সোমবার , ২০শে মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ || ৬ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ - গ্রীষ্মকাল || ১১ই জিলকদ, ১৪৪৫ হিজরি

শেরপুরের রংমহল ও শীষ মহলে নেই বিলাসিতার রঙ

প্রকাশিত হয়েছে -

ভবনগুলো দৃষ্টিনন্দন ও কারুকার্যখচিত। উত্তর-দক্ষিণে প্রলম্বিত রংমহলের তিন অংশ। প্রথমাংশে জমিদারদের খাস দরবার কক্ষ ও জলসা ঘর। দ্বিতীয়াংশে জমিদারদের খাস কামরা। তৃতীয়াংশ নায়েব-ম্যানেজারের কাচারি হিসেবে ব্যবহৃত হতো। রংমহলের প্রবেশপথের দরজা দুটি। ডানদিকের দরজা বরাবর টানা লম্বা করিডোর। করিডোর ও ভেতরের অর্ধেক দেয়ালজুড়ে বিরাজ করছে রঙিন চিনাপাথরের ফ্রেসকো ও ফুল লতাপাতা আঁকা টালি বসানো। পাকা বৈঠকখানা, শান বাঁধানো ঘাট, মাঠ ও মন্দির। কবির ভাষায় ‘আজি হতে শতবর্ষ পরে কে মোর কবিতাখানি’র মতো শতবর্ষ পরও সেগুলোর ঔজ্জ্বল্য আজও চির যৌবন, চির উজ্জ্বল ঐতিহ্যের রংমহল ও শীষ মহলের মালিক ছিলেন জমিদার সত্যেন্দ্র মোহন চৌধুরী ও জ্ঞানেন্দ্র মোহন চৌধুরী।

জানা যায়, জমিদারবাড়ির ঠিক দক্ষিণ-পূর্ব কোণে অবস্থিত রংমহল। চমৎকার বাড়িটি দেখলেই বোঝা যায় জমিদার কেমন সংস্কৃতিপ্রিয় ছিলেন। নাচ-গানসহ অন্যান্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এখানেই হতো। রংমহলের ডানদিক ঘেঁষে শান বাঁধানো পুুকুর। জলে জলসা ঘর প্রতিবিম্বিত হয়। সেই আমলে রংমহলের দীর্ঘ করিডোর ধরে প্রতিটি কক্ষে ঢোকার দরজার পাশে ছিল পিতল ও পাথরের নানা ধরনের মূর্তি আর বিরাট আকারের ফুলদানি।

শেরপুরের ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন স্থাপত্য নিদর্শন তিনআনী জমিদারদের রংমহল এটি। উনিশ শতকের গোড়ার দিকে পোঁনে তিনআনী জমিদার কিশোরী মোহন চৌধুরীর আমলে রংমহল, শীষ মহলসহ নানা সৌধ নির্মাণ করা হয়। শেরপুরের জমিদারদের মধ্যে পৌনে তিনআনী জমিদার পরিবার শিক্ষিত ও সংস্কৃতিমনা ছিল। ছিল তাদের জয় কিশোর লাইব্রেরি ভবন।

Advertisements

কূল দেবতা অন্নপূর্ণা-গোপীনাথের অপরূপ সুন্দর মন্দির যার মাঝে রয়েছে প্রাচ্য, পাশ্চাত্য ও মুসলিম স্থাপত্যরীতির অপূর্ব সুসমন্বয়। লাইব্রেরিতে ছিল পাঁচ সহস্রাধিক বই। অধিকাংশই বিজ্ঞানবিষয়ক। এখন আর নেই আগে মতো কিছুই। এখন নেই বিচারালয়ের ঘণ্টাধ্বনি, জলসা ঘরের গমগম লহরি, পায়েলের জমজম সুর ঝংকার, নূপুরের নিক্কন, মায়াবী অট্টহাসির ধ্বনি-প্রতিধ্বনি।

সন্ধ্যার ঝলমলে আলোকসজ্জায় উলুধ্বনিতে যে বাড়ি এক সময় মুখরিত হতো, সেই বাড়িতে ভুল করেও কেউ উলুধ্বনি দেয় না। কেউ আলো জ্বালায় না। বাজে না সন্ধ্যা পূজার ঘণ্টাধ্বনি। নেই সাধারণ কৃষক প্রজার খবর নেওয়ার তাড়না। ছুটে আসে না নাজির। ফরমান জারি করেন না এখন। এখন শুধু দাঁড়িয়ে আছে কিছু স্তম্ভ। তবুও নড়বড়ে।

পরের আধুনিক ইতিহাসে জমিদার বাড়িটিকে কৃষি প্রশিক্ষাণালয়ে রূপান্তরিত করা হলে লাইব্রেরি ভবনটি ভেঙে সেখানে টিনশেডের শ্রেণিকক্ষ নির্মাণ করা হয়। রংমহলটি এক সময় কৃষি প্রশিক্ষাণালয়ের প্রশাসনিক ভবন হিসেবে ব্যবহার হলেও এখন তা আর ব্যবহার হচ্ছে না। কেননা, জমিদারি বিলাসিতার রংমহলের দিন ফুরিয়ে গেছে। তবে ভবনটি এতই জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে যে, সামান্য বৃষ্টিতেই এর ছাদ চুইয়ে পানি পড়ে। স্থানে স্থানে সুরকির গাঁথুনি নড়বড়ে। পলেস্তারা খুলে পড়ে যখন তখন। কালের বিবর্তনে জমিদারদের এসব প্রাচীন ভাস্কর্যশিল্পের অনন্য নিদর্শন ধ্বংসের মুখোমুখি অবস্থায় কালের সাক্ষী হয়ে আজও পর্যটকদের দৃষ্টি কাড়ে।

সম্প্রতি সরেজমিন দেখা যায়, চারপাশে গাইড ওয়াল করা। ভেতরে রংমহল। কিন্তু গাইড ওয়ালের পরই ময়লা-আর্বজনা ও গাছের লতাপাতা দেখে মনে হবে এটি একটি জঙ্গল। নেই পরিষ্কার করার লোক। অথচ ৬ থেকে ৭ বছর আগেও এ রংমহল ভবনে অধ্যক্ষ ও অন্যান্য বিভাগের অফিস কক্ষ ছিল। কিন্তু ভবনটি জরাজীর্ণ হয়ে বিভিন্ন স্থান দিয়ে পানি পড়ায় এবং নতুন প্রশাসনিক ভবন তৈরি হওয়ায় ‘রংমহল ও শীষ মহল’ ভবন থেকে অফিস স্থানান্তরিত করা হয়। বর্তমানে রংমহলটি গোডাউন হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।

জনউদ্যোগের আহ্বায়ক আবুল কালাম আজাদ বলেন, শেরপুরের এসব ঐতিহ্যগুলো রক্ষা করা আমাদের খুবই দরকার। কেননা, আমাদের প্রাচীন ইতিহাস সমৃদ্ধ স্থাপনাগুলো রক্ষা না করতে পারলে অচিরেই হারিয়ে যাবে। আমি প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগের কাছে অনুরোধ জানাই।