মঙ্গলবার , ৭ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ || ২৪শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ - গ্রীষ্মকাল || ২৭শে শাওয়াল, ১৪৪৫ হিজরি

এএসপি আসলাম ,সার্জেন্ট আহাদ আমার ভাই

প্রকাশিত হয়েছে -

আলহাজ্ব এম এ হাকাম হীরা ::

অন্য সকল জায়গার মতো নালিতাবাড়ী শহরের আমবাগান মহল্লার পুরাতন কাজীবাড়ীতে ২১ এপ্রিল/২০১৮ শনিবার সকালে সূর্য আলো দিয়েছিল পূর্বদিক থেকে। সবকিছু ঠিকঠাক দেখে সাংবাদিক হাকিম বাবুলের আমন্ত্রণে শেরপুর পুলিশ একাডেমিতে গিয়েছিলাম কালের কন্ঠ শুভ সংঘের আয়োজনে জাতীয় স্কুল বিতর্ক প্রতিযোগিতায় বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে। হঠাৎ বড় ভাই আনোয়ার গ্রুপের ডাইরেক্টর এম এ হান্নানের ফোন, ছোট ভাই রাংগামাটি কাপ্তাই জোনের এএসপি আসলাম ইকবাল অসুস্থ। জ্ঞান ফিরছে না। চট্রগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আছে।

বিকেল ৩ টার ফ্লাইটে সে ছোট ভাইয়ের স্ত্রী জান্নাতুন নাহার লাবণীকে নিয়ে চট্রগ্রাম যাচ্ছে। আমাকে বললেন মায়ের পাশে থাকতে। হাকিমকে ঘটনাটি জানালাম। হাকিম শান্তনা দিয়ে বললো, ইনশআল্লাহ সব ঠিক হয়ে যাবে। একটু পরেই বড় ভাইয়ের অপর প্রান্ত থেকে হাউমাউ করে কান্না। বুঝতে বাকি রইলো না। কিংকর্তব্যবিমূঢ় বড় ভাই শুধু বললেন, মাকে নিয়ে ঢাকায় চলে আয়। পাশে ছিলেন সাংবাদিক শরীফুর রহমান, দুলাল হাজী সাহেবের ছেলে সোহেল রানা। রানা সংগে সংগে ওর গাড়ীর ড্রাইভার পলাশকে দ্রুত গাড়ী নিয়ে আসতে বললো। আর বললো , আংকেল ঢাকা, চিটাগাং যেখানে যেতে চায়, নিয়ে যাও।’ রওয়ানা হলাম নালিতাবাড়ীর বাসার দিকে।

Advertisements

এর মধ্যে ফোন পেলাম নালিতাবাড়ীর মেয়ে চট্রগ্রাম মেট্রোপলিটান পুলিশের সহকারী কমিশনার ফাতিহা ইয়াছমিন ডলির। বললো ভাই, ’আল্লাহর ইচ্ছের উপর কারও হাত নেই। আসলাম ভাইকে দেখলাম, তবে জীবন্ত নয় মৃত। বিকেল সাড়ে তিনটায় দামপাড়া পুলিশ লাইনে জানাযার নামাজ শেষে, পুলিশের বিশেষ প্রটোকলে তাকে আপনাদের কাছে পাঠাবো।’ ভাইকে বললাম সবাইকে নিয়ে চলে আসো নালিতাবাড়ীতে। বাড়িতে এলাম। মা কোরান তেলওয়াৎ করছে। ঘরে ঢুকতেই মা বললেন, দেখতো সকাল থেকেই আসলামকে মোবাইল করছি। ওতো মোবাইল ধরছে না।

নিজেকে আর সামলাতে পারলাম না। বললাম ও আর কোনদিন মোবাইল ধরবে না। আর কোন দিন বলবে না, ভাই আম্মার প্রতি খেয়াল রাখিস। কেন কি হয়েছে, মায়ের সহজ জিজ্ঞাসা। বললাম সকালে অফিসে গিয়ে বুকে ব্যাথা অনুভব করে। ওর সহকর্মীরা ওকে প্রথমে চন্দ্রঘোণা মিশনারী হাসপাতালে নেয়, পরে চট্রগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসে। এখানেই আসলাম শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করে। শতবর্ষী মায়ের বুকফাটা কান্নায় আকাশ-বাতাস ভারি হয়ে উঠে।

বাসায় ছুটে আসে পাড়া প্রতিবেশি, বন্ধু-স্বজন , পরিচিত জন। রাতে ঢাকা থেকে আসে আসলামের দুই পুত্র আজরাফ ইকবাল, আহনাফ ইকবাল, স্ত্রী জান্নাতুন নাহার লাবনী, সার্জেন্ট আহাদের স্ত্রী রোকেয়া প্রাচী সহ সব আত্মীয় স্বজন। বিভিন্ন উপলক্ষ্যে স্বজনরা এ বাড়ীতে আসে। হৈ-হুলোড়ের মধ্য দিয়ে দু’তিনদিন কাটিয়ে একবুক আনন্দ নিয়ে স্ব স্ব কর্মস্থলে চলে যায়। এবারও সবাই এসেছে, তবে উপলক্ষ্যটা আনন্দের নয় বিষাদের। রাতভর সবাই অপেক্ষায় লাশের। সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখছিলেন নালিতাবাড়ী সার্কেল এএসপি জাহাঙ্গির আলম, অফিসার ইনচার্জ একেএম ফসিহুর রহমান এবং লাশবাহী গাড়ীর প্রটোকলে থাকা পুলিশ সদস্যরা। যোগাযোগ রাখছিলেন নালিতাবাড়ীর ছেলে পুটন।

মোবাইল ফোনে দেশ-বিদেশ থেকে একের পর এক সমব্যাথি হয়ে শোক জানাচ্ছিলেন অসংখ্য সুহৃদ। আমি যখনই আর নিজেকে সামলাতে পারছিলাম না তখনই সবার অলক্ষ্যে নিরবে একটু চোখের জল ফেলতে ছুটে যাই বাড়ির পাশ দিয়ে প্রবাহমান ভোগাই নদীর ঘাটে। এই নদীতেই অবগাহন করে বড় হয়েছি আমরা সাত ভাই বোন। কত স্মৃতি, কত কথা। মসজিদ থেকে ভেসে এলো ভোরের আযানের সুর। নামাজ পড়তে গেলাম। ততক্ষণে ভোরের আলো ফুটে উঠেছে। পুলিশের প্রটোকলে লাশবাহী ফ্রিজিং গাড়ী আসলামকে নিয়ে এলো। শুরু হলো কান্নার রোল। কে কাকে থামায় , সবার চোখেই জল। বেলা ১১ টায় আমার আরেক ভাই সার্জেন্ট আহাদ স্মরণে নির্মিত সার্জেন্ট আহাদ স্মৃতি অঙ্গনে অনুষ্ঠিত হলো জানাজার নামাজ। শেরপুর জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে দেওয়া হলো রাষ্ট্রীয় সালাম, শ্রদ্ধাঞ্জলি। পারিবারিক কবরস্থানে বাবার কবরের পাশেই চির নিদ্রায় শায়িত হলো আমার ভাই।

১৯৯৯ সনের ২৮ অক্টোবর, বৃহষ্পতিবার ঢাকার ইস্কাটন গার্ডেনের প্রোপার্টি হাউজিংয়ের ১৭/১/এ নম্বর বাসা থেকে স্পেশাল ডিউটিতে বের হয়েছিল আমার আরেক ছোট ভাই সার্জেন্ট আহাদ পারভেজ। ডিউটিটি ছিল মতিঝিলে, নটরডেম কলেজ থেকে যাত্রীবেশে ছিনতাইকারীদের হাত থেকে সাধারণ মানুষকে রক্ষা করা। ঘটনার দিন যাত্রীবেশধারী ছিনতাইকারীদের ধরতে পুলিশের তিনটি টিম যৌথভাবে কাজে নামে। একটি দলের প্রধান ছিলো সার্জেন্ট আহাদ। অন্য দুটির দায়িত্বে ছিলো ইন্সপেক্টর সাহাব উদ্দিন এবং সার্জেন্ট আনোয়ার। অন্য আরেকটি দলের দায়িত্বে ছিলো সার্জেন্ট মেজবাহ। রাত সাড়ে ৮ টার দিকে সার্জেন্ট আহাদ ছিল হোটেল পূর্বাণীর সামনে।

সার্জেন্ট আনোয়ার ছিলেন একটু দূরে বিমান অফিসের কাছে। বিমান অফিসের অন্য পাশে ছিলেন ইন্সপেক্টর সাহাব উদ্দিন। জনতা ব্যাংকের সামনে ছিল সার্জেন্ট মেজবাহ। কয়েকজন যাত্রী বেশী ছিনতাইকারী নিয়ে একটি টেম্পো শিল্প ভবন থেকে পূর্বাণী ও বিমান অফিসের মাঝের রাস্তা দিয়ে শাপলা চত্বর যাওয়ার সময় সন্দেহবশত: সার্জেন্ট আনোয়ার টেম্পো থামার সংকেত দেয়। বিপদ বুঝে টেম্পোটি বিমান অফিসের পশ্চিম পাশ দিয়ে জনতা ব্যাংক ভবনের দিকে মোড় নেয়। টেম্পো না থামায় সার্জেন্ট আহাদ দৌড়ে টেম্পোর পেছনে উঠে দাঁড়ায়।

এরপরও টেম্পোর পেছনে ঝুলতে থাকে। টেম্পোটি সার্জেন্ট মেজবাহর সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় তিনি হাতের লাঠি দিয়ে টেম্পোর গ্লাস ভাংগা ছাড়া আর কিছুই করতে পারেন নি। টেম্পোটি বাংলার বাণী অফিস সোজাসুজি হলেই সার্জেন্ট আহাদ পড়ে গেলেন। আসলে তিনি পড়ে যান নি। ছিনতাইকারীরা যখন , কোনভাবেই সার্জেন্ট আহাদকে পরাস্ত করতে পারছিল না, তখন মাথায় আঘাত করে. তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। এরপর টেম্পোর ছিনতাইকারীরা সাধারণ মানুষের মতোই নির্বিঘ্নে ঘরে ফিরেছে। কিন্তু জনতা টেম্পোটি পুড়িয়ে দিয়েছে।

সার্জেন্ট আহাদকে প্রথমে পুলিশ হাসপাতাল, তারপর বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ হাসপাতাল এবং সর্বশেষ সামরিক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর সার্জেন্ট আহাদ তাকে অন্য কোন হাসপাতালে নেয়ার সুযোগ দেন নি। তিনি সবাইকে হাসপাতাল পরিবর্তন করা থেকে অব্যাহতি দিলেন রাত ১১ টায়। পুলিশ বিভাগ থেকে বিদায় নিল একজন অত্যন্ত মেধাবী পুলিশ কর্মকর্তা। তিনি আহত হয়েও নয়াটোলায় পিস্তল সহ একজন সন্ত্রাসী ধরার কারণে ১৯৯২ সালে প্রেসিডেন্ট পদক লাভ করেন। একই বছরে জাতিসংঘ শান্তি মিশনে কম্বোডিয়ায় দায়িত্ব পালন করেন। সেখান থেকে ফিরে আসার পর কসভো, পূর্বতিমুরে জাতিসংঘ মিশনে যাওয়ার জন্য মনোনীত হন। সাতদিনের মধ্যেই তাঁর সেখানে যাওয়ার কথা ছিল।

সার্জেন্ট আহাদ ১৯৮৫ সালে সার্জেন্ট পদে এবং এএসপি আসলাম ইকবাল ১৯৮৮ সালে ক্যাডেট হিসেবে যোগ দেন। চাকরি জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে পুলিশের ভাবমূর্তি উজ্জল করতে সার্জেন্ট আহাদ অসংখ্য সাহসি ঘটনার নজির রেখেছেন। তাঁরই পথ অনুসরণ করে ছোট ভাই আসলাম ইকবাল সততার অসংখ্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। সার্জেন্ট আহাদের জন্ম ১৯৬১ সালের ২৩ ডিসেম্বর আর আসলাম ইকবালের জন্ম ১৯৬৪ সালের ৪ নভেম্বর নালিতাবাড়ী শহরের আমবাগান মহল্লায়। বাবা মৃত আব্দুল আলী। মা আলহাজ¦ আমেনা খাতুন।

সাত ভাইবোনের মধ্যে ওরা ছিল ৫ম ও ৬ষ্ঠ। বড় বোন তাহমিনা বানু মিনা অবসর প্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক, বড় ভাই এম এ হান্নান , আনোয়ার গ্রুপের ডাইরেক্টর, তসলিমা বানু মিরা , গৃহীণি, আলহাজ¦ এম এ হাকাম হীরা, বাংলাভিশন ও রেডিও টুডের জেলা প্রতিনিধি এবং তৌহিদা আক্তার ঝরা গৃহিণী। আহাদের স্ত্রী চলচ্চিত্র অভিনেত্রী রোকেয়া প্রাচী। আর আসলামের স্ত্রী শেরপুরের অবসরপ্রাপ্ত উপজেলা প্রকৌশলী আলহাজ্ব আনোয়ার হোসেনের মেঝো কন্যা জান্নাতুন নাহার লাবণী। আহাদ-প্রাচীর এক মাত্র কন্যা লামিছা রিমঝিম মালয়েশিয়ার একটি ইউনিভার্সিটিতে পড়ছে। আর আসলাম-লাবণীর দুই পুত্র আজরাফ ইকবাল, আহনাফ ইকবাল। একজন ওআাইসির ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অফ টেকনোলজি (আইইউটি) তে বিজিনেস এন্ড টেকনোলজির ছাত্র। আরেকজন রাজউক থেকে এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার পর ফলাফল পাওয়ার অপেক্ষায়।

কৃতি,সাহসি, দায়িত্বশীল পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে সার্জেন্ট আব্দুল আহাদ তাঁর প্রাপ্য মর্যাদাও অনেকটা পেয়েছে। রাজধানীর গুলিস্তান পুলিশ বক্সের নামকরণ করা হয়েছে ’সার্জেন্ট আহাদ পুলিশ বক্স’, আউটার ষ্টেডিয়ামে গুলিস্তান হকার সমিতি একটি গাছ লাগিয়ে স্থাপন করেছে সার্জেন্ট আহাদ স্মৃতি ফলক, ম.হামিদ , ফাল্গুনি হামিদের নাট্যচক্র নামে একটি সংগঠন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে নাট্যতত্ব বিভাগে চালু করেছে সার্জেন্ট আহাদ মেধা বৃত্তি, তাঁর জন্মভূমি নালিতাবাড়ীতে কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীর উদ্যোগে পৌর মেয়র আবু বকর সিদ্দিক স্থাপন করেছে সার্জেন্ট আহাদ স্মৃতি প্রাঙ্গন।

সৎ নিষ্ঠ পুলিশ অফিসার হিসেবে আসলাম ইকবালের সুনামও কম না। রাজশাহী, দিনাজপুর, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, টাংগাইল, টংগি শিল্পাঞ্চল, স্পেশাল ব্রাঞ্চ যেখানেই চাকরি করেছেন, সেখান থেকেই তাঁর কর্তব্যনিষ্ঠার কথা শোনা গেছে। তার সব শেষ কর্মস্থল কাপ্তাই। সেখানকার উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান দিলদার হোসেন গভীর শোক প্রকাশ করে বলেছেন, ’ মানুষটি খুব সাদামাটা ও সৎ ছিলেন। তার মৃত্যুতে কাপ্তাইবাসী শোকাহত। ’

আমার পরিবারে সেনাবাহিনী, ডাক্তার . ইঞ্জিয়ার, ব্যাংকার, শিক্ষক থাকলেও, দুই ভাই মানব সেবার ব্রত নিয়ে যোগ দিয়েছিল পুলিশে। ১৮ বছরের ব্যবধানে দু’ভাইই চলে গেল না ফেরার দেশে। প্রতিদিন ভোরের আকাশে বেদনার বিমূর্ত প্রতীক হয়ে যেমন জ্বলজ্বল করে শুক তারা। অপেক্ষার প্রহর গুণে খেলার সাথী সন্ধ্যা তারার।

প্রতিদিনই শুকতারা বিশাল আকাশে খুঁজে বেড়ায় সন্ধ্যা তারাকে, সন্ধ্যা তারা খুঁজে বেড়ায় শুক তারাকে। চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলে, ফিরে এসো শুকতারা, ফিরে এসো সন্ধ্যা তারা। আমি আর পারি না একা খেলিতে। কিন্তু তাদের আর দেখা হয় না। হবেও না কোনদিন। আমার আদরের দু’টি ভাইও এখন ভোরের আকাশের শুকতারা হয়ে জ¦লছে। তাদের আর দেখা পাবো না। শূন্যতার এ হাহাকার নিয়েই আমাকে পথ চলতে হবে মৃত্যর পূর্ব পর্যন্ত।

লেখক: এএসপি আসলাম ইকবাল ও সার্জেন্ট আহাদের বড় ভাই ও সাংবাদিক।