সোমবার , ২০শে মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ || ৬ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ - গ্রীষ্মকাল || ১১ই জিলকদ, ১৪৪৫ হিজরি

শেরপুর সীমান্তে ছড়িয়ে পড়েছে ‘কাসাভা চাষ’

প্রকাশিত হয়েছে -

জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব মোকাবেলায় পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে শেরপুরের পাহাড়ি জনপদে ক্রমেই জনপ্রিয় হচ্ছে ‘কাসাভা চাষ’। স্থানীয় ভাষায় শিমলা আলু নামে পরিচিত। অল্প পরিশ্রমে এবং খরা সহনশীল জমিতে আবাদ করা যায়। আলু জাতীয় গোত্রের কাসাভা খাবার ও পুষ্টির চাহিদাও মেটায়। এতে প্রচুর শর্করা রয়েছে। তাছাড়া কাসাভা আবাদে খরচ কম, বাজারে এর চাহিদাও বেশ ভালো। ফলে পাহাড়ের আদিবাসী-বাঙালি অধিবাসী, বিশেষ করে আদিবাসীরা দিন দিন কাসাভা চাষে আগ্রহী হয়ে উঠছেন।

জানা গেছে, একসময় জেলার সীমান্তবর্তী নালিতাবাড়ী, ঝিনাইগাতী ও শ্রীবরদী উপজেলার পাহাড়ি জনপদের আদিবাসী পরিবারগুলোর বাড়ির আঙ্গিনায় এমনকি মাঠ ফসল হিসেবে কাসাভা চাষ করা হতো। বর্তমানে এর প্রচুর লাভ ও অনেকটা খরচ বিহীন সহজ আবাদের কারণে পরিত্যক্ত জমি এবং পাহাড়ের ঢালে এ আবাদ করা হচ্ছে।

পাহাড়ি পরিবারগুলো জানায়, এসব শিমলা আলু বা কাসাভা কাঁচা খাওয়া যায় এবং সব্জী হিসেবে রান্না করেও খাওয়া যায়। এগুলো খুবই পুষ্টিকর এবং সুস্বাদু। বাজারে এর খুবই চাহিদা। কাসাভা খাবারের পাশপাশি বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানি’র, গ্লক্লোজ, চিপস এবং বার্লি’র কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়ে থাকে।

Advertisements

জেলার শ্রীবরদী উপজেলার কর্ণঝোড়া গ্রামের কৃষক জলিল মিয়া, সবুর আলী, হাসেন আলীসহ অনেকে জানায়, প্রতি একর জমিতে কাসাভা রোপন করতে এবং উত্তোলন করতে কৃষকের শ্রমিক খরচ হয় প্রায় ৬ হাজার টাকা। প্রতি একর জমিতে কাসাভা আলুর ফলন পাওয়া যায় ১৫০ থেকে ২০০ মণ। যা বাজারে প্রতিমণ পাইকারি বিক্রি হচ্ছে ৬০০ টাকা দরে। আর পাইকাররা ক্ষেত থেকে ৫৫০ টাকা মণ দরে কিনে আনছে। পরে তারা ১৫ টাকা কেজি দরে কিনে শেরপুরের বাজারে ২০ থেকে ২৫ টাকা দরে এবং ঢাকা সহ অন্য জেলার বাজারে ৪০ থেকে ৫০ টাকা দরে বিক্রি করছে। এ হিসাবে কৃষক আয় করছে প্রতি একরে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা।

ঝিনাইগাতী উপজেলার পাহাড়ি অঞ্চলের বাসিন্দা আজিম মারাক, রবিন্দ্র মং, নগেন্দ্র সাংমাসহ অনেকে বলেন, কাসাভা বছরের যে কোন সময় রোপন করা যায়। তবে সাধারণত বর্ষার শুরুতে কাসাভার কাটিং লাগানো ভালো। আমাদের দেশে এপ্রিল থেকে মে মাসে কাসাভা লাগানোর সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। এতে তেমন কোনো সার প্রয়োগ করতে হয় না। তবে বাণিজ্যিকভাবে চাষের জন্য হেক্টর প্রতি ১৮০-২০০ কেজি নাইট্রোজেন, ১৫-২২কেজি ফসফরাস ও ১৪০-১৬০কেজি পটাসিয়াম প্রয়োগ করলে সর্বাধিক ফলন পাওয়া যায়। কাসাভা চাষে সাধারণত সেচের প্রয়োজন হয় না। দীর্ঘদিন খরা অবস্থা বিরাজ করলে হালকা সেচের ব্যবস্থা করা হলে ফলন বৃদ্ধি পায়। চারা গজানোর পর ৩মাস অন্তর গোড়ার আগাছা পরিষ্কার করে গোড়ায় মাটি তুলে দিলে ফলন ব্যাপক বৃদ্ধি পায়।

কৃষি বিশেষজ্ঞরা জানান, আফ্রিকার অনেক দেশের প্রধান খাদ্য কাসাভা সম্প্রতি বাংলাদেশেও বাণিজ্যিক ভাবে চাষ হচ্ছে। কাসাভা উচ্চ কার্বোহাইড্রেড সমৃদ্ধ খাবার। ভাত এবং রুটির বিকল্প খাদ্য হিসেবে এর জুড়ি নেই। তা ছাড়া পাহাড়ি জনপদে যেখানে সেচ সংকটের কারণে বিভিন্ন ফসল চাষ করা ব্যয়বহুল, সেসব এলাকায় খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কাসাভা খুবই সম্ভাবনাময় ফসল। বিগত প্রায় ৫ বছর পূর্বে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর শেরপুরের নালিতাবাড়ী ও ঝিনাইগাতী উপজেলার পাহাড়ি জনপদে ‘ডিজাস্টার অ্যান্ড ক্লাইমেট রিস্ক ম্যানেজমেন্ট ইন এগ্রিকালচার’ প্রকল্পের আওতায় কৃষক পর্যায়ে কাসাভা চাষ জনপ্রিয় করতে বিশেষ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হয়। সেসময় ওই এলকায় স্থাপন করা হয়েছিল প্রদর্শনী প্লট। এ থেকে স্থানীয় কৃষকদের কাসাভা চাষে ব্যপক ভাবে উদ্বুদ্ধ করা হয়। যদিও ওই প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। তবুও স্থানীয় কৃষকদের মাঝে দিন দিন কাসাভা চাষ বাড়ছে।

শেরপুর খামারবাড়ীর সূত্রে জানা গেছে, প্রায় ১৫ বছর পূর্বে জেলার ঝিনাইগাতী উপজেলার পাহাড়ি এলাকায় প্রথম কাসাভার আবাদ শুরু হয়। সে সময় উৎপাদিত কাসাভা ‘রহমান অ্যান্ড রহমান কোং’ নামে ঢাকার একটি গ্লুকোজ কোম্পানি কিনে নেয়। কিন্তু পরবর্তিতে ওই কোম্পানি অজ্ঞাত কারণে তাদের অস্থায়ী অফিস গুটিয়ে নেয়ার পর স্থানীয় কৃষক কাসাভা চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। জেলার সীমান্ত এলাকার পাহাড় ও টিলা এবং শুষ্ক অঞ্চল যেখানে অন্য কোনো ফসল করা যায় না বা পরিত্যাক্ত জমিতে সেখানে কাসাভার চাষ সম্ভাবনার এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে। ফসল বহুমুখীকরণ, মঙ্গা মোকাবেলা এবং পতিত জমিগুলো ফসল চাষের আওতায় নিয়ে আসার জন্য কাসাভা একটি লাগসই ফসল। প্রতি বছর আমাদের দেশের ওষুধ শিল্পসহ অন্যান্য শিল্প-কারখানায় প্রচুর পরিমাণে স্টার্চ ও সুক্রোজ প্রয়োজন হয়, যা সাধারণত বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়। দেশের পতিত এলাকাগুলো লিজ ভিত্তিতে সহজে কাসাভা চাষের আওতায় নিয়ে এসে স্টার্চের এ চাহিদা পূরণ করা সম্ভব।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক আজিজল হক খোলা কাগজকে জানান, জলবায়ুর প্রভাব মোকাবিলায় খাপ খাওয়ানো এবং পাহাড়ি জনপদে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কাসাভা চাষ জনপ্রিয় করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এজন্য বেশ কিছু প্রদর্শনী প্লট স্থাপন করে কৃষকদের ব্যাপক ভাবে আগ্রহ সৃষ্টি করা হচ্ছে। জেলায় আরো ব্যাপক আকারে কাসাভা চাষ করা হলে দেশের অনেক খ্যাতিমান ফুড, ফিড ও ওষুধ কোম্পানিগুলোর কাসাভার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হবে।