রবিবার , ১৯শে মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ || ৫ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ - গ্রীষ্মকাল || ১০ই জিলকদ, ১৪৪৫ হিজরি

শেরপুর থেকে শুরু করে বিশ্ব রেকর্ড ভাঙলেন ক্ষিতীন্দ্র

প্রকাশিত হয়েছে -

বিশ্ব রেকর্ড গড়ার একক সাঁতারে ৬০ ঘণ্টায় ১৮৫ কিলোমিটার নদীপথ পাড়ি দিয়েছেন নেত্রকোনার মদন উপজেলার সাঁতারু মুক্তিযোদ্ধা ক্ষিতীন্দ্র চন্দ্র বৈশ্য (৬৭)। বর্তমানে তিনি সুস্থ স্বাভাবিক রয়েছেন। তিনি ১৭৭ কিলোমিটার দূরপাল্লার একক সাঁতারের বিশ্ব রেকর্ড অতিক্রম করলেন।

বুধবার (৫ সেপ্টেম্বর) রাত পৌনে ৮টায় নেত্রকোনার মদনের মগড়া নদীর দেওয়ান বাজার ঘাটে হাজার-হাজার মানুষের উপস্থিতিতে সাঁতরে পাড়ে ওঠেন তিনি। ৬০ ঘণ্টায় নির্দিষ্ট গন্তব্যে সফলভাবে পৌঁছান ক্ষিতীন্দ্র। এ সময় তিনি সুস্থ ও স্বাভাবিক রয়েছেন বলে মোবাইল ফোনে জানিয়েছেন তার ছোট ভাই, বিমান বৈশ্য।

বিশ্ব রেকর্ড গড়ার লক্ষ্যে ক্ষিতীন্দ্র গত ৩ সেপ্টেম্বর (সোমবার) সকাল ৭টায় শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার ভোগাই নদীর পৌর শহরের ভোগাই ব্রিজের কাছ থেকে সাঁতার শুরু করেন। তার সাঁতরে নেত্রকোনায় আসার পথে নদীর বিভিন্ন ঘাটে ও সড়কের আনাচে-কানাচে হাজার হাজার উৎসুক মানুষ অপেক্ষা করতে থাকেন। তাকে দেখা মাত্র উৎসুক নারী-পুরুষ ও তরুণ-তরুণীরা করতালি দিয়ে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানান।

Advertisements

ক্ষিতীন্দ্র সিলেটে ১৯৭০ সালে ধুপাদীঘি পুকুরে অরুণ কুমার নন্দীর ৩০ ঘণ্টার বিরতিহীন সাঁতার দেখে সাঁতারে উদ্বুদ্ধ হন। শুরু করেন সাঁতার অনুশীলন। পরে ওই বছর মদনের জাহাঙ্গীরপুর উন্নয়ন কেন্দ্রের পুকুরে একটানা ১৫ ঘণ্টা সাঁতরে স্থানীয়ভাবে ব্যাপক আলোচিত হন।

এরপর ১৯৭২ সালে সিলেটের রামকৃষ্ণ মিশন পুকুরে ৩৪ ঘণ্টা, সুনামগঞ্জের সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের পুকুরে ৪৩ ঘণ্টা, ১৯৭৩ সালে ছাতক উচ্চ বিদ্যালয়ের পুকুরে ৬০ ঘণ্টা, সিলেটের এমসি কলেজের পুকুরে ৮২ ঘণ্টা এবং ১৯৭৪ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের পুকুরে ৯৩ ঘণ্টা ১১ মিনিট সাঁতার প্রদর্শন করে জাতীয় রেকর্ড গড়েন ক্ষিতীন্দ্র। ওই দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ক্লাস বন্ধ ঘোষণা করা হয় এবং ডাকসুর উদ্যোগে ক্যাম্পাসে বিজয় মিছিল হয়।

এরপর ১৯৭৬ সালে তিনি জগন্নাথ হলের পুকুরে ১০৮ ঘণ্টা ৫ মিনিট সাঁতরে নিজের পুরনো রেকর্ড ভেঙে ফেলেন। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জগন্নাথ হলের পুকুর পাড়ে একটি স্মারক ফলক নির্মাণ করে।

এ ছাড়াও বিভিন্ন সময় ঢাকা স্টেডিয়ামের সুইমিংপুল, মদন উপজেলা পরিষদের পুকুর এবং নেত্রকোনা পৌরসভার বা আঞ্জুমান আদর্শ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের পুকুরে একাধিক সাঁতার প্রদর্শনীতে আলোচনায় আসেন তিনি।

দেশের বাইরে তিনি ভারতের দূরপাল্লার সাঁতার প্রদর্শনীতে অংশ নেন। ১৯৮০ সালে তিনি মাত্র ১২ ঘণ্টা ২৮ মিনিটে মুর্শিদাবাদের ভাগিরথী নদীর জঙ্গিপুর ঘাট থেকে গোদাবরী ঘাট পর্যন্ত ৭৪ কিলোমিটার নদীপথ পারি দেন।

সাঁতার কেটে এ পর্যন্ত জাতীয় পর্যায়ে চারটি পুরস্কার পেয়েছেন। সাঁতার প্রদর্শনী ও রেকর্ড গড়ার স্বীকৃতি হিসেবে অসংখ্য পুরস্কার-সম্মাননা পেয়েছেন তিনি। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গণভবনে তাকে রুপার নৌকা উপহার দেন।

৬৭ বছর বয়সী এই মুক্তিযুদ্ধা ১৮৫ কিলোমিটার দূরপাল্লার একক সাঁতারের মাধ্যমে আমেরিকার নাগরিক ডায়ানা নাঈদের ২০১৩ সালে কিউবা টু ফ্লোরিডা সাঁতারের ১৭৭ কিলোমিটার দূরপাল্লার সাঁতারের বিশ্ব রেকর্ড ভেঙে নতুন রেকর্ড করলেন। তিনি এখন গিনেস বুক রেকর্ডে তার নাম লিখাতে চান।

শেরপুরের নালিতাবাড়ী পৌরসভা ও নেত্রকোনার মদন উপজেলা নাগরিক কমিটি যৌথভাবে এ সাঁতারের আয়োজন করে।

দেশ জুড়ে এ সময়ের আলোচিত দূরপাল্লার একক সাঁতারু মুক্তিযোদ্ধা ক্ষিতীন্দ্র চন্দ্র বৈশ্য। নেত্রকোনা জেলার মদন উপজেলার জাহাঙ্গীরপুরের বাসিন্দা। ২৩ মে ১৯৫২ সালে জন্ম নেওয়া ক্ষিতীন্দ্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাঠ পর্ব চুকিয়েছেন। পরে ১৯৭১ সালে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই সংগ্রামে ১১ নম্বর সেক্টর থেকে অংশ নেন। কর্মজীবনে তিনি সরকারি-বেসরকারি চাকরি করেছেন। সর্ব শেষ বেসরকারি বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের এ এন এস কনসালটেন্ট হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন।

ঢাকায় বসবাসরত সংসার জীবনে রয়েছেন স্ত্রী, এক ছেলে এক মেয়ে। ১৯৭০ সালে সাঁতার প্রতিযোগিতা শুরুর ধারাবাহিকতা থেকেই ২০১৪ সাল পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন সাঁতার প্রতিযোগিতা ও প্রদর্শনীতে অংশ নেন ক্ষিতীন্দ্র। সেসব ক্ষেত্রে তিনি সম্মাননা ও পুরস্কার পান।

ছন্দ আর তালে সাঁতার কাটেন ক্ষিতীন্দ্র। এজন্য সাঁতারের পুরোটা সময় স্পিকারের উচ্চ স্বরে গান বাজাতে হয়। গানের পছন্দের তালিকায় থাকে মান্না দে, কিশোর কুমার, ভূপেন ও লতাসহ কালজয়ী অন্যান্য শিল্পীদের গান। এ দীর্ঘ সাঁতারের সময় তিনি ক্ষুধার প্রয়োজনে চা, বিশুদ্ধ পানি আর ফল-ফলাদি খেয়ে থাকেন।

মদন উপজেলা নাগরিক কমিটি আহ্বায়ক মুক্তিযোদ্ধা মোদাচ্ছের হোসেন বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, ৬৭ বছর বয়সী মুক্তিযোদ্ধা ক্ষিতীন্দ্র ১৮৫ কিলোমিটার দূরপাল্লার একক সাঁতারে সফলভাবে তার গন্তব্যে পৌঁছেন। দীর্ঘ ৬০ ঘণ্টা নদীর পানিতে থাকায় তাকে বর্তমানে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো হচ্ছে। এমনিতে তিনি সুস্থ ও ভাল রয়েছেন।

ক্ষিতীন্দ্র ১৮৫ কিলোমিটার একক সাঁতারে সফলভাবে তার লক্ষ্যে পৌঁছে সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন বলেও জানান মোদাচ্ছের।