রবিবার , ১৯শে মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ || ৫ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ - গ্রীষ্মকাল || ১০ই জিলকদ, ১৪৪৫ হিজরি

বাংলা নববর্ষের অতীত ও বর্তমান

প্রকাশিত হয়েছে -

বাঙালির প্রাণের উৎসব পহেলা বৈশাখ বা বাংলা নববর্ষ। বাংলা নতুন বছর মানেই ষোল আনা বাঙালিপনায় বর্ষবরণ উৎসব। বৈশাখের উৎসব হয়ে উঠেছে বাঙালির ঐক্যের উৎসব। বাঙালির এই উৎসব মূলত বাঙালির ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও জাতি সত্তার প্রতীকী উপস্থাপনা। এই দিনটিতে বাংলাদেশের মানুষ বাঙালিত্বের মন্ত্রে দিক্ষিত হন আরো একবার। প্রকৃতির বিরুদ্ধে লড়াই করতে শিখিয়েছে যে বৈশাখ, সে বৈশাখেই বিভিন্ন সময়ে অন্যায় প্রতিরোধে দাঁড় করিয়েছে এই বাঙালিকে।

বাংলা নববর্ষের উৎপত্তি নিয়ে বিভিন্ন মত পাওয়া যায়। প্রথম মত অনুযায়ী প্রাচীন বাংলায় (গৌড়) রাজা শশাঙ্ক (রাজত্বকাল আনুমানিক ৫৯০-৬২৫ খ্রিষ্টাব্দ) বঙ্গাব্দ চালু করেছিলেন। সপ্তম শতাব্দীর শুরুর দিকে শশাঙ্ক ছিলেন বাংলার রাজচক্রবর্তী রাজা। আধুনিক ভারতের বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার অধিকাংশ এলাকা ছিল তার সাম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত। অনুমান করা হয়ে যে, জুলিয়ান ক্যালেন্ডারের সোমবার ১২ এপ্রিল ৫৯৪ এবং গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের সোমবার ১৪ এপ্রিল ৫৯৪ বঙ্গাব্দের সূচনা হয়েছিল।

দ্বিতীয় মত অনুসারে, ভারতের ইসলামী শাসনামলে হিজরী পঞ্জিকা অনুসারেই সকল কাজকর্ম পরিচালিত হতো। ভারতের সুলতানদের পর এই ধারাবাহিকতা মোঘল শাসনামলের প্রথমদিক পর্যন্ত বজায় ছিল। এর প্রমাণ পাওয়া যায়, সম্রাট আকবরের সভাসদ এবং ঐতিহাসিক আবুল ফজলের “আকবরের নামা”তেও।

Advertisements

সম্রাট আকবরের আমলে প্রতিমাসের ৩০/৩১ দিন, প্রতিটি দিনের আলাদা আলাদা করে নাম ছিল। এতসব দিনের নাম সাধারন মানুষের মনে রাখা সহজসাধ্য ছিল না। সম্রাট আকবরের পৌত্র সম্রাট শাহজাহান পরে বঙ্গাব্দ সংস্করণ করেন। ধারনা করা হয় কোন এক পর্তুগীজ জ্যোর্তিবিদের সহায়তায় পশ্চিমের পঞ্জিকা অনুসারে সম্রাট শাহজাহান মাসের ৩০/৩১ নাম বিলুপ্ত করে ৭ দিনে এক সপ্তাহ এবং সাত দিনের নাম রবি, সোম, মঙ্গল, বুধ, বৃহস্পতি, শুক্র ও শনিবারের প্রচলন করেন।

বঙ্গাব্দ বা ফসলী সাল প্রবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তখন প্রচলিত স্থানীয় চন্দ্রমাসগুলোকে সৌরমাসে পরিণত করা হয়। ফলে বৈশাখ, জৈষ্ঠ্য, আষাঢ়, শ্রাবণ প্রভৃতি নামে বঙ্গাব্দের বিভিন্ন মাসের নামকরণ করা হয়। তবে সেটা স্থানীয়দের সুবিধার জন্য। খাতাপত্রে স্থান পেতো তারিখ-ই-এলাহি সালের ফার্সি ভাষার মাসগুলো। আবার এই আকবরের সময়কাল থেকেই পহেলা বৈশাখ উদযাপন শুরু হয়। তখন প্রত্যেককে চৈত্রমাসের শেষদিনের মধ্যে সকল খাজনা, মাশুল ও শুল্ক পরিশোধ করতে হতো। আর এর পরের দিন পহেলা বৈশাখে ভ’মির মালিকরা নিজ নিজ অঞ্চলের অধিবাসীদের মিষ্টি দিয়ে আপ্যায়ন করতেন। এ উপলক্ষে বিভিন্ন উৎসবের আয়োজন করা হতো। যা পরে সামাজিক অনুষ্ঠানে পরিণত হয়। বিভিন্ন সময়ে এসব অনুষ্ঠানে এসেছে পরিবর্তন।

আমাদের নববর্ষের সঙ্গে জড়িয়ে আছে “হালখাতা” যেটির ঐতিহ্য এতবছর পরও অটুট রয়েছে। হালখাতা বলতে একটি নতুন হিসাব বই বোঝানো হয়। এতে বাংলা সালের প্রথম দিনের দোকানপাটের হিসাব আনুষ্ঠানিকভাবে হালনাগাদ করা হয়। গ্রাম-শহর বা বাণিজ্যিক এলাকার সব জায়গাতেই পুরোনো হিসেবের বই বন্ধ করে নতুন হিসাব বই খোলা হয়। প্রধানত ব্যবসায়ী মহল এটি পালন করে থাকেন।

আধুনিক বাংলা নববর্ষ উদযাপনের খবর প্রথম লিখিত তথ্য পাওয়া যায় ১৯১৭ সালে। প্রথম মহাযুদ্ধে ব্রিটিশদের বিজয় কামনা করে সে বছর পহেলা বৈশাখে কীর্তন ও পূজার ব্যবস্থা করা হয়। এসময় ১৯৩৮ সালের অনুরূপ উদযাপনের কথা জানা যায়। আইয়ুব আমলে রবীন্দ্র সংগীত ও বাঙালী সংস্কৃতির ওপর আক্রমণ আসে। আর এর প্রতিবাদস্বরুপ সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানট ১৯৬৭ সালে পহেলা বৈশাখে নববর্ষ পালন উপলক্ষে রমনার বটমূলে রবীন্দ্র সংগীতের আয়োজন করে। ছায়ানটের শিল্পীরা সম্মিলিত কণ্ঠে গানের মাধ্যমে নতুন বছরের সূর্যকে আহবান করে। সেই থেকে শুরু। আর এখনতো ছায়ানটের এ আযোজনকে ছড়িয়ে গেছে সারা দেশে।

নতুন আশা, স্বপ্ন আর প্রাণ শক্তিতে জাগরণের ডাক শোনা যাচ্ছে দিকে দিকে। নতুনের কেতন ওড়ানো বৈশাখ এসেছে নতুন সম্ভাবনার প্রতিশ্রুতি নিয়ে। প্রাণে বাজে তাই “ওই নতুনের কেতন ওড়ে”। হিংসা, দ্বেষ, পশ্চাৎপদতার নিগড় ভেঙে আমরা আহবান জানাই “এসো বৈশাখ এসো এসো হে”।

(লেখক:-সম্পাদক, শেরপুর টাইমস ডটকম।)