সোমবার , ১৭ই জুন, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ || ৩রা আষাঢ়, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ - বর্ষাকাল || ১০ই জিলহজ, ১৪৪৫ হিজরি

আজ শেরপুর ও নালিতাবাড়ী পাক হানাদার মুক্ত দিবস

প্রকাশিত হয়েছে -

আজ ৭ ডিসেম্বর শেরপুর সদর ও নালিতাবাড়ী উপজেলা পাক হানাদার মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে পাক হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে মিত্রবাহিনীর সহায়তায় মুক্তিযোদ্ধারা শেরপুর অঞ্চলকে শত্রুমুক্ত করে। এ দিন মিত্রবাহিনীর সর্বাধিনায়ক প্রয়াত জগজিৎ সিং অরোরা শেরপুর শহীদ দারোগ আলী পৌরপার্ক মাঠে এক সংবর্ধনা সভায় শেরপুরকে শত্রুমুক্ত বলে ঘোষণা দেন। এ সংবর্ধনা সভায় মুক্ত শেরপুরে প্রথম বাংলাদেশের প্রথম পতাকা উত্তোলন করা হয়। স্বাধীনতা যুদ্ধের দীর্ঘ নয় মাসে বর্তমান শেরপুর জেলার পাঁচটি উপজেলায় ৩০-৪০ টি খন্ডযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। এসব যুদ্ধে বিরত্ত্বের সঙ্গে লড়াই করে ৫৯ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। পাক হানাদারদের নির্মমতার শিকার হয়ে নালিতাবাড়ী উপজেলার সোহাগপুর গ্রামে ১৮৭ জন, শেরপুর সদর উপজেলার সূর্যদী গ্রামে ৩৯ জন এবং ঝিনাইগাতী উপজেলার জগৎপুর গ্রামে ৪১ জনসহ মুক্তিকামী বহু মানুষ শহীদ হন।

১৯৭১ এর ২৬ এপ্রিল পাক হানাদার বাহিনী ব্যাপক শেলিংয়ের মাধ্যমে শেরপুর শহরে প্রবেশ করে বিভিন্নস্থানে গড়ে তুলে ঘাটি। শেরপুর জেলার সীমান্তবর্তী ঝিনাইগাতী উপজেলার আহম্মদনগর উচ্চবিদ্যালয়সহ বিভিন্নস্থানে গড়ে তোলা ঘাটিতে  চলে তাদের  নারকীয় হত্যাযজ্ঞ। এসব ঘাটিতে রাজাকার, আলবদর আর দালালদের যোগসাজসে হানাদাররা চালাতে থাকে নরহত্যা, ধর্ষণ, লুটপাটের নৃশংস ঘটনা। অন্যদিকে স্বল্প সময়ের প্রশিক্ষণ নিয়ে বাঙালির শ্রেষ্ঠ সন্তান মুক্তিযোদ্ধারা আঘাত হানতে থেকে শত্রু শিবিরে।

শেরপুর মুক্ত হওয়ার আগে পাক হানাদারদের সঙ্গে যুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিল এমন উলে­খযোগ্য কয়েকটি স্থান হলো- শেরপুর কাটাখালি ধ্বংসের পরে রাঙামাটি গ্রাম, সূর্যদী, নালিতাবাড়ী, ফরেষ্ট ক্যাম্প, তন্তর, বারোমারী, নন্নী, ঝিনাইগাতী, নাচনমহুরী, নকশী, শ্রীবরদী, কর্ণঝোরা, কামালপুর, টিকারকান্দা, নারায়নখোলা, বড়ইতার, নকলা উল্লেখযোগ্য। নভেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহ থেকেই এ জেলায় শত্রু সেনাদের পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যেতে থাকে। ১১ নং সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারাই ঢাকায় প্রথম প্রবেশ করে। ১১ নং সেক্টর কমান্ডার কর্ণেল তাহের বেশ কয়েকবার কামালপুর দুর্গে আক্রমণ চালান। কিন্তু শক্ত ঘাটি হওয়ায় পাক সেনাকে টলাতে পারেননি। অবশেষে চুড়ান্ত যুদ্ধের পরিকল্পনা নেওয়া হয় ১৮ নভেম্বর। পরিকল্পনা অনুসারে ২ নভেম্বর রাতে অবরোধের মাধ্যমে চুড়ান্ত আঘাত হানা হয় কামালপুর ঘাটিতে। ১১ দিন অবরোধ থাকার পর ৪ ডিসেম্বর এ ঘাটির পতনহ য়। মোট ২২০ জন পাক সেনা এবং বিপুল সংখ্যক রেঞ্জার, মিলিশিয়া ও রাজাকার সদস্য বিপুল অস্ত্রসহ আত্মসমর্পন করে। কামালপুর মুক্ত হওয়ার পর হানাদার বাহিনীর মনোবল ভেঙ্গে পড়ে।

Advertisements

অপরদিকে, মুক্তিযোদ্ধারা মিত্র বাহিনীর সহায়তায় শেরপুরে হানাদার বাহিনীর বিভিন্ন ক্যাম্পে আক্রমণ চালায়। কামালপুর দুর্গ দখল হওয়ার প্রায় ৪৮ ঘন্টার মধ্যে পাক বাহিনীর সকল ক্যাম্প ধ্বংস হয়ে যায়। ৪ ডিসেম্বর কামালপুরের ১১ নং সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের মুর্হুমুহু আক্রমান ও গুলি বর্ষনের মুখে স্থানীয় পাকসেনারা পিছু হটে। ৩ ডিসেম্বর শ্রীবরদী, নালিতাবাড়ী ও ঝিনাইগাতী সীমান্ত ঘাটিতে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর যৌথ আক্রমণে হানাদাররা দিশেহারা হয়ে পড়ে। তারা তাদের ঘাটিগুলোতে রাজাকার আলবদরদের রেখে দ্রুত পিছু হটতে থাকে জামালপুরের দিকে। তাই অনেকটা বিনে বাধায় ঝিনাইগাতী উপজেলা ৪ ডিসেম্বর এবং শ্রীবরদী উপজেলা ৬ ডিসেম্বর শত্রু মুক্ত হয়। নালিতাবাড়ীতে টানা দু’দিন যুদ্ধের পর বীর মুক্তিযোদ্ধারা

বিজয়ীর বেশে নালিতাবাড়ী ও শেরপুরে প্রবেশ করে। আরও একদিন পর ৮ ডিসেম্বর প্রবেশ করে নকলায়। ৫ ডিসেম্বর থেকে পাকসেনারা তল্পিতল্পা বেঁধে কামালপুর-বক্সিগঞ্জ থেকে শেরপুরের শ্রীরবদী উপজেলা হয়ে শেরপুর শহর দিয়ে জামালপুর অভিমুখে রওনা হন। অবশেষে পাকসেনারা ৬ ডিসেম্বর রাতের আধারেব্র হ্মপুত্র নদ পাড়ি দিয়ে জামালপুর পিটিআই ক্যাম্পে আশ্রয় নেন। এরপর ৭ ডিসেম্বর মুক্ত হয় শেরপুর। পতপত করে উড়তে থাকে লাল সবুজের পতাকা।

—নালিতাবাড়ী—

৭ ডিসেম্বর শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলা পাক হানাদার মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে বীর মুক্তিযোদ্ধারা নিজেদের জীবনকে বাজী রেখে পাকহানাদার বাহিনীদের পরাস্ত করে নালিতাবাড়ীকে দখল মুক্ত করেন।

শেরপুরের সীমান্তবর্তী গুরুত্বপুর্ণ জনপদ নালিতাবাড়ীতে দুইদিন দুইরাত সরাসরি যুদ্ধের পর মুক্তির এইদিনটি এলাকার মানুষের স্মৃতিতে ভাস্বর হয়ে আছে আজও। এদিন পাকহানাদার বাহিনী বর্তমান উপজেলা পরিষদ, রামচন্দ্রকুড়া ফরেষ্ট অফিস, হাতিপাগার বিডিআর ক্যাম্প তিনআনী ও ঝিনাইগাতির আহাম্মদ নগরে শক্তিশালী ক্যাম্প স্থাপন করে। দীর্ঘ ৯ মাসে নাকুগাঁও (বর্তমান নাকুগাঁও স্থলবন্দর) ঢালু সীমান্তে ২৫ মে ভোরে পাকিস্তানী হায়েনার দল অতর্কিত হামলা চালিয়ে ৯ জন ভারতীয় বিএসএফসহ কয়েকশ বাংলাদেশীকে হত্যা করে ভোগাই নদীতে ভাসিয়ে দেয়। ৩০ জুন তন্তর গ্রামের ৭ জনকে হত্যা করে। এদিন মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করার অপরাধে বাড়ী থেকে ধরে নিয়ে অর্ধশতাধিক মানষকে নির্মমভাবে হত্যা করে পাকহানাদার বাহিনী। নন্নী-বারোমারী সড়কে একজন ক্যাপটেনসহ ৬ জন সৈন্য জীপ দিয়ে যাওয়ার সময় মাইন বিস্ফোরনে পাকবাহিনী আতংকিত হয়ে পড়ে। শেষে কৌশল পরিবর্তন করে নালিতাবাড়ী থানা সদরে রাজাকার আল বদরদের সহায়তায় শক্ত ঘাঁটি স্থাপন করে।

২৫ জুলাই উপজেলার কাকরকান্দি ইউনিয়নের সোহাগপুর গ্রামে হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে ১৮৭ জন নারীপুরুষ শিশু সহ নিরীহ গ্রামবাসীকে হত্যা করে। ১ ডিসেম্বর এই ঘাঁটি থেকে শত্রু মুক্ত করার জন্য মুক্তিযোদ্ধারা অভিযান চালালেও সফল হতে পারেনি। বরং হাছেন আলী মুন্সি, আয়াত আলী নামে দুজন মুক্তিযোদ্ধা শাহাদত বরন করেন। রাজাকার আলবদররা এই দুই বীরের মৃত দেহ নিয়ে পৈশাচিক উল্লাসে মেতে উঠে। তাদের পায়ে রশি বেধে টেনে হিচরে শহরের অদুরে মাটি চাপা দেয়। ৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যার পর থেকে পুণরায় ক্যাম্প দখলের লড়াই শুরু হয়। এ লড়াইয়ে মিত্রবাহিনীর একটি ও মুক্তিযোদ্ধাদের দুটি দল অংশ গ্রহন করে। টানা দুইদিন দুইরাত গুলিবর্ষনের পর ৬ ডিসেম্বর মিত্রবাহিনীর জঙ্গী বিমান দিয়ে বোম্বিং করার পরিকল্পনা করে। এতে জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির কথা চিন্তা করে সে পরিকল্পনা বাদ দেওয়া হয়। এদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের গোলাবারুদ ফুরিয়ে যাওয়ায় তারা আক্রমন শিথিল করে দেয়। এসময় ক্যাম্পের আলবদর, রাজাকাররা পালিয়ে যায়। সারা রাত কোন সাড়া শব্দ নেই আতংকগ্রস্থ এলাবাসী অপেক্ষা করতে থাকেন কখন ভোর হবে।

অবশেষে ৭ ডিসেম্বর পূর্বদিগন্তে সূর্যের লাল আভা ছড়িয়ে পড়লে মুক্তিযোদ্ধারা জয়বাংলা, জয়বাংলা স্লোগানে মুখরিত করতে করতে এলাকায় ঢুকতে থাকে, ক্রমেই স্লোগানের আওয়াজ স্পষ্ট হয় কেটে যায় শংকা। মুক্তিযোদ্ধাদের কন্ঠে কন্ঠ মিলিয়ে মুক্তির উল্লাসে মেতে উঠে সবাই। মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীরা এগিয়ে যায় সামনের দিকে পিছু হটে হানাদার বাহিনী শত্রুমুক্ত হয় নালিতাবাড়ী। লাল সবুজের পতাকায় স্বাধীন হয় প্রিয় বাংলাদেশ।