শেরপুরে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মাননা জানানোর জন্য ব্যাতিক্রমী আয়োজন করতে চলেছে জেলা পুলিশ বিভাগ। মহান বিজয় দিবসকে সামনে রেখে সোমবার (১৬ ডিসেম্বর) পুলিশ সুপার কাজী আশরাফুল আজীম ১৬ জন মুক্তিযোদ্ধা পুলিশকে বিশেষ সম্মাননা প্রদান করবেন। এ সম্মাননা অনুষ্ঠানকে ঘিরে এখন পুলিশ বিভাগে ব্যাপক কর্মযজ্ঞ চলছে। সম্মাননা অনুষ্ঠানের নামকরণ করা হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা পুলিশের সম্মানে কৃতজ্ঞতা সমাবেশ। ওই সংবর্ধনা সভায় অসামান্য অবদানের জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের ক্রেষ্ট প্রদান করা হবে। এছাড়া উন্নত চিকিৎসা সেবা দেওয়া হবে বলে জানিয়েছে পুলিশ বিভাগ।
এর আগে চলতি বছর জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে সোহাগপুর বিধবাপল্লীর ৩২ জন বিধবাকে বিশেষ সম্মাননা দেওয়া হয়। সেই অনুষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রী আকম মোজাম্মেল হক ও সাবেক কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন। ওইসময় পুলিশের পক্ষ থেকে বিধবাদের চিকিৎসাসেবা ও আর্থিক সহায়তা করা হয়। এছাড়া রমজান উপলক্ষে সারা মাসের খাবার, ঈদ উপহার দেওয়া হয় বিধবাদের। পহেলা বৈশাখ ও বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনেও সোহাগপুরের বিধবাদের চিকিৎসাসেবা ও উপহার প্রদান করা হয়। ২৫ জুলাই সোহাগপুর গণহত্যা দিবসে বিধবাপল্লীতে পুলিশের পক্ষ থেকে নানা কর্মসূচী পালিত হয়।
১৬ ডিসেম্বর সোমবার পুলিশ বিভাগের ভিন্নধর্মী কৃতজ্ঞতা সমাবেশ ঘিরে মুক্তিযোদ্ধা পুলিশ সদস্যদের সাথে শেরপুর টাইমস ডটকমের পক্ষ থেকে অনুভুতি জানতে চাওয়া হয়। রনাঙ্গনের সাহসী ওই বীর সন্তানরা তাদের অনুভুতি ব্যক্ত করেন নানাভাবে।
শেরপুর জেলার শ্রীবরদী উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কনস্টেবল মো. আমিনুল ইসলাম বলেন, দীর্ঘদিন পর হলেও একজন পুলিশ সুপার মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে আমাদের সম্মাননা দেবে এ কথা ভেবে আমার খুব ভাল লাগছে।
তিনি বলেন “বঙ্গবন্ধুর ডাকে দেশের স্বাধীনতার জন্য হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছিলাম। তখন চাওয়া পাওয়া কিছুই ছিল না। দেশ কখন স্বাধীন হবে এ স্বপ্নে বিভোর ছিলাম। ১৯৭১ সালের ২৫ নভেম্বর বকশীগঞ্জের কুড়িবিলে পাক-হানাবাহিনীর সাথে সন্মুখ যুদ্ধ হয় আমাদের। আমি সেই যুদ্ধে অংশ নেই। ৫০-৬০ জন পাকবাহিনী আমাদের হাতে মারা যায়।
আমার চোখের সামনে আমার সহযোদ্ধা নূর ইসলামের বুক গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেয় পাকবাহিনী। সেদিন আমি নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যাই। তাই আমার চাওয়ার কিছু নেই। অতিরিক্ত জীবন বয়ে চলেছি আমি। তবে আমরা যারা নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেরা যুদ্ধ করেছিলাম তারা কিন্তু যুদ্ধের পর আজ পর্যন্ত হিসেবের খাতা মেলাতে পারিনি।
স্বাধীনতার ৪৮ বছর পার হয়েছে। বর্তমান সরকারের শাসন আমল ছাড়া আমাদেরকে সত্যিকার অর্থেই কেউ মূল্যায়ন করেনি। এখনো আমাদের জীবিত অধিকাংশ মুক্তিযোদ্ধা নানা রোগ-শোকে ভুগে মৃত্যুবরণ করছেন। আমরা যারা পুলিশে ছোট চাকুরী করতাম তাদের অবস্থা ভাল না। যদি আমাদের অবসরের পর রেশন দেওয়া হতো, যদি চিকিৎসার ব্যায়ভার সরকার নিত। তাহলে হয়তো আর কিছুদিন শান্তিতে বেঁচে থাকতে পারতাম।”
মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি পুলিশের এ কতৃজ্ঞতা সমাবেশকে অসাধারন উল্লেখ করে অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ পরিদর্শক ও নকলা সাইলাম পুরের বাসিন্দা মহর উদ্দিন বলেন,“১৯৬৮ সালে আমি পুলিশে যোগ দেই। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ আমি রাজশাহী পুলিশ লাইন্সে কর্মরত ছিলাম। রাজারবাগের মত রাজশাহীতেও পাক হানাদার বাহিনী পুলিশের ওপর হামলা করে। ওইদিন আমার ডিআইজি সালাউদ্দিন আহম্মেদ, এসপি আব্দুল মজিদসহ অনেকই শহীদ হন। আমার সহকর্মী আবুল কাশেম আমার সামনেই মারা যান। আমরা প্রতিজ্ঞা করি দেশ মাতৃকার স্বাধীনতার জন্য নিজের জীবন উৎস্বর্গ করব। এ ভেবেই ১৩-১৪ জনকে নিয়ে রাজশাহী বেরীবাঁধ টপকে, পদ্মা পাড় হয়ে কাতলামারী চলে যাই। পরে বহরমপুর, মুর্শিদাবাদ, কুচবিহার হয়ে আসামে যাই। ট্রেণিং নিয়ে যুদ্ধে অংশ নেই। তিনি বলেন, যুদ্ধ শুরু হলে নিজের জীবনকে বাঁজি রেখে যুদ্ধ করেছি। কিছু পাওয়ার আশা করেনি।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ফের পুলিশে যোগ দিই। ২০০৭ সালে অবসর নেই। কিন্তু আমাদের এখন আর কেউ খোঁজ রাখে না। রেশন পাই না। কিছুদিন আগে হার্টে সমস্যা হয়। ৯টা ব্লক ছিল। চাকুরী থেকে পাওয়া সবটাকা চিকিৎসার জন্য ব্যায় করলাম। কিন্তু কিছুই পেলাম না। এখন খুব কষ্টে দিন কাটছে। প্রধানমন্ত্রী আমাদের জন্য অনেক করেছেন। শুধু একটাই দাবী মুক্তিযোদ্ধারা আর বেশিদিন বাঁচবেন না। বড়জোড় ৮-১০ বছর বাঁচবেন। তাই তাদের চিকিৎসার ভার যদি প্রধানমন্ত্রী নিতেন তাহলে খুব ভাল হতো। এসপি সাহেব কৃতজ্ঞতা সমাবেশ করে আমাদের সম্মানিত করবে। একথা শুনে তাঁর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। কারণ আমরা কিছু পাওয়ার জন্য যুদ্ধ করিনি। দেশের জন্য যুদ্ধ করেছি।
নালিতাবাড়ী উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা ও পুলিশের কনস্টেবল আব্দুল জব্বার বলেন, চাকুরী শেষ হওয়ার পর আমার ষ্ট্রোক হয়। গত তিন বছর নিজের ৪ একর জমি চিকিৎসার জন্য বিক্রি করেছি। বসতভিটা ছাড়া আর কিছুই নেই। তিন মেয়ের কেউ চাকুরী পায়নি। এখন বড় মেয়ের ছেলেটিকে চাকুরী নিয়ে দিতে পারলে ভাল হতো। সংবর্ধনা সভায় এসপি সাহেবকে নাতীর চাকুরীর জন্য অনুরোধ করব। রেশন পেলে শেষ জীবনটা সুখের হবে বলে জানান ওই মুক্তিযোদ্ধা।
ঝিনাইগাতী উপজেলার বাসিন্দা মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল কুদ্দুস খান বলেন, আমি রাষ্ট্রের কাছে, সরকারের কাছে কিছুই চাইনা। শুধু মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় একটি দেশ চাই। ওই মুক্তিযোদ্ধা পুলিশ কনস্টেবল বলেন, শেরপুরের এসপি সাহেব আমাদের জন্য কৃতজ্ঞতা সমাবেশ আহবান করেছেন। এটা অত্যন্ত ভাল উদ্যোগ। কারণ আমাদের সম্মানিত করলে রাষ্ট্র সম্মানিত হয়। তাছাড়া আজকের পুলিশ তো মুক্তিযুদ্ধের পুলিশ। দেশের মুক্তির জন্য সবার আগে পুলিশ রক্ত দিয়েছে।”
এ ব্যাপারে শেরপুরের পুলিশ সুপার কাজী আশরাফুল আজীম বলেন, বীর মুক্তিযোদ্ধারা প্রাণের মায়া ত্যাগ করে দেশ মাতৃকার জন্য অসামান্য আত্মত্যাগ করেছেন। এজন্যই আজকে আমরা স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ পেয়েছি। তিনি বলেন, আমরা মনে করি, মুক্তিযোদ্ধারা হচ্ছে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান। একজন মানুষ তাঁর জীবদ্দশায় অনেক কিছু হতে পারবে। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা হতে পারবে না। দেশ মাতৃকাকে স্বাধীন করে স্বাধীন দেশে বসবাস করা একজন মানুষের জীবনে এটি বিরল ঘটনা। এ ধরনের ঘটনা কোন মানুষের জীবনে আসতেও পারে নাও আসতে পারে। সেজন্যই পুলিশ বিভাগ ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের দিনে কৃতজ্ঞতা স্বরূপ এ ধরনের কৃতজ্ঞতা সমাবেশের আয়োজন করেছে। ভবিষ্যতেও আমরা এ ধরনের আয়োজন করব।