিয়ে ছুটাছুটিও নেই। পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় বর্ষার সেই প্রমাত্ত অবস্থা না থাকলেও এ নদীর তীরে বা ওই ব্রীজের উপর উঠে দাড়িয়ে যারা ওই বহ্মপুত্রের আদি রূপ দেখেছেন তারা অনেকটা বিস্মৃত হবেন। মনে মনে ভাববেন এই কি সেই রাক্ষুসী বহ্মপুত্র, যে রাক্ষুসী গিলেছে শত শত মানুষের পেটের ভাত, জমিজমা আর স্বপ্ন। এসব কথা চিন্তা করতে করতে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামার সময় দেখবেন সূর্যাস্তের মনমুগ্ধকর দৃশ্য। আর পূর্নিমা হলে আরেকটু সময় থেকে গেলে দেখতে পাবেন রাতের চাঁদের দাপট। মাথা চাঁড়া দিয়ে ওঠা বীজ থেকে অংকুর থেকে যেভাবে বের হয় চাঁদও তেমনি পৃথিবীর সূর্যের আলোর অবর্তমানে চাঁদের কাছ থেকেই ধার করা আলো নিয়ে বরাই। ব্রীজের নিচে শেরপুর প্রান্তে নদী রক্ষা বাঁধের উপর বসে প্রিয়জনদের সঙ্গে জম্মেশ আড্ডাও দিতে পারেন গোধূলী লগ্ন পর্যন্ত। শরতের সময় নদীর দক্ষিন পাড়ে অর্থাৎ জামালপুর শহরের প্রান্তে সাদা সাদা কাশফুল আপনাকে হাতছানি দিয়ে ডাকবে।
এখানে যাওয়া খুবই সহজ। শেরপুর শহরের থানা মোড় থেকে জামালপুর ব্রীজে সারাদিনই সিএনজি অটোরিক্সা যাতায়াত করে। ভাড়া মাত্র ৩৫ টাকা। নিজস্ব গাড়ি বা মোটর সাইকেলে ২০ মিনিটেই পৌছে যাবেন ব্রীজে।

শেরপুর টাইমস/ বা.স